ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
বৈদিক সাহিত্যের যে শক্তিদেবীকে দুর্গা জ্ঞানে আমরা পূজা করি, তন্ত্র ও পুরাণে তাঁর বিশেষ বিবরণ ও পূজা-পদ্ধতির উল্লেখ আছে। এ দেবী যেমন মহিষমর্দিনী, শূলিনী, জয়দুর্গা, বনদুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী ইত্যাদি নানা নামে পূজিতা হন। এঁদের আকৃতিতেও ভিন্নতা আছে অনেক। বাংলায় প্রচলিত পৌরাণিক পদ্ধতি অনুসারে ইনি অতসীপুষ্পবর্ণকা, দশভুজা, জটাজুট সমাযুক্তা। অর্ধচন্দ্র এঁর শিরোভূষণ। দেবীর পাদদেশে ছিন্নমস্তক মহিষ। মহিষের দেহ থেকে খড়্গ হাতে বেরিয়ে এসেছে যে দানব, তাকে বিদ্ধ করেছে দেবীর শূল। দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে, আর বাঁ পায়ের আঙুল, একটু ওপরে মহিষের দেহ ছুঁয়েছে। অষ্টশক্তি ও দেবগণ ঘিরে আছেন দেবীকে। তাঁর দু’পাশে কার্তিক-গণেশ এবং লক্ষ্মী-সরস্বতী, কিংবা কোথাও এঁদের পরিবর্তে জয়া-বিজয়ার যে মূর্তি দেখা যায়, তার বিধান আছে কালীবিলাস তন্ত্রে।
তন্ত্রসার মতে, দেবী দুর্গা চতুর্ভুজা। প্রাচীন গ্রন্থ দেবী ভাগবত পুরাণ অনুসারে দেবীর বাহুসংখ্যা ১৮। কিংবদন্তি পুরাণ মতে ১৬, বরাহ পুরাণ মতে ২০, দেখা গেল, রামায়নেও ইনি চতুর্ভুজা। দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনীতে আবার অষ্ট ও চতুর্ভুজা।
বাংলার প্রায় সর্বত্রই দেবী ত্রিনয়নী এবং দশভুজা হলেও, কোথাও কোথাও আজও ব্যতিক্রমী মূর্তি চোখে পড়ে।
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার পিংলার অদূরে ভাসানপুকুর গ্রাম। গ্রামের তিনটি পারিবারিক দুর্গোৎসবের বিগ্রহই দ্বিভুজা। সেখানকার পাল বাড়ির দুর্গা প্রতিমার রূপ বাংলার চিরকালীন শ্যামস্নিগ্ধ বঙ্গলক্ষ্মীর। অভয়া এই দেবীর হাতে কোনও অস্ত্র নেই, আছে বরাভয়ের আশ্বাস। প্রায় পাঁচশো বছর আগে জনৈক কৃপারাম পাল হুগলি থেকে সেখানে গিয়ে বসতবাড়ি তৈরি করেন। তিনিই এই অভয়া দেবীমূর্তির প্রতিষ্ঠা করেন। দ্বিভুজা এই দুর্গাপুজোর বৈশিষ্ট্য হল, ষষ্ঠী থেকে দশমীর দিন পর্যন্ত চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের বণিকখণ্ড গান করা হয়।
ভাসানপুকুরের জিতনরাম পাল এবং কালীতলার লালপাকাতে চৌধুরী বাড়ির দুর্গা প্রতিমাও দ্বিভুজা। এই তিন দ্বিভুজা দুর্গাকে মহাকালী, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতীরই ত্রিবিধ রূপের বহিঃপ্রকাশ বলে অনেকে মনে করেন।
হুগলি জেলার বলাগড় থানার অধীনস্থ একটি গ্রাম সোমড়া। গ্রামের নামেই স্থানীয় রেল স্টেশনের নাম সোমড়া বাজার। ব্যান্ডেল-কাটোয়া লাইনের এই স্টেশন থেকে কয়েক কদম হেঁটে গেলেই চোখে পড়বে সেন পরিবারের পুরনো অট্টালিকা। এ বাড়ির দুর্গাপুজোয় মায়ের ত্রিভুজা মূর্তি দর্শন করা যায়। তাঁর ওপরের ডান হাতে জ্বলে খড়্গ, নীচের ডান হাতে ঝলকায় ত্রিশূল। দেবীর বাঁ হাতের মুঠোয় একই সঙ্গে ধরা থাকে অসুরের কেশ আর সাপ।
