ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
গত ৪ অক্টোবর, ফেসবুক-স্ন্যাপচ্যাট-হোয়াটসঅ্যাপ-ইনস্টাগ্রামের হৃদস্পন্দন ঘণ্টা ছয়েকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। কোমাচ্ছন্ন সেই সময়টাতেই ফেসবুকের সীমাহীন দুর্নীতি-অমানবিক-অসামাজিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খোলার প্রস্তুতি সেরে ফেসবুকের মুখোশ টান মেরে খুলে দিতে আসরে নামলেন ফ্রান্সিস হগান, ফেসবুকেরই প্রোডাক্ট ম্যানেজার। তারপরেই ফেসবুকের বোতল-বন্দি কেলেঙ্কারির দৈত্যরা একে একে বাইরে এসে শুরু করল প্রেতনৃত্য। যেমন— মুদাসিসর রশিদ পারে, ফেসবুকের কল্যাণে জম্মু-কাশ্মীরের ‘ছোটা সৈনিক’। ৩১ আগস্ট, ২০১৮। উত্তর কাশ্মীরের হাজিনের মীর মোল্লা থেকে নিখোঁজ ১৫ বছরের ফুটফুটে প্রতিশ্রুতিমান ক্রিকেটার মুদাসিসর। বাড়ি থেকে বেরনোর সময় কাঁধে ছিল উইলোর ক্রিকেট ব্যাট। মুদাসিসর মাকে বলে গিয়েছিল পাশের মাঠেই বন্ধুদের সঙ্গে যাচ্ছে ক্রিকেট খেলতে। ৯৬ দিন কেটে গেল, মুদাসিসর বাড়ি ফিরল না। মা ফরিদা বেগম, দিনরাত আশপাশের প্রতিটা মহল্লায় হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন যদি কেউ তার মুদাসিসরের খোঁজ দিতে পারে। এক প্রতিবেশী বলল, মুদাসিসর আর সাকিবকে ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠ থেকে সে বেরতে দেখেছে। তারপর ভোজবাজির মতো কোথায় উবে গেল জলজ্যান্ত দুটো ছেলে?
৫ ডিসেম্বর, ফেসবুকে মুদাসিসরের একটি ছবি ভাইরাল হল। না কোনও ক্রিকেট ব্যাট হাতে নয়। বাঁ হাতে ধরা এ কে ফর্টিসেভেন আর ডান হাতে একটি বড়সড় ছোরা। শরীরে বিশেষ কিছু পরিবর্তন দেখা না গেলেও মা-র চোখে ধরা পড়ল সারাক্ষণ মুখে লেগে থাকা ফুলের মতো সরল নিষ্পাপ সেই হাসিটা উধাও। মা ফরিদা বেগমের বিলাপ, এ মুদাসিসর যেন ভিনগ্রহের মানুষ! মা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারেন না, ওইটুকুন ছোট্ট কাঁধ কী করে বিশাল অ্যাসল্ট রাইফেলের ভার বহন করছে! উত্তর না হয়ে দক্ষিণ কাশ্মীর হলে মুদাসিসর এতক্ষণে নায়কের মর্যাদা পেত। তার ছবি প্রতিটি সমবয়সির মোবাইল আলো করে থাকত। কিন্তু উত্তর কাশ্মীর তুলনায় শান্ত, উগ্রপন্থী উপদ্রব বিরহিত।
