ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
গঙ্গা, যমুনা (ব্রহ্মপুত্র) ও মেঘনা প্রায় ১৭.২১ লক্ষ বর্গকিমি অববাহিকা থেকে বছরে প্রায় ১ হাজার ৩৭৫ ঘন কিমি জলের বিপুল ধারা নিয়ে বাংলায় প্রবেশ করে আর ওই জলের স্রোতে ভেসে আসে ১০০ কোটি টন পলি। এই তিন বড় নদীকে জল-পলির জোগান দেয় অনেক উপনদী। গঙ্গা রাজমহল পাহাড় পেরিয়ে অনেক শাখায় ভাগ হয়েছে— বাঁ-পাড় থেকে বেরিয়েছে কালিন্দ্রী, পাগলা, ছোট ভাগীরথী ও বোড়াল এবং ডান পাড় থেকে ভাগীরথী, ভৈরব, জলঙ্গী, মাথাভাঙা, গড়াই ও চন্দনা। এখন অনেক নদী মরে গিয়েছে। মধ্যযুগে গঙ্গার একটি শাখা (এখন ছোট ভাগীরথী নামে পরিচিত) বাংলার দুই রাজধানী গৌড় ও টান্ডার পশ্চিম সীমানা ঘেঁষে বয়ে যেত। রেনেল তাঁর ‘মেময়ার অব এ ম্যাপ অব হিন্দুস্তান’-এ লিখেছিলেন যে, ‘গঙ্গা গৌড়ের ধ্বংসাবশেষ-এর ছয় কিলোমিটার দূর দিয়ে প্রবাহিত হয়।’ পূর্বে মহানন্দা আর পশ্চিমে ভাগীরথী নদীর মাঝে অবস্থিত বাংলার মধ্যযুগীয় রাজধানী গৌড় বন্যার জলে প্লাবিত হতো আর এই সমস্যার সমাধানের জন্য উঁচু বাঁধ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। সপ্তগ্রাম ছিল গৌড়ের বন্দর ও বাণিজ্যনগরী। মধ্যযুগে এই বন্দর থেকে ভাগীরথী-গঙ্গা-ছোট ভাগীরথী হয়ে উজান বেয়ে গৌড়ে যাওয়া যেত। পূর্ব বাংলার বন্দর চট্টগ্রাম থেকে গৌড়ে আসার পথটি ছিল দীর্ঘ— বঙ্গোপসাগর থেকে আরিয়ালখান এবং পরে পদ্মা-ছোট ভাগীরথী হয়ে আসতে হতো। ছোট ভাগীরথীর পাড়ে যেখানে জাহাজ নোঙর করত সেই স্থানটি আজও ‘জাহাজ ঘাট’ নামে পরিচিত। যে নদী এক সময় ছিল গৌড়ে যাওয়ার নৌপথ সেই কালিন্দ্রী, ছোট ভাগীরথী ও অন্য এক শাখানদী পাগলা এখন মজে গিয়েছে। বড় বন্যা না হলে ওই তিনটি নদী দিয়ে জল বয়ে যায় না।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সিকিম থেকে নেমে তিস্তা তিনটি শাখার মধ্যে দিয়ে সাগরে মিশত। এই নদীগুলির নাম— করতোয়া, আত্রেয়ী ও পুনর্ভবা। ১৭৮৭ সালে এক বন্যার সময় তিস্তা একটি নতুন পথ করে নিয়ে বাংলাদেশের চিলমারীর কাছে যমুনা বা ব্রহ্মপুত্রে মিশে যায়। তিস্তার গতিপথ বদলের পর তার তিন শাখা করতোয়া, আত্রেয়ী আর পুনর্ভবা ক্রমশ শুকিয়ে গিয়েছে। সেই সময় ব্রহ্মপুত্র বাইগনবাড়ী হয়ে বাজিতপুরের কিছুটা দক্ষিণে মেঘনার সঙ্গে মিশত এবং পরে সেই মিলিত ধারা চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর হয়ে সাগরে মিশত। গঙ্গা তখন আলাদাভাবে মেঘনার পশ্চিমে অন্য এক খাঁড়ি ধরে সাগরে মিশছে। রেনেলের মানচিত্রে দেখা যায় ‘ডেকান শাহাবাজপুর’ নামে একটি বড় দ্বীপ দুই মোহনাকে পৃথক করেছে। ব্রহ্মপুত্রের ওই পথ ধরেই ইবন বতুতা চট্টগ্রাম থেকে কামরূপ গিয়েছিলেন। রেনেলও ওই ব্রহ্মপুত্রর উজান বেয়ে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন। ১৮৩০ সালে দক্ষিণবঙ্গের নদী মানচিত্র আমূল বদলে যায়। যে ব্রহ্মপুত্র মধুপুর-গড়ের পূর্ব দিক দিয়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবাহিত হতো সেই নদী পশ্চিমে সরে এসে জনাই নামে একটি শাখা নদীর পথকে প্রসারিত করে জাফরগঞ্জে ধলেশ্বরীর উৎসের কাছে গঙ্গার সঙ্গে মিশে যায়। ময়মনসিংহ হয়ে বয়ে যাওয়া সেই আদি ব্রহ্মপুত্র এখন সংকীর্ণ। গঙ্গা-যমুনার মিলিত স্রোত প্রবল শক্তিতে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে মুন্সিগঞ্জের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিশে যায়। গঙ্গার সাগরমুখী পূর্বতন খাতটি এখন আরিয়ালখান নামে পরিচিত। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নির্মিত রেনেলের মানচিত্রের সঙ্গে এই সময়ের মানচিত্র তুলনা করলে এই পরিবর্তন অনুধাবন করা যায়।
অনেকের ধারণা, খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে অন্তত একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত গঙ্গার সাগরমুখী মূল প্রবাহ পথ ছিল বর্তমান ভাগীরথীর খাত ধরে, দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে ভাগীরথীকে ছেড়ে পদ্মার খাত ধরে পূর্ববঙ্গের দিকে বইতে শুরু করে। মহাভারত ও পুরাণে ভাগীরথীকেই ‘গঙ্গা’ বলা হয়েছে, কিন্তু পদ্মার কথা অনুচ্চারিত। বাংলার প্রথম নদী বন্দর ও বৌদ্ধ সংস্কৃতির কেন্দ্র তাম্রলিপ্ত গড়ে উঠেছিল ভাগীরথীর তীরে আর এই বন্দরের কথা উল্লেখ করেছেন— টলেমি (১৫০ খ্রিস্টাব্দ), ফা হিয়েন (৩০০ খ্রিস্টাব্দ) ও হিউয়েন সাঙ (৬৩৯ খ্রিস্টাব্দ)-এর মতো পরিব্রাজকরা। এই পরিব্রাজকরা কেউ পদ্মার কথা বলেননি। উল্লেখ্য, ভাগীরথী তখন ত্রিবেণী থেকে সরস্বতীর খাত ধরে প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণের মোহনা দিয়ে তাম্রলিপ্ত বন্দরকে ছুঁয়ে সাগরের দিকে বয়ে যেত। ভাগীরথী তার গতিপথ বদলে বর্তমান খাত ধরে বইতে থাকার অনেক দিন পরেও রূপনারায়ণের মোহনাকে স্থানীয় মানুষরা গঙ্গাই বলত। তাম্রলিপ্ত থেকে পাওয়া পুরাবস্তু এবং পৌরাণিক ও পরিব্রাজকদের বর্ণনা মাত্র ২৫০০-৩০০০ বছরের ইতিহাস বলে। সেই সময় পূর্ববাংলার সমভূমি বসতির অযোগ্য। ভাগীরথী দিয়ে তখন অনেক বেশি জল বয়ে যেত কারণ ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে উৎপন্ন অজয়, ময়ূরাক্ষী, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী ও রূপনারায়ণ তখন সজীব নদী। জল বয়ে আসত জলঙ্গী ও মাথাভাঙা-চূর্ণী দিয়েও। কিন্তু বদ্বীপ ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে হেলে যাওয়ার ফলে সপ্তদশ শতাব্দী বা তার আগে থেকেই ভাগীরথী শুখা মরশুমে গঙ্গা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। শীতকালে গঙ্গা থেকে নৌকা বেয়ে ভাগীরথীতে ঢোকা যেত না। ১৬৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে ফরাসি বণিক ট্যাভারনয়ার গঙ্গাপথে আগ্রা থেকে ঢাকায় আসছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বার্নিয়ার। তাঁর গন্তব্য ছিল মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজার ও হুগলি। সেই সময় মুর্শিদাবাদের সুতির কাছে ভাগীরথীর উৎসমুখটি অগভীর বলে নৌযানে প্রবেশ করা যেত না। ফলে বার্নিয়ারকে স্থলপথে যেতে হয়েছিল। এই ঘটনার প্রায় এক শতাব্দী পরে রেনেল যখন বাংলার জরিপ করেন, তখনও অক্টোবর থেকে মে মাস পর্যন্ত ভাগীরথী শুকিয়ে যেত এবং কলকাতা থেকে ঢাকা যাওয়ার বজরা বা বড় নৌকাগুলি জলঙ্গী