বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখা যাক। সশরীরে না এসেও অনলাইনে পুজোতে অংশ নেবার সুযোগ এতদিন ছিল অবশ্যই। কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল বড় বড় মন্দিরের ক্ষেত্রেই। যেমন তিরুমালা তিরুপতি মন্দিরে, কিংবা সিদ্ধিবিনায়ক গণপতি মন্দিরে। তার দিগন্ত এবার প্রসারিত হল কলকাতার প্রাণের উৎসব দুর্গা পুজোতেও। এইমাত্র। আইডিয়ার গ্লোবালাইজেশন তো এভাবেই হয়। জনগণের চাহিদা এবং সুবিধার সঙ্গে ব্যবসায়ের সুনিপুণ যোগসূত্রের মধ্য দিয়ে। কলকাতার পুজোর ক্ষেত্রে আপাতত এক প্রাইভেট কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় হয়েছে এর শুরু। এদের আকাশপাতায় দেওয়া হয়েছে এই অনলাইনে পুজো উপভোগের সুযোগ। আপাতত চুক্তি হয়েছে কলকাতার তিনটে বড় পুজোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে। অনলাইনে করা যাবে এই পুজোগুলির দর্শন, পুষ্পাঞ্জলি, এমনকী ডালা এবং প্রণামী দেবার ব্যবস্থাও। আকাশপাতায় এই দর্শন হবে বিনামূল্যে। দর্শন মানে কিন্তু সোজাসাপ্টা শুধুমাত্র প্রতিমা দেখাই নয়। সেখানে রয়েছে ক্যামেরা এবং টেকনোলজির উৎকর্ষের প্রতিশ্রুতি। বাজার অর্থনীতির এটাই শর্ত। আগামী দিনে এক্ষেত্রে তীব্র ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা আসা শুধু হয়তো সময়ের অপেক্ষা। যাই হোক, আকাশপাতায় পুষ্পাঞ্জলিও বিনামূল্যে। ডালা এবং প্রণামী দেওয়া যাবে কার্ডে বা ব্যাঙ্ক ট্রান্সফারের মাধ্যমে। শুধু মিষ্টি হলে ৫০১ টাকা, মিষ্টি আর ফল হলে ১০০১, আর তাতে শাড়ি, আলতা, সিঁদুর যোগ হলে ২১০০। ডালায় ফল, মিষ্টি, শাড়ি, সিঁদুরের সাথে উপভোক্তার নাম ও গোত্র জানাবার ব্যবস্থাও একেবারে পাকা। পুজো বলে কথা। ঠিক যেমনটা হয় আর কী। কলকাতার বাইরের কেউ অর্ডার দিলে ডালা পৌঁছে দেওয়া হবে কলকাতায় তার কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে।
প্রচেষ্টাটায় বেশ চমক আছে নিঃসন্দেহে। পুজোতে এই অনলাইন প্রক্সির ইতিবৃত্ত যে প্রবাসী এবং অনাবাসী বাঙালিদের কলকাতার পুজোর আওতায় আনার একটা প্রচেষ্টা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে একে প্রবাসী কিংবা অনাবাসীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে, তার কোনও বাধ্যবাধকতা অবশ্যই নেই। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে যাঁরা বৃদ্ধ, অসুস্থ, অশক্ত, ভিড়ভাট্টায় পুজো প্যান্ডেলে ঘুরতে অসমর্থ, তাঁরাও তো দিব্যি ভার্চুয়াল পুজোর শরিক হতে পারেন। আর শুধু যাঁরা অসমর্থ তাঁরাই বা কেন, যাঁরা ভিড়ের স্রোতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, তাঁরাও কেন নন? কে আটকাচ্ছে?
এটা প্রযুক্তির যুগ। প্রযুক্তি যে কতটা বিস্তৃত হয়েছে, এবং প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে চলেছে তার ডানা, তার হদিশ পাওয়াই মুশকিল। সত্যি বলতে কী, টেকনোলজির যা রমরমা, স্বশিক্ষার মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেমন দুর্বার গতিতে ছাপিয়ে নিয়ে চলেছে নিজেকেই, ভবিষ্যতে এই ভার্চুয়াল জগতের পুজোয় কী কী অবাক-করা অজানা বিপ্লব আসতে চলেছে, তা অনুমান করাও অসম্ভব। এমন হতেই পারে যে, ভার্চুয়াল জগতে আয়োজন হবে নানা ধরনের ভার্চুয়াল পুজোর। তাদের ঘিরে চলবে শিল্পিত সব প্রতিযোগিতাও। এভাবে সব মিলিয়ে এক স্বপ্নের আবেশ তৈরি হলেই বা ঠেকাচ্ছে কে! নানা ধরনের ভার্চুয়াল অ্যাডভেঞ্চার রিয়েলিটি গেমের রমরমা এখন। সেখানে সিমুলেটরের সাহায্যে ত্রিমাত্রিক জগতে এমন সব আবেশ তৈরি হয় যে, মনে হবে আমি আপনিই যেন বাস্তবে সেই সব অ্যাডভেঞ্চারের খেলোয়াড়। যেন কখনও পাহাড় এবং উপত্যকার মাঝখান দিয়ে পিছলে চলেছি আমি, কিংবা শূন্যে বা সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার বিপজ্জনক খেলায় মেতেছি। আজকের টেকনোলজিতে সম্ভব এ সবই। তাই সেভাবেই পুজোর কলকাতায় সশরীরে কয়েক লক্ষ লোকের শরিক হওয়ার আবেশ তৈরি করাও অবশ্যই সম্ভব। অনলাইনের পুজোর টেকনোলজিকে আরও বিস্তৃত করা যায় সহজেই। আনা যায় স্পেশাল এফেক্ট। যাতে মনে হবে লক্ষ লক্ষ লোকের সঙ্গে আলো-ঝলসানো পুজো প্যান্ডেলগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছি আমিও। এইসব টেকনোলজির ব্যবহার তাই আসতে পারে অচিরেই। ক্রমে এমন দিনও কি আসতে পারে যে, যত লোক বাস্তবে ঘুরে ঘুরে পুজো দেখবে তার চাইতে বেশি পুজো উপভোগ করবে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়? আমি হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলছি। এবং বড্ড তাড়াতাড়ি। তবে অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের নানা অ্যাপ নিয়ে নানা কোম্পানি ব্যবসায়ের প্রতিযোগিতায় নামবে, এটা একান্তই সম্ভব। আর তাই পুজো উপভোগ এবং সেই সঙ্গে পুজোর অর্থনীতিতেও নতুন নতুন মোড় আসবে, সেটাই বাস্তব। অদূর ভবিষ্যতেই পুজো উদ্যোক্তাদের পুজোর খরচ জোগানের একটা বিকল্প পথ খুলে যেতে পারে এইসব ভার্চুয়াল পুজোর উপভোগ এবং পুজো পরিক্রমার মধ্যও দিয়ে। টেকনোলজির হাত ধরে বদলায় সমাজ, পরিবর্তিত হয় তার জীবনধারার স্টাইল। আর সেই সঙ্গে বদলে যায় অর্থনীতির ছন্দ আর বিন্যাস। তার রূপরেখা আর দিক।
কল্পনাকে আর একটু বিস্তৃত করা যাক। ক্রমে এই অনলাইন প্রক্সির আওতায় কিন্তু আসতে পারে আরও অনেক কিছুই। ধরা যাক, আমার হাওয়াইয়ের সমুদ্র তীরে বসে হাওয়া খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সময়, সুযোগ, অর্থ, শারীরিক পরিস্থিতি, ইত্যাদি কোনও না কোনও কারণে যাওয়া অসম্ভব। কিন্তু অনলাইনে এমনই কোনও আকাশপাতায় গিয়ে ফিস্ অ্যান্ড চিপ্স খেতে খেতে সমুদ্রের ঢেউ গোনা তো এক চুটকিতেই করা সম্ভব। ভার্চুয়াল ট্যুরিজম তাই এখন সহজেই হাতের নাগালে। এবং ভার্চুয়ালি হাতের নাগালে আসতে পারে এমন আরও অনেক কিছুই।
আচ্ছা, সে যখন হবে তো দেখা যাবে। আপাতত অনলাইনে পুজোর স্তোত্রটুকু শোনা সম্ভব, এবং সেটা এই পুজোতেই, এটুকু অন্তত বোঝা গেল। অনলাইনে হাজিরা দেওয়া সম্ভব পুজো মণ্ডপে, দেখা সম্ভব আরতি, অঞ্জলি, দেওয়া যাবে প্রণামী বা পাওয়া যাবে প্রসাদ। শুরুতে এই বা কম কীসে?
তবু, আমরা যারা আগের প্রজন্মের ট্র্যাডিশনাল লোকজন, তাদের হৃদয়ের গোপন কোণে একটু কেমন কেমন ভাব থেকেই যায় এই অনলাইনের ভার্চুয়াল পুজোর ধামাকার মধ্যেও। ব্যাপারটা খুলেই বলি। কৈলাসেও খাসা ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চয়ই আছে, তা সে ৫জি হোক বা ৮জি। পুজোর সময় প্যাচপ্যাচে বৃষ্টির আশঙ্কা, বউবাজারে মেট্রোর ধস, যাদবপুরে শোরগোল, আর ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতির সম্মিলিত ফলশ্রুতিতে মা দুর্গা বা তাঁর সন্তান-সন্ততির কেউ, নিদেন অসুরটাও যদি এবার বলে বসে, ‘‘সেই কবে থেকে ফি-বছর পুজোর ভিড়ভাট্টায় গিয়ে গিয়ে বড্ড ক্লান্ত হয়ে গেছি। এবারে আর মর্ত্যে না হয় নাই গেলাম। ইন্টারনেটেই বরং হাজিরার প্রক্সিটা দিয়ে দেওয়া যাক। ভার্চুয়ালি।’’ তবে?