বন্দিপোরার পুলিস সুপার শেখ জুলফিকার আলি বহু চেষ্টা করেও ঘরছাড়া মুদাসিসর আর সাকিবকে তাদের বাবা-মার কাছে ফেরাতে পারেননি। যে তিনমাস তারা নিখোঁজ ছিল সেই তিনমাসে ক্রিকেট ব্যাট ছেড়ে তারা নিখুঁত লক্ষ্যে চাঁদমারি ভেদ করতে শিখেছে, শিখেছে গ্রেনেড ছুড়তে। শিখেছে ভারত নামক দেশটাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে। শিখেছে খাকি উর্দিকে গণশত্রু ভেবে চটপট নিকেশ করতে। আর শিখেছে জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করতে। মোক্ষ তাদের ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ-ইনস্টাগ্রামে কালাশনিকভ হাতে ‘হিরো’ হওয়া।
শ্রীনগর থেকে কিছুটা দূরে মুজগুন্দ। ২০১৮-এর ৯ ডিসেম্বর, শুরু হল সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অবিরাম গুলির লড়াই। টানা ১৮ ঘণ্টা গুলির লড়াই সমাপনে মারা পড়ল তিন জঙ্গি ও ৫ জওয়ান। দু’জন জঙ্গি ভারতীয়। একজন মুদাসিসর এবং অপরজন সাকিব। তৃতীয়জন পাকিস্তানি উগ্রপন্থী আলি। সামরিক বাহিনীর এক কর্তা বলেছিলেন টানা ১৮ ঘণ্টা ধরে তাদেরকে নাকি নাস্তানাবুদ করেছে নাক টিপলে দুধ বেরনো মুদাসিসর আর সাকিব। ক্রমাগত নিজেদের মধ্যে জায়গা অদলবদল করে তারা অবিশ্রাম গুলি চালিয়ে গিয়েছে। একটা বাড়ির ছাদ থেকে অনায়াসে লাফিয়ে আরেকটা বাড়ির ছাদে উঠেছে। লাফানোর আগে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দিয়ে গিয়েছে আগের বাড়িটাকে। এইভাবে ছ’টা বাড়িতে তারা অগ্নিসংযোগ করে। বাবা-মা, পরিবার থেকে পুলিস—কারওরই চেষ্টার খামতি ছিল না। প্রত্যেকেই আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মুদাসিসর আর সাকিবকে জাহান্নম থেকে জন্নতের রাস্তায় ফেরাতে। লাভ হয়নি কিছুই।
ফেসবুকের গরিমায়, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে এ কে ফর্টিসেভেন হাতে নায়ক বনতে গিয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে মুদাসিসর-সাকিবের মতো অগুনতি তরতাজা প্রাণ! কে তার হিসাব রাখে? কখনও ফেসবুকে সরাসরি বিজ্ঞাপন দিয়ে উগ্রপন্থী কাজকম্মে আত্মবলিদানের খোয়াব দেখানো হচ্ছে, কখনও বা এই সব সামাজিক মাধ্যমকে হাতিয়ার করে নানারকম ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কচি কচি ছেলেমেয়েগুলোর মাথা খাওয়া হচ্ছে। বহু মা-র কোল খালি হওয়ার পর একটিমাত্র শব্দ ‘ডেঞ্জারাস’ উচ্চারণে ফেসবুক তার দায় সারছে। অজুহাত হিসাবে খাড়া করছে, ফেসবুক তো একটা ‘প্ল্যাটফর্ম’, কেউ যদি তাকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম কী করবে!
১৫ বছরের ফুটফুটে মুদাসিসর সামরিক বাহিনীর গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়ার পর ঠিক একই সুভাষিত ফেসবুকের তরফে বরাদ্দ ছিল মুদাসিসরের কপালেও—‘ডেঞ্জারাস’। ফেসবুক ডিআইও বা ‘ডেঞ্জারাস ইন্ডিভিজুয়াল অ্যান্ড অর্গানাইজেশন’-এর এক সুবিস্তৃত তালিকা প্রস্তুত করেছে। তাতে ৪ হাজার ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত বিপজ্জনক বলে কালো-তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ‘ডিআইও’-র তালিকাভুক্ত কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ফেসবুকে কোনওরকম বার্তা বিনিময় নিষিদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্য (যথা— লেভান্ট-আরব দ্বীপপুঞ্জ-অ্যানাতোলিয়া-মিশর-ইরান-ইরাক) এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকেই ৮০ শতাংশ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ‘ডিআইও’র কালো তালিকাভুক্ত। ডিআইও-র তিনটি শ্রেণি রয়েছে। একেবারে প্রথমে, সর্বোচ্চ বিপজ্জনক স্তরেই জ্বলজ্বল করছে কাশ্মীরের ছোটা সৈনিক মুদাসিসরের নাম। ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম হাজিনের মুদাসিসরকে ‘ডেঞ্জারাস’ বানাল কে? নিঃসন্দেহে ফেসবুক। শুধু ‘ডেঞ্জারাস’ বানিয়েই ক্ষান্ত হল না ফেসবুক, বেনিতো মুসোলিনি ও জোসেফ গোয়েবেলসের মতো নরপিশাচদের সঙ্গে একাসনে ঠাঁই হল সুকুমারমতি মুদাসিসরের।
সাংবাদিক রায়না খালেক, গত জুলাই মাসে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরের পুরনো ধূলিমলিন একটি বিলবোর্ডের ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন।
ছবিটিতে এক ফ্রেমে বন্দি ইরানের জেনারেল কোয়াসিম সুলেমানি ও ইরাকের সামরিক বাহিনীর কমান্ডার আবু মাহদি আল-মুহানদিস। দু’জনই মার্কিন সেনাবাহিনীর হাতে খুন হন, দু’জনেই জীবদ্দশায় ফেসবুকের ‘ডিআইও’ লিস্ট আলো করে ছিলেন। দু’জনেই আমেরিকার ঘোরতর অপছন্দের। আমেরিকার বিরাগভাজন, না-পসন্দ মানে, অবশ্যই ফেসবুকের ‘ডেঞ্জারাস ইন্ডিভিজুয়াল অ্যান্ড অর্গানাইজেশন’-এ সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আসন পাকা।
ফেসবুক বড় গলায় বলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাতেই নাকি তারা একমাত্র বিশ্বাসী। ২০১৯-এ, একটি নামজাদা ইউনিভার্সিটির আলোচনাচক্রের সম্প্রচার মাঝপথে বন্ধ করে দেয় ফেসবুক। কারণ আলোচনাচক্রের মূল বক্তা ছিলেন প্যালেস্তাইনের শরণার্থী লীলা খালেদ। ১৯৬০ সালে দু’টি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় লীলা খালেদের নাম জড়িয়েছিল। সে যাত্রায় কেউ হতাহত হননি। ৭৭ বছরের খালেদ এখনও ফেসবুকের উগ্রপন্থী তালিকায় বহালতবিয়তে বিরাজমান এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আর সবার থাকলেও লীলা খালেদের নেই।
গত ফেব্রুয়ারিতে বামপন্থী কুর্দ নেতা আবদুল্লা ওসালানের দীর্ঘ কারাবাসের যৌক্তিকতা নিয়ে ফেসবুকের একটি পোস্টে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। মুহূর্তে পোস্টটিকে সরিয়ে দেয় ফেসবুক। কারণ ওসালানও যে আলো করে রয়েছেন ফেসবুকের ‘ডিআইও’ লিস্ট। অথচ তুরস্কের গোয়েন্দা বাহিনীর কতিপয় বাঘা সদস্যকে অপহরণ করার ষড়যন্ত্রে এই ওসালানকেই কাজে লাগিয়েছিল মার্কিন সরকার। তাহলে ফেসবুক কি আসলে মার্কিন সরকারের তাঁবেদার? একটু মনোযোগ সহকারে ফেসবুকের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ‘সিলিকন ভ্যালি’ নয়, মার্কিন ‘হেজিমনি’ বা আধিপত্যবাদের একমেবদ্বিতীয়ম তল্পিবাহক ফেসবুক। আর সেই আধিপত্যবাদকেই সারা বিশ্বে অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছে তারা। ফেসবুক যে সন্দেহভাজন উগ্রপন্থী বা জঙ্গি সংগঠনের তালিকা ‘ডিআইও’ তৈরি করেছে তার সিংহভাগের উৎস এসডিজিটি বা ‘স্পেশালি ডেজিগনেটেড গ্লোবাল টেররিস্টস’। জর্জ ডব্লিউ বুশের আমলে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট, এই তালিকাটি প্রস্তুত করে।
মজার ব্যাপার হল, ফেসবুকের অতি গোপন ও স্পর্শকাতর ‘ডিআইও’ লিস্টও কিন্তু খোয়া গিয়েছে। ‘দি ইন্টারসেপট’ ১০০ পাতার অতি-গোপন সেই তালিকা হাতে পেয়ে তা ছাপিয়েও দিয়েছে। ভারত থেকে সে তালিকায় রয়েছে আল আলম মিডিয়া, দাওয়াত-ই-হক, খলিস্তান টাইগার ফোর্স, খলিস্তান জিন্দাবাদ ফোর্স, সনাতন সংস্থা, দি রেনেসাঁ ফ্রন্ট প্রভৃতি। কিন্তু ২০১৮-এর মায়ানমার গণহত্যা! ফেসবুকের গোপন রিপোর্টে যাকে স্বীকার করা হয়েছে ঘৃণ্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা হিসাবে। রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা ‘জঙ্গি’দের খতম করতে মায়ানমার সামরিক বাহিনী ফেসবুককে হাতিয়ার করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গণহত্যায়। এক হাজার নিরপরাধ মানুষ সেই জাতি-দাঙ্গায় প্রাণ হারান এবং সাত লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে প্রাণে বাঁচেন। গোটা ঘটনায় মদতদাতা হিসাবে রাষ্ট্রসংঘ সরাসরি ফেসবুককেই দায়ী করে। ফেসবুকের অজুহাত, মায়ানমারে ইংরেজি বাদে ‘জাগি’ ফন্ট ফেসবুকে ব্যবহৃত হওয়ায় তাদের পক্ষে বোঝা সম্ভব হয়নি কি পরিমাণ সাম্প্রদায়িক ঘৃণা বা বিদ্বেষ তাদের অগোচরে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘জাগি’ ফন্টের দোহাই দিয়েও সে যাত্রায় ফেসবুক তার দেওয়াল থেকে রক্তের দাগ মুছে ফেলতে পারেনি।
রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও ফেসবুক
হন্ডুরাস-আজারবাইজান-ইকুয়েডর-বলিভিয়া-স্পেন-ভারত সর্বত্র অগুনতি জাল অ্যাকাউন্ট খুলে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে বিশেষ সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার নোংরা খেলায় কোমর-বেঁধে নেমেছিল এই সামাজিক মাধ্যম। হন্ডুরাসের প্রেসিডেন্ট উয়ান অরল্যান্ডো হেরনানডেজ একজন কুখ্যাত ড্রাগ মাফিয়া। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি ৬ সপ্তাহে হেরডানডেজের একটি ফেসবুক পোস্টে ৫৯ হাজার ১০০ লাইকের মধ্যে ৪৬ হাজার ৫০০টি লাইক ছিল ফেক বা জাল। একটি বিশেষ অ্যালগরিদমের সাহায্যে লাইকের সংখ্যা কায়েমিস্বার্থে ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়েছিল স্বয়ং ফেসবুকই। হেরনানডেজ ও তার ভাই—দু’জনেই ফেডারেল কোর্টে বেআইনি ড্রাগ পাচারের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত। কিন্তু মার্কিন পুলিস তাঁদের জামাইআদরে রেখেছে। মধ্য আমেরিকায় হেরনানডেজের থেকে বড় সুহৃদ আমেরিকার আর কে আছে? রাজনৈতিক ডিভিডেন্ডের স্বার্থে, বেআইনিভাবে নিজের পকেট ভরাতে ফেসবুক হয়তো বা জাল জুয়াচুরি করেছে কিন্তু কোভিড নিয়েও জালিয়াতি? স্পেনে ৬ লক্ষ ৭২ হাজার ফেক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অনবরত কোভিড সম্পর্কিত অবৈজ্ঞানিক মিথ্যা গুজব পরিবেশন করে গিয়েছিল ফেসবুক, স্রেফ স্পেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর গদি নিষ্কণ্টক রাখতে।
সমস্ত কিছুই প্রকাশ্যে আসে ফেসবুকের ডেটা সায়েন্টিস্ট সোফি জং-এর কল্যাণে। ৬৪ হাজার ডলারের অর্ঘ্য নিবেদনে সোফির মুখ বন্ধ করতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয় না। চাকরিও যায় সোফির। ২০২০-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক দলের মতাদর্শে ধুয়ো তুলে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর নির্লজ্জ অভিসন্ধি ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ হাতেনাতে ধরে ফাঁস করে দেয়। তারপরেও সংবিৎ ফেরে না ফেসবুকের।
অ্যামাজন বেচে দিল ফেসবুক
ফেসবুক রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে বেচে দিচ্ছে অ্যামাজনের সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা রেইনফরেস্ট। ২০১৯-এর মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় উঠে এসেছে এই ভয়ঙ্কর তথ্য। ইউরোপে মাত্র ২ শতাংশ মাংসের জোগান বাড়াতে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে অ্যামাজনের ৬২ শতাংশ জঙ্গল নির্বিচারে কেটে সয়া-চাষের সুজলাং-সুফলাং তৃণভূমি বানিয়ে ফেলা হয়েছে। বেআইনিভাবে, অরণ্য ধ্বংস করে ব্রাজিলে ২০ শতাংশ সয়াবিন আর ১৭ শতাংশ গো-মাংস ইউরোপে রপ্তানি করা হচ্ছে। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডে’র মতে, ২০১৬-’১৮-এর মধ্যে স্রেফ গোখাদ্যের অভূতপূর্ব চাহিদা মেটাতেই ‘ওয়েলসের’ আয়তনের সুবিশাল বনভূমি অ্যামাজনের বুক থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। বহির্বিশ্বের চোখে ধুলো দিতে গল্প ফাঁদা হচ্ছে দাবানলের। ‘দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব স্পেস রিসার্চ’-এর কড়া নজরদারিতে ধরা পড়েছে ২০১৯ সালে ৭ হাজার ৮৫৫টি পরিকল্পিত মনুষ্যকৃত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ছারখার হয়েছে অ্যামাজনের চিরহরিৎ বনাঞ্চল। কিমাশ্চার্যম, ২০২০-তে সেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই একলাফে বেড়ে হল ১৭ হাজার ৩২৫টি। চক্ষুলজ্জার খাতিরে ব্রাজিল সরকার, ন্যাড়াপোড়ায় ১২০ দিনের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। অথচ ‘পান্টালান’ অঞ্চলে ২০২০-এর অক্টোবরে, নিষেধাজ্ঞা বলবত থাকাকালীনই ২ হাজার ৮৫৬টি খাণ্ডবদাহনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে। বিগত ৩০ বছরের ইতিহাসে যা সর্বকালীন রেকর্ড। অক্টোবর, অ্যামাজনে বর্ষণমুখর মাস। সেইসময়টাতেই রেকর্ড অগ্নিকাণ্ড! ঘোড়া হাসি নয়, অট্টহাসি করছে; ব্রাজিল সরকারের ১২০ দিনের ফেরেববাজি নিষেধাজ্ঞায়। বিশ্বের সেরা জৈব-বৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চল ‘পান্টালান’, জাগুয়ার আর কাপাচিন বা সাদা-মুখো বাঁদরদের প্রাকৃতিক বিচরণভূমি। শুধু ‘পান্টালান’ নয়, বিশ্বের প্রতি ১০টি প্রজাতির একটির জনক, অ্যামাজন।
অ্যামাজনের, এক হাজারটি ফুটবল মাঠের সমতুল বনাঞ্চল ফেসবুক বিক্রি করে দিয়েছে রীতিমতো শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন দিয়ে। লুকোনো ক্যামেরায় ধরা পড়েছে কীভাবে জমির দালাল ফ্যাব্রিসিও গুইমারেজ, কোনও পরচা বা জমি সংক্রান্ত আইনি দলিল দস্তাবেজ ছাড়াই বিঘের পর বিঘে অ্যামাজনীয় জমি পশ্চিমী ধনকুবেরদের কাছে অবলীলায় বিক্রি করে দিচ্ছে। এক-একটি প্লটের বিক্রয়মূল্য ৩৫ হাজার ডলার। প্রথমে আগুন লাগিয়ে বিরাট বনাঞ্চল পুড়িয়ে খাক করে সমতলভূমি বানিয়ে ফেলা হচ্ছে, কিছুদিন পর সেই পোড়ো জমি বৃষ্টির জল পেয়ে উর্বরা হলে শুরু হচ্ছে সয়াবিন চাষ, নিদেন ঘাসজাতীয় তৃণের চাষ। ঊর্ধ্বে উঁচায়ে মাথা যত আদিম মহাদ্রুমদের প্রতিস্থাপিত করে ঘন-জঙ্গল রাতারাতি পরিণত হচ্ছে গোচারণভূমিতে।
অ্যামাজনে সবচেয়ে বেশি বৃক্ষ-নিধন হয়েছে রনডোনিয়া নামক রাজ্যটিতে। সভ্যতার আলোকবর্ষ দূরের ‘উরু-ইয়ু-ওয়া-ওয়া’ নামক বিপন্ন উপজাতির মাত্র ২০০ জন মানুষের বাস রনডোনিয়াতে। আদিম জনজাতির সেই জনপদ রনডোনিয়ার ছোট্ট এক ফালি জমি ফেসবুকের কল্যাণে বিক্রি হয়েছে ১৬ হাজার ৪০০ পাউন্ডে। রাজনীতিবিদদের ঘুষ দিয়ে প্রথমে জমির সংরক্ষিত চরিত্রের তকমা ঘোচানো হচ্ছে। তারপর সরকারি সিলমোহর লাগিয়ে পিলে চমকানো দামে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে, বিশ্বের ফুসফুস, অ্যামাজনের নিষ্পাপ শান্ত-সবুজ ভূখণ্ডকে।
ইনস্টাগ্রাম ও কিশোরী মেয়ের সর্বনাশ
গত মার্চে জুকেরবার্গ সদর্পে ঘোষণা করলেন জনমানসে সমাজমাধ্যমের ভূমিকা নাকি খুবই ইতিবাচক। মানুষকে আনন্দে রাখতে সমাজমাধ্যমের নেই কোনও বিকল্প। ইনস্টাগ্রামের মালিকানা, ফেসবুক লাভ করে ২০১২-তে। ২০১৯ থেকে ইনস্টাগ্রামের কিছু আধিকারিক কমবয়সিদের মনের ওপর ইনস্টাগ্রামের প্রভাব (সু অথবা কু) সম্পর্কে গোপনে একটি সমীক্ষা শুরু করেন। সেই সমীক্ষায় ধরা পড়ে কমবয়সি, বিশেষত: বয়ঃসন্ধির মেয়েদের ওপর ইনস্টাগ্রামের প্রভাব অত্যন্ত খারাপ এবং সুদূরপ্রসারী। গবেষণায় উঠে আসে প্রতি তিনটি কমবয়সি মেয়ের একজন, ইনস্টাগ্রামের দৌলতে নিজের শরীরের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে উঠছে। ঘৃণা করছে নিজের শরীরকে। ইনস্টাগ্রাম তাদের শরীরকে এতটাই কুৎসিতভাবে উপস্থাপিত করছে যে তারা ক্রমশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। গোপন গবেষণা রইল না গোপন। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে, গবেষণার একটি স্লাইড প্রকাশিত হতেই সারা বিশ্বে তুমুল শোরগোল পড়ে গেল।
মার্চ ২০২০-এর সেই স্লাইডটিতে ৩২ শতাংশ বয়ঃসন্ধির মেয়ে বলছে তারা যখন তাদের শরীর নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগছে, ইনস্টাগ্রাম তাদের শারীরিক হীনম্মন্যতায় সুড়সুড়ি দিয়ে তাদের বিপন্নতা আরও বাড়িয়ে তুলছে। আরেকটা স্লাইড দেখাচ্ছে, কমবয়সি মেয়েরা তাদের উদ্বেগ ও অবসন্নতার জন্য সরাসরি ইনস্টাগ্রামকেই দায়ী করছে। শুধুমাত্র ব্যবসা বাড়ানোর ফিকিরে ইনস্টাগ্রাম সব জেনে-বুঝেও চুপ করে ছিল বা আছে। কমবয়সি মেয়েরা শুধু যে তাদের শরীর সম্পর্কেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে অবসন্নতার শিকার হচ্ছে তা নয়, তাদের আত্মসম্মানবোধ তলানিতে ঠেকছে, অ্যানোরেক্সিয়ার মতো জটিল রোগের খপ্পরে পড়ে খাওয়াদাওয়া ভুলে তারা কেবল তন্বী ও আরও সুন্দরী হওয়ার উদগ্র বাসনায় তনু দেহমন সঁপে দিচ্ছে। ইংল্যান্ডের ১৩ শতাংশ আর আমেরিকার ৬ শতাংশ মেয়ে ইনস্টাগ্রামের কারণে আত্মহত্যার কথাও ভেবেছে বেশ কয়েকবার।
৪০ শতাংশ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারী কমবয়সি মেয়ে নিজেদেরকে পাতে দেবার মতো বলেই মনে করে না। এতটাই অনাকর্ষণীয়, আবেদনহীন তারা! ইয়ং মাইন্ডস এবং রয়েল সোসাইটি ফর পাবলিক হেলথের যৌথ একটি গবেষণা দেখাচ্ছে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম-হোয়াটসঅ্যাপ কমবয়সিদের মানসিক রোগের মহামারী ডেকে আনছে। দুর্নিবার নেশায়, একটা লাইক, দুটো শেয়ার থেকে শুরু করে কমবয়সি মেয়েরা নাওয়াখাওয়া ভুলে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামকে বুকে আঁকড়ে বসে থাকছে দিনভর। নিখুঁত থেকে নিখুঁততর হতে গিয়ে দৈহিক সৌন্দর্যের শ্রীবৃদ্ধির গগনচুম্বী বাসনায় তারা মানসিক রোগের শিকার হয়ে পড়ছে। পোশাক-প্রসাধনী আর দেহসৌষ্ঠব বৃদ্ধিকারী পণ্যের বাজার ফুলে ফেঁপে উঠছে। নিষ্পাপ-অপরিণামদর্শী-অপরিণতমনস্ক একটি মেয়ের সারল্য আর অসহায়তাকে পুঁজি করে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম কোটি কোটি টাকা আয় করছে। কচি কচি মেয়েগুলোকে বাবা-মা, পরিবার-পরিজন, বন্ধুবান্ধব থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিঃসঙ্গতার ঘনান্ধকার সুড়ঙ্গে নির্বাসিত করছে। গোটা বিশ্ব চোখে ঠুলি পরে প্রত্যক্ষ করছে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের রাঙা আলোয় নিজের সন্তান-সন্ততির চরম সর্বনাশ। চুলোয় যাচ্ছে শিশু বা কমবয়সিদের সুস্থতা, নিরাপত্তা এবং সুখে শান্তিতে বেঁচে থাকার সংবিধান প্রদত্ত অধিকার।
ফেসবুকের ভূতপূর্ব প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শন পার্কার বলছেন, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম ফোঁটা ফোঁটা ‘ডোপামিন’ ঢালছে, কচি কচি মাথাগুলো নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। লাইক-শেয়ার-কমেন্টের চক্করে কলুর বলদের মতো ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে গোটা মনুষ্যসমাজ। যত দিন যাবে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম তত জনপ্রিয় হবে। টাকার ঝনঝনানিতে উপচে উঠবে ফেসবুকের ভাঁড়ার। কিন্তু ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর মগজ ধোলাইয়ের পর কী দশা দাঁড়াবে একমাত্র ভগবানই তা জানেন!
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস