বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সিপিএমের ‘নেগেটিভ’ ভোটের সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। অনেকেই বলেছিলেন, ‘এই একবারই।’ তৃণমূলের দ্বিতীয়বারের ক্ষমতা দখল নিয়ে সন্দেহ ছিল দলের অনেক নেতা-কর্মীর মনেও। তাই পাঁচ বছর পর এলেবেলে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অনেকেই প্রথম ইনিংসে খুল্লামখুল্লা খেলার সাহস পাননি। তখন সংগঠনও তেমন দানা বাঁধেনি। সিপিএমের ভূত তাড়া করছে। সবসময় কী হয়, কী হয় একটা ভাব।
ফলে নেতারা ছিলেন সংযত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন প্রকল্পের দৌলতে লক্ষ লক্ষ বেনিফিসিয়ারি তৈরি করে ফেলায় ২০১৬ সালে তৃণমূল হই হই করে জিতে যায়। আর তারপরই নেতাদের ডানা গজানোর শুরু। ‘প্রোটিনে’ ভরপুর নেতাদের ডানার দ্রুত বৃদ্ধিতে নিজেরাই চমকে গেলেন। ভাবতে লাগলেন, আর বোধহয় মাটিতে নামতে হবে না। উড়ে উড়েই কেটে যাবে বাকি জীবনটা। কিন্তু পিকের হ্যাঁচকা টানে ওই ‘উড়নচণ্ডী’ নেতারা একে একে মাটিতে ল্যান্ডিং করতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে ‘সফ্ট ল্যান্ডিং’ খুব কমই হচ্ছে। ‘হার্ড ল্যান্ডিং’ এর পর অনেকেরই ‘বিক্রম’-এর মতো দশা।
গাড়ি বা যে কোনও যন্ত্র বাজারে ছাড়ার আগে সমস্ত কিছু পরীক্ষার পর যেভাবে ‘টেস্টেড ওকে’ ছাপ মারা হয়, ঠিক সেভাবেই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। ২০২১ সালে মার্কেটে ছাড়ার আগে ‘পাবলিক ল্যাবরেটরি’তে টেস্টিং শুরু হয়েছে। সেই পরীক্ষা দিতে গিয়েই অনেকের ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। কমোড ও এসিতে অভ্যস্ত জননেতাদের পক্ষে গ্রামে গিয়ে কর্মীর বাড়িতে নিশিযাপন যে কী ভয়ঙ্কর কষ্টের, তা অনেকেই টের পাচ্ছেন। কেউ মশার কামড় সহ্য করতে না পেরে বাড়ি বদল করছেন, কেউ আবার কর্মীর বাড়িতে কোনওরকমে রাতটা কাটিয়ে ভোরের আলো ফোটার আগেই কমোডের সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছেন। তবে বুদ্ধিমানদের ব্যাপারটা আলাদা, তাঁরা কিন্তু যাওয়ার আগে থেকেই পেট পরিষ্কারের প্রযুক্তির সন্ধান নিয়েই বেরচ্ছেন।
উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার এক বিধায়ক তো ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে জোর বিপাকে পড়ে গিয়েছেন। ওই নেতা ভেবেছিলেন, চালাকির দ্বারাই মহৎ কাজটি সেরে ফেলবেন। কর্মীর বাড়িতে রাত্রিযাপন না করেই কর্মসূচি পালনের রিপোর্ট দিলেন। কিন্তু টিম খবর দিল, বিধায়ক বাড়িতেই ছিলেন। রিপোর্ট পেয়েই বিধায়ককে ফোন, যে বাড়িতে গিয়েছিলেন, সেই কর্মীর ফোন নম্বর দিন। বিধায়কের চটজলদি জবাব, ‘কর্মী খুবই গরিব, ফোন নেই।’ পাল্টা বলা হয়, ঠিকানা বলুন। তখন তো বিধায়কের ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ অবস্থা। ভুল স্বীকার করে সে যাত্রায় রক্ষা পান।
ফুটবলের ময়দানে পিকের ভোকাল টনিক যেভাবে ঝিমিয়ে পড়া খেলোয়াড়দেরও তাতিয়ে তুলত, একইভাবে ভোটের মাঠের পিকেও টোটকা দিয়ে বেতোদের টাট্টু বানানোর চেষ্টা করছেন। পারবেন কি না, সেটা সময়ই বলবে। তবে অধিকাংশ তৃণমূল বিধায়কের ধারণা, বিধানসভা ভোটের টিকিটে প্রশান্ত কিশোরের টিমের ভূমিকা থাকবে। তাই অনেক ‘বেতো’ ঘোড়াও ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি পালনের জন্য দৌড়চ্ছে।
এতদিন যাঁরা টিকিট বিলির আগে কলকাতায় ক্যাম্প করে থেকে নিজাম প্যালেসে, তৃণমূল ভবনে দাদা ধরতেন, এবার তাঁরা বুঝে গিয়েছেন, দিন বদলেছে, খেটে খেতে হবে। পাবলিক মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরবে, হুল ফোটাবে বুঝেও এলাকায় যাচ্ছেন। অনেকের অবস্থা নাক টিপে, চোখ বুঝে খালি পেটে করলার রস খাওয়ার মতো। চোখের সামনে ভাসছে কয়লা, পাথর, বালি, বোল্ডার, আরও কত কিছু।
জনসংযোগ যাত্রায় সব চেয়ে বিপাকে পড়েছেন ‘ভাড়াটিয়া বিধায়করা’। যাঁরা জেলা শহরের বাসিন্দা হয়েও লবির জোরে গ্রামীণ এলাকার টিকিট জোগাড় করে বিধায়ক হয়েছেন। তাঁদের এক জায়গায় চাষ, অন্য জায়গায় বাস। ফলে জমির সঙ্গে তাঁদের তেমন সম্পর্ক নেই। এই সব বিধায়কের ভূমিকা অনেকটা জমি ভাগে দিয়ে ফসলের ভাগ নেওয়ার মতো। পৈত্রিকসূত্রে জমির মালিক হয়ে বসে আছেন, কিন্তু জমির আল মাড়ান না। তবে, ভাগের ফসল ঠিক ঘরে ঢুকে যাচ্ছে। অধিকাংশ ‘ভাড়াটে বিধায়কে’র এলাকা দেখভালের জন্য একজন করে ভাগচাষি আছেন। তাঁদের সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবিই সম্বল। পাশে পাবলিকের ‘প’ পর্যন্ত নেই। কিন্তু, তাঁরাই এলাকায় ছড়ি ঘোরান। দায়িত্ব পেয়েই দলের দক্ষ নেতাকে টাইট দিতে নেমে পড়েন। প্রশাসনিক সভায় তাঁরাই যান। বিধায়ক তহবিলের টাকা খরচের দায়িত্বও তাঁদের। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিনিধি এতটাই ‘পারদর্শী’ যে সরকার উন্নয়নের স্বার্থে টাকা দিলেও তা খরচ করতে পারেন না।
পিকের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বেশ কিছু ‘ভাড়াটে বিধায়ক’ বিপাকে পড়ছেন। শহরের ঝলমলে জীবন ছেড়ে অজ গাঁয়ে গিয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে, প্রশ্নবাণে ক্ষতবিক্ষত হতে হচ্ছে। প্রশ্ন তো নয়, এক একটা যেন বুলেট। কাটমানি, তোলাবাজি থেকে কেন ভোটের সময় প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও জলের ব্যবস্থা হল না, কেন রাস্তায় আলো জ্বলল না, কেন বালি পাচার বন্ধ হচ্ছে না? এমন সব চোখা চোখা প্রশ্নে বিব্রত বহু বিধায়কের মুখে কেবল ‘জানতাম না তো, দেখছি... অ তাই বুঝি’ ছাড়া কোনও শব্দ বেরচ্ছে না।
অনেকেই বলছেন, ‘ভাড়াটে বিধায়ক’দের জন্য নৈশযাপন ও জনসংযোগ কর্মসূচি দ্বিগুণ করা হোক। কারণ তাঁরা প্রচারের সময় যেখান থেকে দাঁড়াচ্ছেন, সেই নির্বাচনী কেন্দ্রকে ‘সেকেন্ড হোম’ বলে দাবি করে থাকেন। সেই কেন্দ্রে বাড়ি ভাড়া করে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে, জেতার পর অধিকাংশ বিধায়কই দলীয় কর্মসূচি ছাড়া সেখানে পা রাখেন না। তাই এবার লোকসভা নির্বাচনে অধিকাংশ ‘ভাড়াটে বিধায়কে’র কেন্দ্রেই তৃণমূলের বেশি বিপর্যয় ঘটেছে।
তবে, যাঁরা নিয়মিত নিজের নির্বাচনী কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, তাঁদের কাছে ‘দিদিকে বলো’ আর্শীবাদের কাজ করছে। এলাকার লোকজন বিধায়ককে ছোটখাটো সমস্যার কথা বলতে পারছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার চটজলদি সমাধানও হয়ে যাচ্ছে। হুগলি জেলার এক বিধায়ক জনসংযোগ কর্মসূচিতে গিয়ে আদিবাসী পাড়ায় রাত কাটানোর সময় শুনলেন, এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন রেশন কার্ডের জন্য আবেদন করেও কার্ড পাননি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, তিন মাস আগে তাঁর রেশনকার্ড বিডিও অফিসে এসে পড়ে রয়েছে। দু’দিনের মধ্যে তাঁর কাছে কার্ড পৌঁছে যাওয়ায় তিনি ‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির গুণকীর্তন করে বেড়াচ্ছেন।
‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচির একটা বিষয় কিন্তু নেতাদের বেশ ভাবাচ্ছে। ক্ষোভ উগরে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দাবিও জানাচ্ছেন। অধিকাংশ বিধায়কই তাঁদের দাবি লিখে নিচ্ছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে বিধায়করা অত্যন্ত ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী। সেই বিধায়করা তাঁদের দাবি ও নামঠিকানা লিখে নেওয়ায় অনেকেই ভাবছেন, এবার সমস্যার সমাধান হবে। তাই এই সব দাবি পূরণ না হলে পরবর্তী সময়ে বিক্ষোভের মুখে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
‘দিদিকে বলো’ কর্মসূচি চালু হওয়ার পর কেউ কেউ নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে সুফল পেয়েছেন। আর সেসব ঘটনা ফলাও করে প্রচার হওয়ায় অনেকেই ভাবছেন, ‘দিদিকে বলো’ হল মুশকিল আসান। একবার ফোন লাগাতে পারলেই কাজ হাসিল। ‘দিদিকে বলো’ মানুষের মধ্যে কেমন প্রভাব ফেলেছে, তা একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করলে কিছুটা বোঝা যাবে।
কয়েকদিন আগে পরিচিত অবসরপ্রাপ্ত এক অধ্যাপিকা ‘দিদিকে বলো’র ফোন নম্বর জানতে চাইলেন। তাঁর গলায় উৎকণ্ঠার ছাপ স্পষ্ট। তিনি বললেন, তাঁর পরিচিত কলকাতার এক বৃদ্ধাকে ছেলে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ওই বৃদ্ধা নিরুপায় হয়ে থানায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে এলাকায় শাসক দলের দাপুটে নেতা। তাই পুলিস পাত্তা দিচ্ছে না। খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে দিন কাটছে। তাই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ‘দিদিকে বলো’ নম্বরে ফোন করতে চান।
উপেক্ষা আর অবহেলায় অভ্যস্ত মানুষজন অনেকেই প্রতিকারের আশায় ৯১৩৭০৯১৩৭০ নম্বরে ফোন করছেন। কর্মসূচি শুরুর একদিনের মধ্যে প্রায় এক লক্ষ ফোনকল প্রমাণ করে, এখনও মমতা নামটির উপর মানুষের ভরসা রয়েছে। তাঁরা বিশ্বাস করেন, দিদির কানে পৌঁছে দিতে পারলেই সুরাহা মিলবে। কেউ কেউ হয়তো ফোন করে প্রতিকারও পাচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ‘দিদিকে বলো’ কোনও ম্যাজিক নয়। এটা একটা কর্মসূচি। জনগণের রায়ে নির্বাচিতদের মানুষের মুখোমুখি করানোর কর্মসূচি। প্রশান্ত কিশোর হয়তো উপলব্ধি
করেছেন, বিধায়কদের জনগণের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারলেই, ভোট ফিরবে তৃণমূলে। তাই বেড়ে যাওয়া ডানা ছেঁটে মাটিতে নামিয়ে আনার চেষ্টা। কারণ ঘাসফুল ফোটে মাটিতেই।