ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
যাত্রা, কবিগান, আখড়াই, পাঁচালি, খেমটার নাচ, বুলবুলের লড়াই ইত্যাদি অসংখ্য আনন্দের মধ্যেই অতিবাহিত হচ্ছে সময়। কিন্তু হেয়ার বুঝলেন, একটা জিনিসের বেশ অভাব। সেটি হল, আধুনিক শিক্ষা। ইংরেজির তো প্রশ্নই নেই, বাংলাটাও ভালো শিখছে না এইসব উচ্চ অথবা মধ্যবিত্তদের সন্তানেরা। অথচ প্রত্যেকেই বেশ বুদ্ধিমান, প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন। আধুনিক শিক্ষার ঘষামাজা পেলেই উজ্জ্বল রত্ন এখান থেকে পাওয়া যায়। কিছু পাঠশালা রয়েছে বটে। কিন্তু সেখানে ভালো বই অথবা আধুনিক সিলেবাস কিছুই নেই। অঙ্ক, পত্রলেখা, জমাওয়াসিল বাকি, গুরুদক্ষিণা, গঙ্গার বন্দনা এসবই মূলত শিখছে। তবে সেরকম আগ্রহও নেই। ঘড়ির দোকানে আসা সমাজের একটু উচ্চশ্রেণির মানুষদের তিনি বলতে শুরু করলেন যে, একটা স্কুল হওয়া দরকার। যেখানে ইংরেজি, বাংলা, আধুনিক শিক্ষা সবই পড়ানো হবে। কেউ হয়তো গুরুত্ব দিল। কেউ কেউ হেসে উড়িয়ে দিল। তিনি হাল ছাড়ছেন না।
একটি মানুষকে চিনতেন। সেই ভদ্রলোকের প্রবল ব্যক্তিত্ব আর তিনি ভীষণ একরোখা। তাঁকে বললে কিছু একটা হতে পারে। ভদ্রলোকের নাম রামমোহন রায়। সম্প্রতি তিনি একটি সংগঠনের জন্ম দিয়েছেন। ‘আত্মীয়সভা’। কয়েকবার সেই সভায় গিয়েছিলেন হেয়ার। এবার একদিন সেখানে অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার পর উপস্থিত কয়েকজনের সামনেই হেয়ার প্রস্তাবটি তুললেন। রামমোহন অবশ্যই এককথায় রাজি। সামনেই ছিলেন বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়। বিদ্বজ্জনদের কাছে দরবার করা আর প্রচারের জন্য তিনি আদর্শ। কারণ বৈদ্যনাথবাবুর সঙ্গে উচ্চপদস্থ ইংরেজ আধিকারিকদের বেশ জানাশোনা। তাঁর কাছে এঁরা সমাজের নানারকম খবরাখবর পেতেন। বৈদ্যনাথবাবু গেলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার হাইড ইস্টের কাছে। ইস্টসাহেবও খুবই আনন্দিত। রামমোহন রায় ও ডেভিড হেয়ারকে ডেকে বললেন, গোটা প্ল্যানটার একটা ছক কষে ফেলা যাক। ১৮১৬ সালের ১৪ মে স্যার হাইড ইস্টের বাড়িতেই প্রথম একটা সভা হল। বিদ্যালয় স্থাপনের। সমাজের উচ্চপদস্থরা এসেছেন। ততদিনে বৈদ্যনাথবাবু সকলকেই রাজি করিয়েছেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়ে গেল যে, স্কুল এবার হচ্ছেই।
কিন্তু হঠাৎ একটা গুঞ্জন। রামমোহন রায় নাকি এই স্কুলের প্রস্তাবের মধ্যে আছেন? কমিটিতেও তিনি থাকবেন! ব্যস! তৎক্ষণাৎ হিন্দু সমাজের প্রথম সারির মানুষজন জানালেন, যে পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে প্রচার করছে, সতীদাহ বন্ধ করতে চায় ওই বিধর্মীটির সঙ্গে এক কমিটিতে থাকার কোনও বাসনা আমাদের নেই। ডেভিড হেয়ার, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, হাইড ইস্টরা দেখলেন, এ তো মহাবিপদ! তীরে এসে তরী ডুবছে। হেয়ার অবশ্য জানেন, এটা কোনও সমস্যাই নয়। তিনি সোজা গেলেন বন্ধুর বাড়িতে। বললেন সমস্যার কথা। রামমোহন রায় অট্টহাসি হেসে বললেন, সে কী কথা? কমিটিতে আমার নাম থাকা কি এতই বড় কথা যে, সেজন্য একটা ভালো কাজ নষ্ট হবে! অবশ্যই আমার নাম রাখার কোনও দরকার নেই। আমি যে এসবের মধ্যে নেই, এটাও জানিয়ে দিন সকলকে। আর কোনও বাধা নেই। গরানহাটার বসাকদের বাড়িতেই ১৮১৭ সালের ২০ জানুয়ারি শুরু হয়ে গেল স্কুল। নাম দেওয়া হল হিন্দু কালেজ। সেই শুরু। কিন্তু শেষ নয়। এবার কলকাতার চারটি স্থানে চারটি পাঠশালা তৈরি হল। নিয়ম হল, পাঠশালায় যে ছাত্ররা ভালো ফল করবে, তাদের পাঠানো হবে হিন্দু কালেজে। ততদিনে একটি ইংলিশ মিডিয়ামও চালু হয়েছে। ধাপে ধাপে উন্নতি করতে হবে পড়ুয়াদের। এটাই টার্গেট ডেভিড হেয়ারের। শ্যামবাজার, জানবাজার আর ইন্টালিতে বালিকা বিদ্যালয়ও তৈরি হয়ে গেল। মেয়েদের অভিভাবককে কে রাজি করাবে? হেয়ার সাহেব।
শুধু স্কুল করে কী হবে? বই কোথায়? ডেভিড হেয়ার একটি সংগঠন গড়লেন। স্কুল বুক সোসাইটি। এই সোসাইটির কাজ হবে উন্নত মানের পাঠ্যপুস্তক তৈরি করে ছাপিয়ে স্কুলে স্কুলে বিলি করা। কোন ছেলেটি দু’দিন হল স্কুলে আসছে না। কে খবর নেবে? হেয়ার সাহেব। সোজা সেই ছেলের বাড়ি গিয়ে যদি দেখতেন অসুস্থ, সেখানেই বসে পড়তেন সেবাকার্যে। হিন্দু সমাজের প্রতিনিধি মধুসূদন গুপ্তকে হেয়ার সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, মেডিক্যাল কলেজ হলে হিন্দুরা কি ছেলেদের পাঠাবে? শবদেহ পরীক্ষা করতে হবে।
মধুসূদন গুপ্ত কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে খবর নিলেন। নিজেও বোঝালেন সমাজকে। হেয়ার সাহেবকে বললেন, পণ্ডিতসমাজ আমাকে কথা দিয়েছেন তাঁরা এই প্রস্তাব সমর্থন করবেন। হেয়ার সাহেব এত আনন্দ আর পাননি বোধহয় আজীবন। পরদিনই চলে গেলেন গভর্নর জেনারেলের কাছে। দ্রুত ব্যবস্থা করতে ১৮৩৫ সালে মেডিক্যাল কলেজ তৈরি হয়ে গেল কলকাতায়। প্রধান উপদেষ্টা কে? হেয়ার সাহেব। কলকাতার বিদ্যাশিক্ষার সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিলেন স্কটল্যান্ডের এই স্বল্পশিক্ষিত মানুষটি। ১৮৪২ সালে তাঁর মৃত্যুর পর সমাধি নির্মাণের জন্য চাঁদা তোলা হবে। প্রত্যেক ছাত্র পরিবার এক টাকা করে দেবে। একটা সময় এল যখন আর টাকা নেওয়া সম্ভব নয়। প্রয়োজনীয় টাকা তো বটেই, আরও অনেক উদ্বৃত্ত হয়ে যাচ্ছে। তখনও দূর দূরান্ত থেকে আসছেন মানুষ, হাতে এক টাকা নিয়ে। কারণ, তাঁদের সন্তান হেয়ার সাহেবের তৈরি কোনও না কোনও পাঠশালায় পড়েছে। তিনি শিক্ষক ছিলেন না। ভারতীয় ছিলেন না। কিন্তু বাঙালির কাছে আধুনিক শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে এত বড় পথিকৃৎ আর কে?
...
রেলি ব্রাদার্সের তৈরি একটি সাদা রঙের কাপড়কে দু’টি পৃথক খণ্ডে ভাগ করে নিতেন তিনি। একটি হতো ধুতি। অন্যটি চাদর। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন সেই কলেজের একতলার ঘরে থাকতেন তিনি। সাধারণ নিয়ম হল, পড়ানো এবং প্রশাসনিক কাজ সামলানোর পর বই পড়া অথবা লেখালেখিতে যুক্ত থাকা। সেসব করতেন বটে। কিন্তু পাশাপাশি ওই একতলার ঘরের সামনের জমি কোদাল দিয়ে কুপিয়ে একটা আখড়া তৈরি করলেন। কুস্তির আখড়া। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রকাশ্যে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ কুস্তি প্র্যাকটিস করতেন। ডেকে নিতেন নিম্নশ্রেণির মানুষকে। তাঁরা হতেন তাঁর কুস্তির পার্টনার। এরকম এক আশ্চর্য মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে স্বাভাকিভাবেই জন এলিয়ট ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন চমৎকৃত হয়েছিলেন। তিনি জানতে পারলেন এই শিক্ষকটির নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর পাণ্ডিত্য আর জ্ঞানের ব্যুৎপত্তির জেরে পাশ করার সময় কলেজ থেকেই তাঁকে ‘বিদ্যাসাগর’ নাম দেওয়া হয়েছে।
বাবা জন ড্রিঙ্কওয়াটার ছিলেন সেনা আধিকারিক। জিব্রাল্টার যুদ্ধের অন্যতম সেনাপতি। সুতরাং পুত্রেরও আর্মিতে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু বেথুন সাহেবের ভাগ্যের সূত্র ছিল অন্য সুরে বাঁধা। বাবা যেহেতু যুদ্ধের কারণে বাইরে থাকতেন, তাই প্রকৃত শিক্ষক ছিলেন মা। স্রেফ মায়ের শিক্ষা আর উৎসাহে বেথুন সাহেব কেমব্রিজের ট্রিনিটি থেকে শুধুই স্নাতক হলেন তাই নয়, চতুর্থ র্যাংলার হয়েছিলেন। মা তাঁকে বলেছিলেন, সারাজীবন ধরে নতুন কিছু শিখতে। শেখার শেষ নেই। ওসব ডিগ্রি টিগ্রিকে ছাপিয়ে শুধুই আত্মস্থ করে যাও এই দুনিয়ার শিক্ষাকে। বেথুন দেখলেন এটা একটা দারুণ কথা। সুতরাং তাঁর এক আশ্চর্য জার্নি শুরু হল। একদিকে গ্রিক, ল্যাতিন, জার্মান, ইতালীয় ভাষা শিখছেন, আবার অঙ্কে তুখোড়। গোটা দুনিয়া চলছে আইনের শাসনে। তাহলে আইনশিক্ষা না জানলে কীভাবে হবে? অতএব আইন শিখলেন। আর এটাই ঘুরিয়ে দিল ভাগ্যের চাকা।
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে বলল, ভারতে আইন পরিষদের সদস্য সচিব হয়ে যেতে হবে। কোথায়? অবশ্যই কলকাতায়। এবার এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। স্কটল্যান্ডের এক ঘড়ি বিক্রেতা এদেশে ব্যবসা করতে এসে কলকাতার শিশুসন্তানদের আধুনিক শিক্ষাদানে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। আর ঠিক ২০ বছর পর আর এক স্কটল্যান্ডবাসী ভারতের শিক্ষা সংক্রান্ত উপদেষ্টা হিসেবে এসে ভাবলেন মেয়েদের বিদ্যা শিক্ষার প্রসার করা দরকার। অবশ্যই স্ত্রীশিক্ষার উদ্যোগ তার অনেক আগেই শুরু হয়েছে। কিন্তু এখনও যেন তার প্রভাব সমাজে নেই। অতএব বেথুন সাহেবের ধ্যানপ্রাণ হয়ে উঠল একটা আধুনিক ও উন্নত মানের মেয়েদের স্কুল গড়ে তোলা। আর ঠিক এই কাজ নিয়ে কথা বলার জন্যই আলাপচারিতা থেকে তাঁর আলাপ হয়ে গেল ওই অদ্ভুত মানুষটির সঙ্গে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
প্রথমে দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে চালু হল। নাম দেওয়া হল হিন্দু ফিমেল স্কুল। পরিচালনার ব্যয় প্রায় ৮০০ টাকা। সবটাই বেথুন দেবেন ঠিক করলেন। প্রচণ্ড পরিশ্রম শুরু করলেন। শরীর ভাঙতে লাগল। সমাজ কীভাবে দেখেছে এই উদ্যোগ? কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ব্যঙ্গ করে লিখলেন, ‘আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো/ ব্রতকর্ম করত সবে/ একা বেথুন এসে শেষ করেছে/আর কি তেমন পাবে?’ বেথুন সাহেব দুঃখ পাননি? না। বিদ্যাসাগরকে দেখে প্রেরণা পেয়েছেন তিনি। কেন? কারণ ওই ভদ্রলোক কাউকে গ্রাহ্য করেন না। কে কী বলল, কোথায় বাধা দিল ওসবের মন দিলে কাজ হবে না। আসুন আগে কাজে নেমে পড়ি। এই ছিল বিদ্যাসাগরের মনোভাব। বীরসিংহ নামক একটি গ্রাম্য পরিবেশ থেকে আসা একটি মানুষের মধ্যে এরকম তেজ কোথা থেকে আসে? বেথুন আশ্চর্য হয়ে যান। ১৮৫১ সালে অত্যধিক পরিশ্রমে বেথুন সাহেবের মৃত্যু হলেও তাঁর জ্বালিয়ে যাওয়া আলোটি আরও উজ্জ্বল হল। সেই স্কুল হল কলেজ। এই স্কুলের এক ছাত্রী উদ্ভাসিত হলেন প্রথম এন্ট্রান্স ছাত্রী হিসেবে। সেখানে শেষ নয়। তাঁর যাত্রাপথ হবে আরও অনেক গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়! বাংলায় স্ত্রীশিক্ষার নতুন আলো!
শিক্ষাবিভাগে একটি পদ সৃষ্টি হয়েছে। ইন্সপেক্টর। সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়ার পাশাপাশি ঈশ্বরচন্দ্র চারটি জেলার ইন্সপেক্টর হয়ে গেলেন। এই অতিরিক্ত কাজটি গ্রহণের কারণ কী? কারণ, কলকাতায় শুধু মেয়েদের স্কুল করে কী হবে? গ্রামবাংলা কি পিছিয়ে থাকবে? অতএব যখনই বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর, নদীয়ায় স্কুল ইন্সপেকশনের কাজে যাচ্ছেন, ছেলেদের স্কুলের পাশাপাশি সুযোগ পেলেই একটি করে মেয়েদের স্কুল তৈরির কাগজপত্রে স্বাক্ষর করে ব্যবস্থা করে আসছেন। এদিকে ডিরেক্টর গর্ডন ইয়ং এসব পছন্দ করছেন না। তিনি বললেন, ছেলেদের স্কুলের জন্য টাকা দেব। মেয়েদের জন্য নয়। বিদ্যাসাগর যতবার বিল পাঠাচ্ছেন, ততবারই গর্ডন সাহেব স্বাক্ষর করছেন না। বিদ্যাসাগর সোজা গভর্নর জেনারেলের কাছে নালিশ করলেন। সুফল পেলেন। সব বিল ক্লিয়ার হল। কিন্তু ক্ষিপ্ত হলেন গর্ডন ইয়ং। এভাবে কাজ করা সম্ভব নয়। তাই বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগ তাঁর কাছে নতুন নয়। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে এর আগে ইস্তফা দেওয়ার পর তাঁকে আত্মীয়রা বলেছিলেন, তোমার চলবে কীভাবে? বিদ্যাসাগর বললেন, আলু, পটল বিক্রি করব! সংস্কৃত কলেজে শুধুই ব্রাহ্মণ ছাত্রের প্রবেশাধিকার। সেখানে নিম্নবর্ণের ছাত্রদেরও পড়াশোনা করতে দিতে হবে। সমাজের সঙ্গে এই লড়াইটা কে করলেন? স্বয়ং অধ্যক্ষ। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। পরবর্তী সময়ে নিজের তৈরি মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন তৈরি করে বিদ্যাসাগর দেখিয়ে দিলেন একক শক্তির কী অবিশ্বাস্য অভিঘাত।
স্ত্রীশিক্ষার প্রসারে কিংবদন্তি এই মানুষটি কি নিছক পুঁথির শিক্ষক ছিলেন? শুধুই স্কুল চালু, বিধবাবিবাহ, বাল্যবিবাহের আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ? মোটেই নয়। তিনি বাঙালিকে চারিত্রিক ঋজুতা শিখিয়ে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগর বঙ্গদেশে একক ছিলেন... তিনি প্রতিদিন দেখিয়াছেন, আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না। আড়ম্বর করি, কাজ করি না। যাহা অনুষ্ঠান করি, তাহা বিশ্বাস করি না, যাহা বিশ্বাস করি, তাহা পালন করি না। ভূরি পরিমাণ বাক্যরচনা করিতে পারি, তিলপরিমাণ আত্মত্যাগ করিতে পারি না। আমরা অহংকার দেখাইয়া পরিতৃপ্ত থাকি, যোগ্যতালাভের চেষ্টা করি না...এই দুর্বল, ক্ষুদ্র, হৃদয়হীন, কর্মহীন, দাম্ভিক, তার্কিক জাতির প্রতি বিদ্যাসাগরের এক সুগভীর ধিক্কার ছিল। কারণ, তিনি সর্ববিষয়েই ইহাদের বিপরীত ছিলেন।’ রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৫ সালে এই কথাগুলি লিখেছিলেন ‘চারিত্রপূজা’ প্রবন্ধে। আজ ১২৬ বছর পরও কতটা সত্য সেটা আমরা জানি।
বাঙালির অসীম সৌভাগ্য, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো এক জীবনশিক্ষক পেয়েছিল সে!
...
সুদূর বারাণসী থেকে অনেকটা সফর করে এসে বোলপুর স্টেশনে যখন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন নামলেন, দেখতে পেলেন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। দু’হাত দূরের দৃশ্যও দেখা যাচ্ছে না। গোরুর গাড়ি ছাড়া আর কোনও গাড়ি এই রাস্তায় চলে না। কিন্তু তাও নেই। রাতে স্টেশনে থাকতে হল। পরদিন সকালেও গোরুর গাড়ির দেখা নেই। বর্ষা থামছে না। অগত্যা কী আর করা? ক্ষিতিমোহন সেন পদব্রজে রওনা হলেন। তাঁর গন্তব্য একটি ব্রহ্মচর্যাশ্রম। পদব্রজে ওই নির্জন বর্ষাস্নাত রাস্তা দিয়ে আশ্রমের কাছে পৌঁছতেই, ক্ষিতিমোহন সেনের কানে ভেসে এল একটা গান। উদাত্ত কণ্ঠে কেউ গাইছেন, ‘তুমি আপনি জাগাও মোরে।’ কে গাইছেন এভাবে? বিস্মিত হচ্ছেন ভিজতে ভিজতে ক্ষিতিমোহন।
আশ্রমের দ্বারে তাঁকে স্বাগত জানালেন বিধুশেখর ভট্টাচার্য ও ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল। তাঁরাই জানালেন এই প্রবল বর্ষায়, নির্জন একটি বাড়ির বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে যিনি এই গানটি নিবেদিত প্রাণে গাইছেন, তিনিই এই আশ্রমের পরিচালক। যাঁকে সকলে সম্বোধন করেন ‘গুরুদেব’। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘দেহলী’ নামক বাড়িতে থাকেন। আর এরকম একটি আশ্চর্য স্কুল চালান।
কেন আশ্চর্য? এ এমন এক স্কুল যেখানে সারাদিনের পড়াশোনার পর ছাত্রদের নিয়ে হয় মজলিশ। কখনও শালবীথিরতলে। সেখানে হচ্ছে গল্পবলা। যেদিন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চারদিক, সেদিন পারুলডাঙ্গা অথবা খোয়াইয়ের পাথুরিয়া ময়দানে হবে গান, কবিতা আর হেঁয়ালির মজা। ফেরার সময়? গুরুদেব চ্যালেঞ্জ করতেন, দেখি তো আমাকে হাঁটায় কে পরাস্ত করবে? তিনি জোরে জোরে হাঁটছেন। ছেলেরা বহু চেষ্টা করেও তাঁকে ধরতে পারছে না। এমনকী দৌড়েও নয়।
শুধুই ছেলেরা এই অন্যরকম শিক্ষার স্বাদ পাবে? রবীন্দ্রনাথের খুব ইচ্ছা মেয়েদেরও ক্লাস হোক। কিন্তু ওই ছেলেদের আশ্রম চালাতেই দেনার দায়ে তিনি নিমজ্জিত। আবার মেয়েদের দায়িত্ব কীভাবে সম্ভব? কয়েকদিনের মধ্যেই সেই দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে নিজের বাড়ি ‘দেহলী’কেই ছাত্রীদের আবাসস্থল করে দিলেন। তিনি সরে গেলে অন্যত্র। ১৯০৯ সালে সেই মেয়েদের সঙ্গেই নিজের দুই কন্যারও থাকার ব্যবস্থা হল। ১৯০১ সালে যখন এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপিত হল কলকাতা থেকে অনেক দূরে, সেদিন প্রতিষ্ঠা দিবসে কী বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
‘আজ থেকে তোমরা সত্যব্রত গ্রহণ করলে। মিথ্যাকে কায়মনোবাক্যে দূরে রাখবে।
আজ থেকে তোমাদের অভয়ব্রত। ধর্মকে ছাড়া জগতে তোমাদের ভয় করবার দরকার আর কিছু নেই— বিপদ না, মৃত্যু না, কষ্ট না...
আজ থেকে তোমাদের পুণ্যব্রত। যা কিছু অপবিত্র, কলুষিত, যা কিছু প্রকাশ করতে লজ্জা বোধ হয়, তা সর্ব প্রযত্নে প্রাণপণে শরীর মন থেকে দূর করে প্রভাতের শিশির সিক্ত ফুলের মতো পুণ্যে ধর্মে বিকশিত হয়ে থাকবে।
আজ থেকে তোমাদের মঙ্গলব্রত। যাতে পরস্পরের ভালো হয় তাই তোমাদের কর্তব্য...।’
এ ধ্রুবমন্ত্র কোন স্কুলে শেখানো হয়েছে আজ পর্যন্ত? খোলা প্রকৃতির নীচে শিক্ষাগ্রহণ। যতটা গুরুত্ব গণিতে, ততটাই অঙ্কনে। যতটা প্রয়োজন বিজ্ঞান, ততটাই তাৎপর্য বনসৃজন। এখানে উৎসবের নাম বৃক্ষরোপণ। এখানে অভিজ্ঞানের নাম হলকর্ষণ। বিশ্বভারতী নামক এই রূপকথাটি বাঙালিকে নতুনভাবে গঠন করেছে। বাঙালিকে একটি বিশেষ শব্দ উপহার দিয়েছে। সংস্কৃতি! এই আশ্রম পরিচালক বিশ্ববীক্ষার শিক্ষক। বাঙালির নিরন্তর আশ্রয়। রুচিশিক্ষার দীক্ষাগুরু!
...
এই তালিকা অন্তহীন। তবে সমাপ্তির পথে আমরা হাঁটব এমন একজন শিক্ষককে স্মরণ করে, যিনি বিপুল কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন অথবা নির্মাণ করেছেন এক বৃহদাকার শিক্ষায়তন, এমন মোটেই নয়। বরং তিনি একজন কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষাবিদ হিসেবেই পরিচিত। কলকাতার জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশনের অধ্যক্ষ অধ্যাপক উইলিয়ম হেস্টি একদিন জানতে পারলেন ইংরেজি সাহিত্যের এক অধ্যাপক রাগ করে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গিয়েছেন। কারণ ছেলেরা নাকি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বুঝতে পারছিল না। তিনি বিরক্ত হয়ে মাঝপথেই বেরিয়ে আসেন। অধ্যাপক হেস্টি সেই ক্লাস নিজেই নিতে গেলেন। পড়াতে শুরু করলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা ‘দ্য এক্সকারশন।’ কবি বোঝাতে চাইছেন কীভাবে প্রকৃতির সৌন্দর্য অবলোকন করে মানুষ অতীন্দ্রিয় এক জগতে চলে যায়। সমাধির মতো একটা ভাব তৈরি হয়। হেস্টি একথা বললেও ছাত্ররা বুঝতে পারছে না। আবার অধ্যাপক হেস্টি বললেন, ‘মনের পবিত্রতা এবং বিষয় বিশেষের প্রতি একাগ্রতার ফলে ওইরূপ অনুভূতি হতে পারে। আমি এমন একজন মাত্র লোককে দেখেছি যিনি মনের ওই অতি শুভ অবস্থায় উপনীত হয়েছেন। তিনি দক্ষিণেশ্বরের শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তোমরা সেখানে গিয়ে নিজে দেখে এলে বুঝতে পারবে।’
ছাত্রদের কেউ বিশ্বাস করল । কেউ হয়তো করল না। ক্লাস শেষ। কিন্তু ওই মুহূর্তটি মাহেন্দ্রক্ষণ হয়ে রইল। সেদিন ওই ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন হেস্টির অন্যতম প্রিয় ছাত্র শিমুলিয়া পাড়ার আইনজীবী বিশ্বনাথ দত্তের পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত। একঝাঁক অধ্যাত্ম সংক্রান্ত প্রশ্ন তাঁকে কিছুদিন ধরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল। তিনি উত্তর পাচ্ছিলেন না। নরেন্দ্রনাথ দত্তকে সেই প্রশ্নগুলির উত্তর পাওয়ার একটি অমোঘ ঠিকানার সন্ধান দিলেন অধ্যাপক হেস্টি। ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে সেই দক্ষিণেশ্বরের মানুষটির সঙ্গে শিমুলিয়াতেই সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাসভবনে দেখা হল নরেন্দ্রনাথের। তাঁকে গান গাইতে হবে। ভজনসঙ্গীত সমাপ্ত হওয়ার পর, রামকৃষ্ণদেব নরেন্দ্রনাথকে একবার দক্ষিণেশ্বরে যেতে বললেন। একটি ইতিহাস রচিত হল।
অধ্যাপক উইলিয়ম হেস্টির কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে, তিনি ওয়ার্ডসওয়ার্থ পড়াতে গিয়ে এক মহাজীবনের অলৌকিক সফরের সূত্রপাত করেছিলেন অজ্ঞাতেই! প্রজ্বলিত করেছিলেন একটি আলো। আলোর নাম স্বামী বিবেকানন্দ! আধুনিক ভারতের মহাশিক্ষক!
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়