কিছু ইতিহাসও মেলে এই পারিবারিক দুর্গোৎসবের। বংশের পূর্বপুরুষ রাজা রামচন্দ্র সেন ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট মহম্মদ শা’র কাছ থেকে ‘রায়রাহান’ উপাধি পেয়েছিলেন। দেবদ্বিজে তাঁর প্রগাঢ় ভক্তি ছিল। সারা বছর ধরেই গৃহদেবতা হিসেবে পূজিত হতেন লক্ষ্মীনারায়ণ শ্রীধরনারায়ণ, পার্বতী, মহাদেব, মনসা, ষষ্ঠী, মঙ্গলচণ্ডীর মতো অনেক দেবতাই। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে রাজা রামচন্দ্র সেন তাঁদের পারিবারিক দুর্গোৎসবের প্রচলন করেন। মায়ের পুজোর জন্য তিনি কাঠের অপূর্ব কারুকার্য খচিত দুর্গাদালান তৈরি করিয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর জীবদ্দশাতেই কোনও এক বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় বর্গিরা এসে সেই দুর্গাদালানটি ধ্বংস করে দিয়ে চলে যায়। রাজ পরিবারের সবাই তখন দেবীমূর্তি নিয়ে গঙ্গায় বিসর্জন দিতে গিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে নতুন করে দুর্গাদালান তৈরি হয়। তবে যে মাটির বেদীতে রাজা মূর্তি স্থাপন করেছিলেন, আজও সেখানেই মা বিরাজ করেন। পুজোর সময় দুর্গাদালানে সাজিয়ে রাখা হয় গৃহদেবতাদের।
এই ত্রিভুজা দুর্গাপুজোয় ফল বলি দেওয়া হয়। দুর্গাদালানের সামনের প্রাঙ্গণে একটি মাটির স্তম্ভে কর্মকার বলিদান করেন।
অভিনব আর একটি দুর্গাপুজোর কথা উল্লেখ্য। হুগলি জেলার বলাগড়ের পাটুলিতে কয়েকশো বছর ধরে ব্যতিক্রমী এক দ্বিভুজা দুর্গা পূজিতা হয়ে আসছেন। সেখানে দেবী ‘মঠের মা’ নামেই পরিচিত। পুজোটি মঠবাড়ির বলেই এর নাম। প্রাচীনকালে সেখানে একটি বৌদ্ধমঠ ছিল। পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়ের দরুন বহু বৌদ্ধ দেব-দেবী হিন্দুদের লৌকিক দেব-দেবীতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। সমাজ-সংস্কৃতি বিজ্ঞানী বিনয় ঘোষের লেখা থেকে জানা যায়, ‘এই মঠবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এক বৌদ্ধ তান্ত্রিক। আজও মঠবাড়ির পুজোয় দেখা যায় বৌদ্ধ তন্ত্রাচারের বিবর্তিত রূপ।’
এ পুজোর প্রচলন নিয়ে অন্য কাহিনিও আছে। খ্যাতনামা পণ্ডিত মদনমোহন তর্কালঙ্কার নদীয়ার মহারাজার কাছ থেকে ‘আয়মা পাটুলি’ গ্রামটি লাভ করেন। সেখানে তিনি বসবাসও শুরু করেন এবং একসময় বৌদ্ধ তান্ত্রিক প্রভাবযুক্ত এই দেবী পুজোর প্রচলন করেন।
মঠের মা’র প্রতিমা নিমার্ণের কাজ শুরু হয় জন্মাষ্টমীর দিন, কাঠামো পুজোর মধ্যে দিয়ে। মূর্তি নির্মাণ করেন বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পীরা। এই মা দুর্গার মূর্তিটির বৈশিষ্ট্য হল—দেবী দশভুজা হলেও তাঁর সামনের হাত দুটিই কেবল দেখা যায়। বাকি আটটি হাত আঙুলের মতো। সেগুলি চুল দিয়ে ঢাকা থাকে। ডাকের সাজের এই প্রতিমার গায়ের রং শিউলি ফুলের বোঁটার মতো। তাঁর চোখ দুটি বাঁশপাতার মতো টানা টানা। দেবীর ডানদিকে কার্তিক, বাঁ দিকে গণেশ। তাঁর বাহন, পৌরাণিক সিংহটি।
বৌদ্ধ তান্ত্রিক কিছু আচার-অনুষ্ঠান আজও এ পুজোয় রয়ে গিয়েছে। অতীতে মাঝরাতে সেখানে নরবলি হতো এবং বলিপ্রদত্ত মানুষটি নাকি স্বেচ্ছায় আসতেন। ইংরেজ আমলে নরবলি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে এ প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। তারপর চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি নরমূর্তি বলি দেওয়া হতো। পাঁঠাবলিও হতো। পাঁঠার মাংসের সঙ্গে মাসকলাই ও দূর্বা দিয়ে তা চৌষট্টি যোগিনীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হতো। বর্তমানে পশুবলি না হলেও, চালগুঁড়োর নরমূর্তি বলির পর একইভাবে দেবীকে নিবেদন করা হয়।
অতীতে তালপাতার পুঁথি দেখে পুজো হতো। প্রতিবছর দশ-বারো জন বাহক বিসর্জনের দিন প্রতিমা কাঁধে করে গঙ্গার দিকে নিয়ে যান। পথে কয়েক জায়গায় প্রতিমা নামানো হয়। স্থানীয় গৃহবধূরা তখন দেবীকে আলতা, সিঁদুর পরিয়ে বিদায় জানান। সাবেক রীতি মেনে এখনও নৌকোয় প্রতিমা বসিয়ে মাঝ গঙ্গায় নিয়ে গিয়ে দেবীকে বিসর্জন দেওয়া হয়।
নদীয়া জেলার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকের পাবাখালি গ্রামে রায়চৌধুরী পরিবারের দুর্গোৎসব তিনশো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। এ পুজোর সূচনা মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের পৃষ্ঠপোষকতায়। তিনিই তৎকালীন বাংলার যশোরের মহেশপুরের জমিদার ‘বড় সরকার’কে ‘রায়চৌধুরী’ উপাধি দিয়েছিলেন। সেই আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে জমিদার আয়োজন করেছিলেন দুর্গোৎসবের। দেশভাগের পর রায় চৌধুরী পরিবার নদীয়ার পাবাখালি গ্রামে চলে এলেও দুর্গাপুজো বন্ধ হয়নি। মহেশপুর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরের পাবাখালিও ছিল তাঁদের জমিদারিরই অংশ। ১৯৪৯ সাল থেকে ওই পাবাখালিতেই রায়চৌধুরি পরিবারের দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এই দেবী প্রতিমা দ্বিভুজা হিসেবেই খ্যাত হলেও আসলে কিন্তু দশভুজা। সামনে থেকে তাঁকে দ্বিভুজাই মনে হয়, বাকি আটটি হাত ঢাকা পড়ে যায় দেবীর চুলের আড়ালে। দেবীর ডান হাতে ত্রিশূল আর বাঁ-হাতে সাপের লেজ। প্রতিমার মাথার ওপর চালচিত্রের বদলে তাঁকে তৃতীয়ার চাঁদের মতো চালি। সাবেককালের রীতি মেনে সন্ধিপুজোর সময় এখনও শূন্যে গুলি ছোড়া হয়।
এখানকার পুজোর পদ্ধতি এবং ভোগের বৈশিষ্ট্য আছে। ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত দেবীকে চারবার ভোগ নিবেদন করা হয়। সকালে পাঁচরকম ভাজা বা পঞ্চব্যঞ্জন দিয়ে খিচুড়ি ভোগ এবং দুপুরে মাসকলাইয়ের ডাল আর নানারকম তরকারি দিয়ে অন্নভোগ দেওয়া হয়। বিকেলে দেওয়া হয় পায়েস ভোগ। সন্ধ্যারতির পর লুচি, সন্দেশ, মোয়া আর নাড়ু দিয়ে ভোগ দেওয়া হয়। দশমীতে দেবীকে দেওয়া হয় পান্তা ভোগ আর মহাদেবকে তামাক ভোগ। শাক্ত আচার অনুসরণ করে এককালে পুজোয় মোষ বলি হতো। জমিদার শিবপ্রসাদ রায়চৌধুরীর আমলে কোনও অজ্ঞাত কারণে বলিদান প্রথা বন্ধ হয়ে যায়।
পারিবারিক এই দুর্গাপূজার বিশেষ কিছু রীতি-পদ্ধতি আছে। পয়লা বৈশাখ ভগবতী যাত্রার দিনে প্রতিমার পাট (কাষ্ঠাসন) পুজো এবং রথের দিন প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ষষ্ঠীতে দেবীর বোধনের সময় হোমের আগুন জ্বালানো হয়, চলে দশমীর পুজোর শেষ পর্যন্ত। চণ্ডীমণ্ডপে জ্বালিয়ে রাখা একটি মোমবাতির সঙ্কেত অনুসরণ করে অষ্টমীর সন্ধিপুজো হয়। পুজোর চারদিনই চণ্ডীপাঠ এবং দশমীতে ‘যাত্রা মঙ্গল’ রায়চৌধুরী বাড়ির দুর্গাপুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দেবী প্রতিমার বিসর্জন হয় চূর্ণি নদীতে।
মুর্শিদাবাদের কান্দির খড়গ্রাম থানার অন্তর্গত বালিয়া গ্রামে সিংহ বাড়ির দুর্গা প্রতিমাও চতুর্ভুজা। ওই গ্রামের ধর্মপ্রাণ মানুষ বৈকুণ্ঠ নারায়ণ সিং ছিলেন নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের নায়েব। উমার স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি চতুর্ভুজা দুর্গার পুজো শুরু করেন। কানা ময়ূরাক্ষী নদী তীরের বালিয়া গ্রামটি আজ ওই চার হাতের দুর্গার জন্যই বিখ্যাত। প্রায় চারশো বছর ধরে সেই সাবেকি প্রতিমাই গড়া হয়ে আসছে। পুজোও হয়ে থাকে পুরনো আচার পদ্ধতি মেনে, বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে। ৭০-৮০ বছর আগেও ওই পুজোয় তিনটি ছাগল বলি দেওয়া হতো। বলিদান প্রথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক রাজবাড়ির দুর্গ ছিল বহিচবেড় গড়। সেখানে রাজাদের কুলদেবতা রাধাবল্লভ জিউয়ের সঙ্গে নিত্য পূজা হতো চতুভুর্জা দেবী দুর্গারও। তমলুক শহরের রাজবাড়ি থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে নন্দকুমারের বহিচবেড় গড়ে সেই পুজোয় আজও ছেদ পড়েনি। আছে দেবী চতুর্ভুজার মন্দিরও। প্রায় তিনশো বছরের প্রাচীন এই দুর্গাপুজো হয় বৈষ্ণব মতে। আগেকার রীতি মতো এখনও সপ্তমীর দিন নবপত্রিকাকে স্নান করিয়ে গৃহপ্রবেশ করানো হয়। রাজ পরিবারের প্রতীক হিসেবে দেবীর সামনে রাখা হয় একটি তরবারি। আগে ষষ্ঠীর দিন দেবীর বোধনের আগে কামান দাগা হতো। দেবীর ভোগ দেওয়া হতো একমন চালের। এখন আর সে সব হয় না। আগে সেখানে যে মেলা বসত, সে মেলাও চলে গিয়েছে দূরে।
প্রসঙ্গত, বাংলায় দেবীর যে মূর্তিটি আমরা সাধারণত দেখে থাকি, সেখানে তাঁর অধিষ্ঠান সপরিবারে। মধ্যস্থলে দেবী সিংহবাহিনী এবং অসুরদলনী রূপে তাঁর মুকুটে দেবাদিদেবের মুখ শোভিত। দেবীর ডানপাশে ওপরে লক্ষ্মী, নীচে গণেশ। বাঁ পাশে ওপরে সরস্বতী, নীচে কার্তিক। কলকাতায় ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে সাবর্ণ রায়চৌধুরি পরিবার এমনই দুর্গা প্রতিমার প্রচলন করেন। তাই ধরে নেওয়া হয়, এটিই দেবীর সাবেকি রূপ।
পুরুলিয়া জেলার জয়পুর রাজবাড়ির দুর্গাপুজোর অন্যতম আকর্ষণ সোনার তৈরি দ্বিভুজা দুর্গামূর্তি এবং রুপোর তৈরি চালচিত্র। ইতিহাস উঁকি দিচ্ছে এখানেও।
ষোলোশো খ্রিস্টাব্দে উজ্জয়িনী থেকে পুরুলিয়ার এই জঙ্গলমহলে এসেছিলেন জয়সিংহ। স্থানীয় সর্দার খামার মুণ্ডাকে হত্যা করে তিনি সেখানকার রাজা হন। তাঁর নামেই জায়গাটির নাম হয় জয়পুর। খামার মুণ্ডা একটি খাঁড়াকে পুজো করতেন ইষ্টদেবী জ্ঞানে। রাজা জয়সিংহ সেই খাঁড়াটি মুণ্ডাদের বসতি থেকে এনে শক্তির দেবী হিসেবে কলাবউ রূপে পুজোর রীতি প্রচলন করেন। বহু বছর পর সপ্তম রাজা কাশীনাথ সিংহের আমলে এক অগ্নিকাণ্ডে কলা বউ পুড়ে গেলে রাজা নতুন প্রতিমা গড়ার মানত করেন। সেইমতো বেনারস থেকে শিল্পী আনিয়ে তিনি এক কিলোগ্রাম ওজনের সোনার দুর্গামূর্তি এবং ষাট কিলো রুপোর একটি চালচিত্র তৈরি করান। আজও সেই মূর্তিই পূজিতা হন। তবে ১৯৭০ সালে রাজবাড়িতে ডাকাতরা মূল্যবান কিছু সামগ্রী লুঠ করে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে পুজো শেষ হলে সোনার বিগ্রহটি দশমীর দিনে ব্যাঙ্কের লকারে রাখা হয়। পুজোর পাঁচদিন রাজবাড়িতে বিশেষ পুলিসি প্রহরা থাকে।
পুরনো রীতি মেনে শালকাঠের কাঠামোয় তৈরি হয় মা দুর্গার প্রতিমা আর মাটি আসে বাংলাদেশ থেকে। ১০৮ বছরের পুরনো এই দুর্গাপুজো হয় আলিপুরদুয়ারের চৌধুরি পরিবারে। কাঁঠালতলার এই প্রতিমার নির্মাণপর্ব সম্পন্ন হয় বাড়ির মন্দিরেই। বিসর্জনও হয় বাড়ির পুকুরেই। সেখানকার পুজোর বৈশিষ্ট্য হল উমার অধিবাসে গণ্ডারের খড়্গ ও শুয়োরের দাঁতসহ বাইশটি সামগ্রী দেওয়া হয়। দেবী দুর্গার সঙ্গে কালী, শীতলা, ব্রহ্মা ও গঙ্গার পুজো করা হয়।
ঝাড়গ্রামের প্রায় সাড়ে চারশো বছরের পুরনো সামন্ত রাজাদের কনকদুর্গা অষ্টধাতু নির্মিত। তিনি অশ্বারূঢ়া, চতুর্ভুজা। ইতিহাস বলে, চিল্কিগড়ের রাজা গোপীনাথ সিংহ তৈরি করিয়েছিলেন কনকদুর্গার মন্দির। জনশ্রুতি, স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি স্ত্রী হাতের কাঁকন দিয়ে দেবীমূর্তি তৈরি করিয়েছিলেন। আগে নাকি নরবলি হতো পুজোয়। এখন পাঁঠাবলি হয় অষ্টমীর রাতে নিশি পুজোয়। কনকদুর্গা যেহেতু রাজবাড়ির কুলদেবী, তাই তাঁর নিত্য পুজোও হয়ে থাকে। বিশেষ আয়োজন হয় দুর্গোৎসবের সময়।
বঙ্গদেশে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মহিষমর্দিনীর প্রস্তরমূর্তিই পূজিত হতো। এগুলির কোনওটি অষ্টাদশভুজা, কোনওটি ষোড়ভুজা, কোনওটি আবার দশভুজা। এমন মূর্তিগুলির পাশে কিন্তু দেবীর সন্তানদের দেখা যায়নি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর রাজা কংসনারায়ণ প্রথম শরৎকালে মাটির প্রতিমা গড়ে দুর্গাপুজো করেন। সেখানে দেবীর সঙ্গে লক্ষ্মী-সরস্বতী-গণেশ-কার্তিককে দেখা যায়। তার আগে কুলদেবী হিসেবেই দুর্গার পুজো হতো। বারোশো বছর আগেও তিনি কুলদেবীই ছিলেন। প্রাচীনকালের মূর্তিতে দেবীর কোনও বাহন ছিল না। তিনি একাই বিশালবপুর মহিষকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তার লেজ ধরে। পরবর্তীকালে মহিষমর্দিনীর রূপ হয় সিংহবাহিনী। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে মল্লরাজাদের প্রতিষ্ঠিত দেবীর বাহন আবার গাধা। এর মুখটি গোসাপের, কিন্তু দেহটি ঘোড়ার। ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে এমনই মূর্তিতে সেখানে দেবী পূজিতা হয়ে আসছেন। উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটায় প্রায় দুশো বছর আগে রামলোচন ঘোষ যে দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন, সেই দেবীর সিংহটির মুখ ছিল ঘোড়ার মুখের মতো। মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায় পাই ‘শাক্তের বাটীতে দুর্গার সিংহ সাধারণভাবে এবং গোঁসাই-এর বাড়িতে সিংহ ঘোড়ার মতো মুখ হইত।’ যা ‘হয়বদন সিংহ’ নামে পরিচিত।
দুর্গার হাতের সংখ্যা যেমন দ্বিভুজা থেকে সহস্রভুজাও হয়েছে। দেবীর বাহনের মূর্তিরও ভিন্নতা লক্ষ করা গিয়েছে। এ বিবর্তন হয়েছে শত শত বছর ধরে। হিন্দু পুরাণ অনুসারে দেবী পার্বতীর যে ৯টি রূপকে জবদুর্গা হিসেবে পুজো করা হয়, সেখানে দেবীর গাত্রবর্ণ থেকে শুরু করে বহু বৈচিত্র্যই চোখে পড়বে। দশভুজা ‘চন্দ্রঘণ্টার’ রূপ সোনার মতো উজ্জ্বল, আবার ‘কালরাত্রি’ হিসেবে পূজিতা দেবী কৃষ্ণবর্ণা। ‘কুষ্মাণ্ডা’ রূপে দেবী অষ্টভুজা। কারুণ্যে ভরা সেই সৌম্যমূর্তির ডানদিকের চার হাতে শোভা পায় পদ্ম, বাণ, ধনুক ও কমণ্ডলু। বাম হাতে তাঁর চক্র, গদা, অমৃতপূর্ণ কলস আর জপমালা। সাধারণত তাঁর বাহন সিংহ হলেও কাশীর মন্দিরে কিন্তু বাঘ। নবরাত্রির প্রথমে দ্বিভুজা শৈলপুত্রী হিসেবেই দেবী পুজো পান। ইনি বৃষারূঢ়া। এঁর ডান হাতে ত্রিশূল, বাঁ হাতে পদ্ম। দ্বিতীয় রূপ ব্রহ্মচারিণীরও দুটি হাত—ডান হাতে জপের মালা, বাঁ হাতে কমণ্ডলু। দেবী শীতলার মতো একমাত্র কালরাত্রি হিসেবেই দেবীদুর্গার বাহন গাধা। নবরাত্রির অষ্টম রাতে পূজিতা দেবীর মহাগৌরীরূপ চতুর্ভুজা। সেখানেও ষাঁড়ই তাঁর বাহন। তাঁর তিনটি হাতে পদ্ম, ত্রিশূল ও ডমরু। অন্য হাতে বরাভয় মুদ্রা।
দেবীর এই বরাভয়ই আমাদের প্রেরণা, আমাদের শক্তি, শত দুর্বিপাকেও। নানা মতে, নানা রূপে আসলেই তিনি সমস্ত শক্তির আধার।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস