বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
সেবার সৌন্দত্তি থেকে ফেরার পথে কোলহাপুরে না এসে সবার নির্দেশ অনুযায়ী এসেছিলাম বেলগাঁওয়ে। সেখানে যে লজে উঠেছিলাম তার মালিক বললেন, ‘আপনি সৌন্দত্তি গিয়েছিলেন শুনে খুব খুশি হলাম। ওখানকার নিয়মরীতি দেখে খুবই অবাক হয়েছিলেন, তাই না? সামনের বছর ঠিক একই সময়ে চলে যান চন্দ্রগুট্টি গ্রামে। বেলগাঁও থেকে বাসে অথবা একটা গাড়ি নিয়ে চলে যান। সকালে গিয়ে রাতে ফিরে আসুন। অর্থাৎ ওই মাঘী পূর্ণিমার দিন ওখানকার পবিত্র বরোদা নদীতে মেয়েরা পুণ্যস্নান সেরে গুত্তেভারা দেবীর মন্দিরে পুজো দিতে যান। ওখানে আপনার অন্যরকম অভিজ্ঞতা লাভ হবে। তবে ভুলেও যেন ওদের ছবি তুলতে যাবেন না।’ ঠিক সেই কারণেই আবার হাওড়া থেকে রওনা হয়ে পুনেয় এসে ভাস্কো-দা-গামার পথে বেলগাঁওতে নামলাম। আগে থেকে চিঠি দেওয়াই ছিল। তাই একটা সিঙ্গল রুম রাখা ছিল আমার জন্য। ঘরের ভাড়া তখনকার দিনে দশ টাকা। পরদিন খুব সকালে বেলগাঁও থেকে রওনা হলাম চন্দ্রগুট্টির দিকে। ভাগ্য ভালো যে লজ মালিকের সৌজন্যে অন্য এক যাত্রীদলের সঙ্গে তাদের গাড়িতেই ব্যবস্থা হল। প্রায় ঘণ্টা তিনেকের যাত্রাপথ। এক সময় পৌঁছে গেলাম চন্দ্রগুট্টিতে।
বাস থেকে নেমেই যে দৃশ্য দেখলাম তা শুধুই অভাবনীয় নয়, অকল্পনীয়। যাই হোক, এই ভাবেই একবার বরোদা নদীর তীরে এসে জলস্পর্শ করে মাথায় একটু জল ছেটালাম। চারদিকে তখন অসংখ্য পুলিসের কড়া নজরদারি। সে কী স্নানের উৎসব সেখানে। পুলিসের লোকেরা অবশ্য আমাকে থাকতে দিল না বেশিক্ষণ। হাত নেড়ে স্থান ত্যাগ করতে বললেন। সৌজন্যবোধে আমিও বিদায় নিলাম। এরপর প্রশস্ত রাজপথ ধরে চলে এলাম মহাদেবী গুত্তেভারার মন্দিরে। এখানেও বৃহন্নলাদের দল ঘোরাফেরা করছে সর্বত্র। এখানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই পুজো দিচ্ছেন মন্দিরে। মেয়েরা স্নান করে গলায় মালা ও হাতে ঘটি বা ছোট কলসি ভর্তি বরোদার জল নিয়ে মন্দিরে এসে ঢালছেন। এই দিন মা গঙ্গা নাকি গুপ্তপথে বরোদা নদীতে এসে মিলিত হন। আমি বহুকষ্টে ভিড় ঠেলে কোনওরকমে দর্শন করলাম গুত্তেভারাদেবীকে।
এরপর শহরের একটি দোকানে বসে এখানকার সুস্বাদু ইডলি, ধোসা ইত্যাদি খেয়ে খিদে মেটালাম। এই দোকানেই এক সদাশয় ব্যক্তি প্রসন্ন চিত্তে আমার সঙ্গে আলাপ জমালেন। ভাগ্য ভালো যে, কন্নড়বাসী হয়েও ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে আমার সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন। পুনেতে ওঁর কর্মস্থল, আজ মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে এখানে এসেছেন উনি।
আমি গত বছর সৌন্দত্তি গেছি শুনে খুশি হলেন খুব। বললেন, ‘সৌন্দত্তি এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তবে সৌন্দত্তি হল সতীপীঠ। আর গুত্তেভারা উপপীঠ। এখানে সতী অঙ্গ নয়, দেবীর ‘মেখলা’ পড়েছিল। সৌন্দত্তির কাহিনী নিশ্চয়ই শুনেছেন? দেবী অতি ভয়ঙ্করী। আর গুত্তেভারাও ঠিক তাই। এঁর কাছে নিষ্কাম হয়ে আসতে হবে। এই সব বিবস্ত্র মহিলাদের দিকে তাকিয়ে যদি কেউ কামভাব মনে আনে, তবে তার কিন্তু নিস্তার নেই। তাই কেউ ওদের দিকে মনে কুভাব নিয়ে তাকায় না। সৌন্দত্তিতেও সেই একই নিয়ম। দেবদাসীদের প্রতি মনে কুভাব আনবে না কেউ।’
এরপর তিনি যা বললেন তা এই— ‘সৌন্দত্তির ওই দেবীর মধ্যে রেণুকা বা রেণুকাম্বা দেহান্তে লীন হয়ে আছেন। এই রেণুকা হলেন জমদগ্নি মুনির স্ত্রী এবং পরশুরামের মাতা। অসাধারণ সতীত্বের জন্য তিনি কাঁচা মাটির কলসিতে ভরে মলপ্রভা নদী থেকে জল নিয়ে আসতেন। একবার জল আনতে গিয়ে এক সর্বাঙ্গসুন্দর গন্ধর্বকে দেখে মুহূর্তের জন্য তাঁর রূপদর্শনে বিচলিত হন। তারই ফলে তাঁর সতীত্ব নষ্ট হওয়ায় তিনি আর কলসিতে জল ভরতে পারলেন না। জল ভরামাত্রই কলসির তলা ছেড়ে গেল। জমদগ্নি সব বুঝে রেণুকাকে অভিশাপ দিলেন এবং পরশুরামকে আদেশ দিলেন এই মুহূর্তে জননীর মস্তক ছেদন করতে। পরশুরাম পিতার আদেশ পালন করলেন। জমদগ্নি তখন খুশি হয়ে বর দিতে চাইলেন পরশুরামকে। পরশুরাম বললেন, ‘আমি আপনার আদেশ পালন করেছি। এখন আমি আমার জননীর পুনর্জীবন চাই।’ জমদগ্নি বললেন, ‘তথাস্তু।’ সেই সময় পথ দিয়ে এক নীচ জাতীয়া স্ত্রীলোক যাচ্ছিলেন। জমদগ্নি তাঁর মাথাটি কেটে বসিয়ে দিলেন রেণুকার দেহের ওপর। রেণুকা কুৎসিত মুখ নিয়ে বেঁচে উঠলেন। জমদগ্নির রাগ তখন পড়েছে। রেণুকাকে তিনি এই বলে আশীর্বাদ করলেন, ‘আজ থেকে তোমাকে দেবীর মতোই পূজা করবে সকলে এবং অবিবাহিতা মেয়েদের উৎসর্গ করা হবে তোমার কাছে। সেই সব মেয়েরা চিরকাল তোমার দাসী হয়ে থেকে পরপুরুষকে দেহদান করবে। সেক্ষেত্রে কুষ্ঠরোগীও বাদ যাবে না। দেহান্তে ইয়েলাম্মায় লীন হবে।’
আমি শুধু শুনেই গেলাম। কোনও মন্তব্য করলাম না। আমাদের পৌরাণিক কাহিনীতে পরস্পর বিরোধী এমন অনেক কাহিনী আছে।
এরপর আমি চন্দ্রগুট্টির পথে পথে ঘুরে সন্ধের আগেই বেলগাঁওতে ফিরে এলাম। কর্ণাটকের গুত্তেভারা মন্দিরে মাঘী পূর্ণিমার দিন দেবদাসীরা এইভাবেই পুজো দিতে যায়।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল