বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
দুর্গাপুজো এলে কখনও কখনও একটা ছোট মেয়ের কথা মনে পড়ে যে তার বাবার সঙ্গে ঠাকুর গড়া দেখতে বাঙালি আখড়ায় যেত। ঠাকুর গড়া দেখতে যাবার সূত্রে পুজোর অনেক আগেই তার মনে এক পুজো পুজো ভাব এসে যেত। আখড়ায় সার বেঁধে বহু প্রতিমা গড়া হতো। কলকাতার কারিগর এসে সেখানে প্রতিমা গড়তেন। মেয়েটির চোখের সামনে খড়বাঁধা কাঠামোয় মাটি চাপত, রং পড়ত ও ধীরে ধীরে সপরিবারে মা দুর্গা রূপ পরিগ্রহ করতেন। তখন ছিল একচালা প্রতিমার যুগ। দেবীর মুখ মানুষের আদলে তৈরি হতো না। তখনকার সিংহও আজকালকার মতো আসল চেহারার হতো না। কিছুটা ঘোড়ার আদলের এক সবুজঘেঁষা রঙের সিংহকেই দেবীর যথার্থ বাহন বলে মনে হতো। প্রতিমার অঙ্গে ক্রমে বস্ত্র ও আভরণ উঠত, তাঁর দশহস্তে, আয়ুধগুলি স্থান পেত। সেই প্রতিমায় যখন পুজো হতো তখন তাতে প্রাণের যোগ ঘটত। সেই পুজোর পুষ্পাঞ্জলি, প্রার্থনা, প্রণাম—সব উঠে আসত প্রাণের গভীর থেকে। সন্ধিপুজোর সময় দেবী যে সত্যই প্রাণবন্ত হয়ে উঠতেন তখন তাঁর চোখের দিকে তাকালেই তা বোঝা যেত। সকালে পুষ্পাঞ্জলি, সন্ধ্যায় নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে কখন যেন পুজোর তিনটি দিন কেটে যেত। দশমীতে দেবী প্রতিমা বিসর্জনের দিনটি প্রতিবছরই যেন বড় তাড়াতাড়ি এসে যেত। দশমীতে মায়ের দর্পণে বিসর্জনের পর একচালা সেই দেবী প্রতিমাকে লোকেরা দুটি বাঁশের উপরে বেঁধে বাহকদের কাঁধে চাপিয়ে রওনা করিয়ে দিত গঙ্গার উজান বেয়ে কৈলাসের পথে। গঙ্গার ঘাটের পথে দেবী প্রতিমার যাত্রা হতো কন্যার পতিগৃহে যাত্রার মতো বিষাদপূর্ণ। কোনও শোভাযাত্রা সেখানে হতো না। কয়েকটি হ্যাজাক বাতির আলোয় আলোকিত করা পথ ধরে দুর্গা মা মহেন্দ্রু ঘাটের উদ্দেশে রওনা হতেন। মা দুর্গার যাত্রা ঘোষণা করা হতো কিছু পর পর একটি মাত্র কাঁসরে মাত্র একবার করে ঘা মারার শব্দে। সেই শব্দ শোনার জন্য সবাই কান পেতে থাকত। সেই শব্দ কানে এলেই মেয়েটি বাড়ির সকলের সঙ্গে সামনেই পার্কের গেটের কাছের জমায়েতে গিয়ে মা দুর্গাকে শেষবারের মতো প্রণাম নিবেদন করত। পিতৃগৃহ ছেড়ে যেতে মা দুর্গার কষ্ট তখন তাঁর বিষণ্ণ মুখে ধরা থাকত। সেই বিষণ্ণতায় সবাই আক্রান্ত হতো ও সবার চোখের জলে ঝাপসা হয়ে যাওয়া পথ বেয়ে মা দুর্গার পতিগৃহে যাত্রা হতো।
তারপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। এখন মেয়েটি নিজেই শ্বশুরঘর করে। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ভবানীপুর অঞ্চলে এক বৈষ্ণব হরিনাম কীর্তন করে মাধুকরী করতেন। সারাবছর হরিনাম করলেও পুজোর আগে তিনি আগমনি গান গাইতেন। সঙ্গে সঙ্গত করত গলায় বাঁধা ছোট একটি হারমোনিয়াম। গায়ে নামাবলি জড়ানো ছোটখাট মানুষটি পুজোর আগে গাইতেন—‘এবার আমার উমা এলে আর মাকে পাঠাব না’ অথবা ‘যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী’ ইত্যাদির মতো সব গান। আগমনির সেই গান শুনে মেয়েটির মনে ভেসে উঠত বাপের বাড়ির ছবি, আখড়ার ঠাকুর, পুজোর সেইসব দিন। প্রতিদিনই বৈষ্ণবের ঝুলিতে চাল দেবার সময়ে সবার অলক্ষ্যে কয়েক ফোঁটা চোখের জলও তাতে মিশে যেত। ক্রমে চারদিক আলোর সাজে ভরিয়ে, নানা গানে দিগ্বিদিক পূর্ণ করে কলকাতায় পুজো এসে যেত। নানারকমের বাহারি মণ্ডপ, মানুষের আদলে প্রতিমার মুখ, পার্কের বড় পুজোগুলির সঙ্গে নাগরদোলা—পুজো যেন এক বিরাট মেলা। নতুন কাপড় পরে সবার সঙ্গে অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দেওয়া, সন্ধ্যায় ঠাকুর দেখতে যাওয়া—সবই নিয়ম মতো হতো। তবে ক্বচিৎই তা দৃষ্টির গণ্ডি ছড়িয়ে হৃদয়কে স্পর্শ করত। মেয়েটির বাড়ির সামনে দিয়ে ছিল প্রতিমা বিসর্জনের পথ। কয়েকদিন ধরে সেই পথে সার বেঁধে প্রতিমাগুলি যেত। চোখ ধাঁধানো আলো ও নানা বাজনার হইহই শব্দে বিসর্জনের বিষাদ হারিয়ে যেত। প্রতিমার দৃষ্টি যেমন নিস্পৃহ থাকত মেয়েটির মনও হয়ে থাকত নিস্পৃহ। নিয়মমতোই প্রতিমার দেবীকে পরের বছর আবার আসবার আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়মের প্রণামসহ দেবী প্রতিমাকে বিদায় জানানো হতো। বিসর্জনের কষ্ট মনকে ব্যথিত করত না।
ক্রমে সময়ের সঙ্গে মেয়েটি বিসর্জনের আগে প্রতিমা বরণ করা শিখল। মায়ের মুখ মুছিয়ে, সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে, মুখে মিষ্টি ও হাতে এক খিলি পান দিয়ে মায়ের কানের কাছে মুখ নিয়ে প্রার্থনা করতে শিখল সামনের বছর সবাইকে নিয়ে যেন আনন্দের সঙ্গে পুজো দেখার কোনও ব্যতিক্রম না হয়। পিতৃকুল, মাতৃকুল, শ্বশুরকুলের সবার কল্যাণ কামনা করে সামনের বছর তাঁকে আবার আসার প্রার্থনা জানাতে শিখল।
সময় বয়ে চলে। বছরের পর বছর ঘুরে দুর্গাপুজো আসে ও যায়। তেমনই এক সময়ের এক দেবীপক্ষের কথা। একদল পর্বতারোহী চলেছে পার্বতীর পতিগৃহ অঞ্চলের একটি শৃঙ্গজয়ের উদ্দেশে। দলে ডাক্তার আছেন, অধ্যাপক, গবেষক আছেন এবং আছে সেই মেয়েটিও। সে বছর পুজো ছিল দেরিতে, আশ্বিন মাস প্রায় শেষের দিকে। রোটাংপাস পার করে যে পথ ডাইনে ঘুরে স্পিতির দিকে গেছে সেই পথ ধরে তাদের যাত্রা। পাহাড়ে ঠান্ডা বাড়ছে। উপরদিকে পথের ধারের অস্থায়ী চায়ের দোকান ও অস্থায়ী বাসা ছেড়ে লোকেরা একে একে নীচের দিকে নেমে আসছে। ভেড়া ও ছাগলের দুপাশে ঝোলানো থলিতে বেঁধে সংসারের জিনিসপত্র নামিয়ে আনছে। এমন সময়ে শীতের মুখে উপরের দিকে বাস ভর্তি লোকের যাওয়া দেখে তাদের চোখে মুখে সর্বত্র ছিল বিস্ময় ও জিজ্ঞাসা। বাস একে একে গুলাবা, পালচেন, গ্রামফু, খোকসার ইত্যাদির বসতিগুলি পার করতেই সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এল। সরকারি সেই বাস সবাইকে বাতালে পৌঁছে দেবে—সেই শর্ত আছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আলোকিত পথে বাস ধীরে ধীরে চন্দ্রা নদীর উজান বেয়ে এগিয়ে চলেছে। এই চন্দ্রা নদীই আরও নীচে ভাগা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে চন্দ্রভাগা বা চেনাব নাম নিয়ে পাকিস্তানে সিন্ধু নদে গিয়ে পড়বে। মাঝে এক জায়গায় পথ অত্যন্ত খারাপ বলে সবাইকে নামিয়ে দিয়ে খালি বাসটি এগিয়ে গেল। সেই অন্ধকারে টর্চের আলোয় সবাই পথ চলে আবার গিয়ে বাসে উঠল। এভাবে ঘণ্টাখানেক এগিয়ে ড্রাইভার জানিয়ে দিল বাস আর যাবে না। সামনেই চন্দ্রা নদীর উপরে গাড়ি যাতায়াতের যে ব্রিজ পাশের পাহাড় থেকে নেমে আসা হিমস্রোতের বরফ ব্রিজের নীচের অংশের নদীগর্ভে স্তূপাকারে জমে ব্রিজের লোহার বিমকে বাঁকিয়ে উপর দিকে তুলে দিয়েছে। ফলে পথ বন্ধ। সেখানে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দিবারাত্রি মেরামতির কাজ চলছে। পেট্রম্যাক্সের বাতির আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। স্পিতি যাবার পথ যতশীঘ্র সম্ভব খোলা চাই। অসহায় বাসযাত্রীরা সেখানে অন্ধকারে, কনকনে ঠান্ডায় বাসে বসে রাতটা কাটিয়ে পরদিন পায়ে হেঁটে ব্রিজ পার করে ছত্রুতে পৌঁছল। সেখানে দুই দিন দুই রাত বৃথা ব্যয় করে তৃতীয় দিনে স্পিতি থেকে আসা ফিরতি পথের এক ট্রাকে চেপে সবাই বাতালের পথে এগিয়ে গেল।
চন্দ্রা নদীর ধারে বাতালে সারা বছর একটি বুলডোজার রাখা থাকে যাতে শীতের সময়ে বরফে স্পিতির পথ বন্ধ না হয়ে যায়। তার তত্ত্বাবধানে সব সময় একজন সেখানে থাকে। তার ঘরের লাগোয়া আরও দুটি ঘর সেখানে ছিল পথচারী যাত্রীরা সেখানে আশ্রয় নিত।
পর্বতারোহী দলটিও সেখানে একরাত আশ্রয় নিয়ে পরদিন সকালে পদব্রজে পুরনো পরিত্যক্ত এক পুল ধরে চন্দ্রা নদী পার করে বড়া শিগরি হিমবাহের পথে রওনা হল।
মেয়েটির হিসাবমতো সেদিন ছিল দুর্গাষষ্ঠী, দেবীর বোধনের দিন। পিঠের ব্যাগে তার সকালের খাবার ও দুপুরের খাবার বাঁধা আছে। সুজয়া ও শিবানীকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যে করচা নালা সেটি পার করা হয়েছে। রোটাং পার করার পর এদিকের শুকনো, ঠান্ডা পাহাড়ে গাছপালা এমনিতেই জন্মায় না। এখানে উচ্চতার কারণে নদীর ধারেও কোনও গাছ নেই, শুধু এদিকে ওদিকে পাহাড়ের খাঁজে ছোট ছোট কয়েকটি গাছে নীল ও বেগুনি ফুল ফুটে আছে। মেয়েটি ভাবছিল কৈলাস থেকে বঙ্গভূমির পথে মা দুর্গার যাত্রাপথ তো সেখান দিয়েই হবার কথা। নদীর জলে হাত ধুয়ে পাশের পাহাড়ি ফুল তুলে সে আবাল্য উচ্চারিত পুষ্পাঞ্জলির মন্ত্রে সপরিবারে দুর্গাদেবীকে স্মরণ করে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করল। উপরে নীল আকাশ, ডানদিকে চন্দ্রা নদী বয়ে চলেছে। সামনে বরফে ঢাকা পাহাড়ে ধর্মাসুর শৃঙ্গ শোভা পাচ্ছে। এমন পরিবেশে নিজের উচ্চারিত মন্ত্রে সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে গেছে। পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে যে আনন্দ, যে তৃপ্তি সে সেদিন পেয়েছিল তার কোনও তুলনা নেই। সেখানে ছিল আকাশ, বাতাস, নদী, পাহাড়—সব জুড়ে মা দুর্গার উপস্থিতি।
সে সব দিন কত যুগ আগে পার হয়ে গেছে। এখন প্রতি বছর দুর্গাপুজো আসে যেন বয়সটা আরও একবছর করে বাড়ছে, শরীর অশক্ত হচ্ছে সেটা বুঝিয়ে দিতে। এখন সে বোঝে নিরাকার সেই বিশ্বব্যাপী শক্তিকে নিজের উপলব্ধিতে আনার জন্যই দেবীমূর্তির কল্পনা করা হয় ‘অজ্ঞানাং ভাবনার্থায় প্রতিমা পরিকল্পিতা।’ বোঝে পুজোর জন্য যেমন চতুঃষষ্ঠী উপাচার হয় তেমনই শুধু ‘ভক্তিতোয়াভ্যাম’, ভক্তি ভরে দেওয়া জল দিয়েও পুজো হয়। শৈশবের বাঙালি আখড়ার সেই ঠাকুর এখন অতীতের স্বপ্ন। ভিড় ঠেলে কলকাতার ঠাকুর দেখার ইচ্ছা ও ক্ষমতা এখন অস্তমিত। তবু বাড়ির সকলের, বিশেষ করে নাতি-নাতনির ভালো লাগা দেবী প্রতিমাগুলি সকালের দিকে ভিড় বাঁচিয়ে একদিন দেখে আসা হয়। পাড়ায় মহাষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলিও দেওয়া হয়। শুধু দশমীতে আর দেবীপ্রতিমা বরণ করা হয় না। উঁচু টেবিলে বা মইতে চড়ে প্রতিমা বরণ করার শক্তি ও সাহস কোনওটাই আর তার নেই।
এখন দুর্গাপুজোর সময়ে দূরদেশে চলে যাওয়া তার মেয়েটি প্রতিবছর আসে। মেয়েটি সেখানে স্বামীর ঘর করে, তবে পুজোর সময়ে কলকাতায় এলে তার সঙ্গে দেখা হয়। পুজোর কটা দিন এক অন্যরকম আনন্দে কাটে। দশমীর দিন সে এখন দেবী বরণ করে নিজের ঘরে। ঘরে বাঁধিয়ে রাখা পটের দুর্গাকে সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে মুখে মিষ্টি দিয়ে সে বরণ করে পতিগৃহে পাঠায়। তার বুকে থাকে কন্যা বিদায়ের কষ্ট, সঙ্গে থাকে প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসা এক প্রার্থনা। দেবীর কানের কাছে মুখ নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে এখন সে বলে—সামনের বছর আবার আসিস মা, আনন্দময়ী হয়ে আসিস, তোর এই বুড়ো মা-টা পথ চেয়ে থাকবে।