হয়ে যাতায়াত করত। পরে যাতায়াত করত মাথাভাঙা-চূর্ণী হয়ে। এখন ওই দুই নদীপথ আর নাব্য নয়। মধ্যযুগে বাংলার বণিকরা বা বিদেশি পরিব্রাজকরা যেসব নৌপথ ব্যবহার করতেন, তা এখন অবলুপ্ত। সপ্তগ্রাম-কেন্দ্রিক নৌবাণিজ্যের পথ সরস্বতী ও আদিগঙ্গা এখন শুকিয়ে গিয়েছে। যে গঙ্গা এক সময় গৌড়ের পাশ দিয়ে বয়ে যেত, এখন তা অনেক দূর দিয়ে বইছে। পূর্ববঙ্গের ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা, বোড়াল, ইছামতী ইত্যাদি অনেক নদী বদ্ধ জলার রূপ নিয়েছে। নদীমাতৃক বাংলা থেকে নদীরা হারিয়ে যাচ্ছে।
দামোদর তার নিম্নাংশে চিরকাল একই পথে বয়ে চলেনি। ১৬৬০ সালে প্রকাশিত ভ্যান ডেন ব্রোকের মানচিত্রে দেখা যায় দামোদর তখন জাহানাবাদের কাছে দু’টি ধারায় বিভক্ত হতো। প্রথম শাখাটি পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে কালনার কাছে ভাগীরথীতে মিশত আর দ্বিতীয় শাখাটি বর্তমান মজা দামোদরের খাত ধরে রূপনারায়ণের সঙ্গে মিশে হুগলি নদীতে পড়ত। ১৭২৬ সালে ওলন্দাজ ভন লিনেন বাংলার নদীপথের এক মানচিত্র প্রকাশ করেছিলেন। ওই মানচিত্রে দেখা যায় দামোদর তখন বর্ধমানের কাছে দু’টি ধারায় বিভক্ত হতো— পূর্বমুখী শাখাটি আম্বোয়াতে (বর্তমান নাম অম্বিকা কালনা) ভাগীরথীতে মিশত আর দক্ষিণমুখী শাখাটি পাত্রঘাটা (বর্তমান রূপনারায়ণ) মোহনা হয়ে তাম্বলির (তমলুক) পাশ দিয়ে বয়ে যেত। এই পথেই এখন দামোদরের শাখা মুণ্ডেশ্বরীর জলস্রোত রূপনারায়ণের মোহনার দিকে বয়ে যায়। কিন্তু ১৭৮০ সালে প্রকাশিত রেনেলের মানচিত্রে দেখা যায় দামোদরের গতিপথ আমূল বদলে গিয়েছে। পূর্বমুখী শাখাটি মজে গিয়েছে এবং নতুন নাম হয়েছে বাঁকা। যে নদীটি এখন গলসীর কাছে লোয়া-গ্রামের মাঠ থেকে উৎপন্ন হয়ে পালসিট পর্যন্ত দামোদরের মূল স্রোতের সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে বয়ে এসেছে, তারপর কিছুদূর উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে লক্ষ্মীপাড়ায় কুঁয়ে নদীর সঙ্গে মিশেছে এবং পরে সেই মিলিত ধারা মালতিপুরে ভাগীরথীতে পড়েছে। দক্ষিণমুখী শাখাটি রূপনারায়ণ ছেড়ে নতুন পথ করে নিয়ে ফলতার বিপরীত দিকে ভাগীরথীতে মিশছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে দামোদর নদীতে বর্ধমান পর্যন্ত সারা বছর নৌ চলাচল করত আর বাঁকা নদী শুধু বর্ষাকালেই নৌপরিবহণের যোগ্য থাকত। মনসামঙ্গলে বর্ণিত কাহিনি থেকে বোঝা যায়, সেই সময় দামোদরের পূর্বমুখী শাখাটি ছিল প্রধান বাণিজ্যপথ এবং এই পথেই চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা প্রথমে দামোদর পরে ভাগীরথী বেয়ে সাগরে যেত। কিন্তু বেহুলার মান্দাস ভেসেছিল প্রথমে বাঁকায় এবং তারই শাখা গাঙুরের জলে। কলা গাছের ছোট ভেলা স্রোতস্বিনী নদী এড়িয়ে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ নদী দিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। দামোদরের অন্য একটি শাখার নাম বেহুলা আর এই নদীটি গাঙুর থেকে বেরিয়ে ভাগীরথীতে মিশত। তাম্রলিপ্তই যে বাংলার প্রাচীনতম বন্দর একথা সংশয়াতীত। এই বন্দরটি খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দ থেকে ৭০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সক্রিয় ছিল। ১৯৫৪-’৫৫ ও ১৯৭২-’৭৩ সালে উৎখননের সময় পাওয়া নানা পুরাবস্তু থেকে মনে করা হয় যে, ওই প্রাচীন বন্দরের অবস্থান ছিল তমলুকের ১০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে মহিষাদলের কাছে। এই দু’টি স্থানই (তমলুক ও মহিষাদল) রূপনারায়ণ নদীর ডান পাড়ে আর এই নদীটি আরও ৪ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে গেঁওখালিতে হুগলি নদীতে মিশেছে। তাম্রলিপ্তের সমসাময়িক অন্য একটি বন্দর হল গঙ্গা বন্দর বা গাঙ্গে। ভাগীরথীর শাখা বিদ্যাধরী নদীর অববাহিকার চন্দ্রকেতুগড়, খনা-মিহিরের ঢিপি, ইটখোলা ও নুনগোলায় ১৯৫৬-’৫৭ এবং ১৯৬৫-’৬৬ সালে উৎখননের সময় যে সব পুরাবস্তু পাওয়া গিয়েছে সেগুলি পর্যবেক্ষণ করে মনে করা হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ অব্দ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলের সঙ্গে রোম ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল এবং এখানেই ছিল গঙ্গা বন্দর। কিন্তু তাম্রলিপ্ত থেকে মাত্র ৯০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত অন্য একটি সমসাময়িক বন্দর কেন ইতিহাসে অবহেলিত তার উত্তর খোঁজা একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয়। একটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন, ফা হিয়েন, হিউয়েন সাঙ, ইৎ-সিঙ তাম্রলিপ্তে এসেছিলেন বৌদ্ধ সংস্কৃতি চর্চার জন্য আর এই বন্দর তখন গঙ্গার মূল শাখার তীরে অবস্থিত। কিন্তু গঙ্গা বন্দরের তেমন ঐতিহ্য ছিল না বলেই হয়তো পরিব্রাজকরা ওই স্থানের উল্লেখ করেননি। গত কয়েক শতাব্দীতে ভাগীরথীর শাখা সরস্বতী, যমুনা, বিদ্যাধরী, আদিগঙ্গা ইত্যাদি শুকিয়ে গিয়েছে আর তার ফলে বারে বারে প্রভাবিত হয়েছে নৌবাণিজ্য। ইতিহাস, ভূগোল ও পুরাতত্ত্বকে মিলিয়ে এই অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান করা প্রয়োজন।
অনেকের ধারণা, মঙ্গলকাব্যে যে নৌবাণিজ্যের কথা আছে, তা অষ্টম শতকের। কারণ পরবর্তী কালে বাংলার নৌবাণিজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। কয়েক শতাব্দী ধরে লোকমুখে প্রচলিত কাহিনি পরবর্তীকালে লিপিবদ্ধ করার সময় কবিদের সময়ের ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষিত প্রতিফলিত হওয়াই স্বাভাবিক, ছন্দ বা অনুপ্রাসের প্রয়োজনে অতিরঞ্জিত তথ্য পরিবেশনও অস্বাভাবিক নয়। যেমন— ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রাম প্রসঙ্গে বিপ্রদাশ পিপলাই লিখেছিলেন, ‘গঙ্গা আর সরস্বতী যমুনা বিশাল অতি।’ অথচ, যমুনা কোনও কালেই বিশাল নদী ছিল না। এই নদীটি ছিল ভাগীরথীর একটি শাখা যা কাঁচরাপাড়া থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে চারঘাটে ইছামতীতে মিশত।
মনসামঙ্গলের চাঁদ সদাগর বাস করতেন দামোদরের তীরে অবস্থিত চম্পকনগরীতেষ আর চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি ও তাঁর পুত্র শ্রীপতির বা শ্রীমন্তের বাস ছিল অজয়ের পাড়ে উজানিনগরে। মঙ্গলকাব্যে দেখা যায়, এই তিন শ্রেষ্ঠীই সমুদ্রযাত্রার সময় ত্রিবেণী হয়ে সপ্তগ্রামে গিয়েছিলেন— সম্ভবত পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ ও জাহাজ বোঝাই করার প্রয়োজনে। চণ্ডীমঙ্গলের রচয়িতা শ্রীমন্তের যাত্রাপথের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি যাত্রা করছেন বসন্তকালে (অর্থাৎ উত্তরে বাতাসে পাল তুলে) আর তাঁর সপ্তডিঙা ইন্দ্রাণী (কাটোয়ার কাছে অবস্থিত বাণিজ্যনগরী), পূর্বস্থলী, নবদ্বীপ, সমুদ্রগড়, শান্তিপুর, গুপ্তিপাড়া, হালিশহর হয়ে ত্রিবেণীতে পুণ্যস্নান ও দু’দিন বিশ্রামের জন্য থেমেছিল। এছাড়াও অন্য উদ্দেশ্য ছিল সপ্তগ্রাম থেকে জাহাজে পণ্যদ্রব্য বোঝাই করে নেওয়া। সেখানকার বণিকরা স্বভাবে অলস এবং তাঁরা বহির্বঙ্গে যেতেন না। মুকুন্দরাম লিখেছেন— ‘সপ্তগ্রামের বণিক কোথাহ না জায়/ঘরে বস্যা সুখমোক্ষ নানা ধন পায়।’ এখান থেকে আবার যাত্রা করে তিনি গরিফা, বেতর, নবাসন, ছত্রভোগ হয়ে মগরায় সাগরের মোহনায় পৌঁছে প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ে পড়েন। স্থান নাম থেকে বোঝা যায় শ্রীমন্তের জাহাজ চলেছিল ভাগীরথী-আদিগঙ্গার পথ ধরে আর এই নদীটি পশ্চিমে গঙ্গাসাগর মোহনাকে ছেড়ে সপ্তমুখী মোহনা দিয়ে সাগরে মিশত।
মনসামঙ্গলের নায়ক চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙাও থেমেছিল ত্রিবেণীর ঘাটে। সেখানে তিনি ভাবলেন— ‘দেখিব কেমন সপ্তগ্রাম’। সেই কৌতূহল নিরসনের পর চাঁদের সপ্তডিঙা আবার ভাগীরথী নদীপথে চলেছিল সাগরের দিকে। তাঁর চলার পথে দেখা গিয়েছিল হুগলি, ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, মুলাজোড়, গাড়ুলিয়া, ভদ্রেশ্বর, চাঁপদানি, ইছাপুর, শুকচর, রিষড়া, কোন্নগর, আড়িয়াদহ, বেতর ইত্যাদি নানা স্থান। লক্ষণীয় শ্রীমন্ত ও চাঁদ সদাগর সপ্তগ্রাম থেকে ভাগীরথী হয়ে আদিগঙ্গার পথ ধরেছিলেন। বিপ্রদাশ লিখেছেন— ‘কালীঘাটে চাঁদ রাজা কালিকা পূজিয়া/ চুড়াঘাট বাইয়া যায় জয়ধ্বনি দিয়া/ ধনস্থান এড়াইল বড় কুতূহলে/ বাহিল বারুইপুর মহাকোলাহলে।’ কয়েক শতাব্দী পরে এই সময় আদিগঙ্গার মজে যাওয়া খাতের দিকে তাকালে কল্পনা করাও কঠিন এই এই পথেই চাঁদ সদাগর সপ্তডিঙা নিয়ে বাণিজ্যে গিয়েছিল।
পর্তুগিজরা যখন সপ্তগ্রাম আসে তার আগেই সেখানে অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৫৮৩ সালে ভারতে এসেছিলেন ইংরেজ বণিক র্যালফ ফিচ। তিনি আগ্রা থেকে শতাধিক নৌকা বোঝাই নুন, আফিম, কার্পেট ইত্যাদি নিয়ে যখন বাংলায় আসেন তখন সরস্বতী শুকিয়ে যাচ্ছে, বন্দর হিসেবে সপ্তগ্রামের গুরুত্ব হ্রাস পেলেও বাণিজ্য নগর হিসেবে তখনও যথেষ্ট সমৃদ্ধ এবং ছোট বন্দর নামে পরিচিত। এখান থেকে পণ্যসামগ্রী বড় নৌকায় নিয়ে যাওয়া হতো। ফিচ লিখেছেন একটি নৌকায় ২৪ বা ২৬ জন মাঝি দাঁড় বাইত। তখন বিকল্প বন্দর হিসেবে হুগলি গড়ে উঠেছে। সিজার ফ্রেডরিক (১৫৮৮) লিখেছেন, ‘সপ্তগ্রামে প্রতি বছর ৩০-৩৫ ছোট জাহাজ চাল, বস্ত্র, লাক্ষা, চিনি ইত্যাদি বহন করে আনে আর তিনি দেখেছিলেন চট্টগ্রামে মাত্র ১৮টি জাহাজ চাল, চিনি, ভুট্টা ও অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে বাণিজ্য করছে। সরস্বতী তখন নৌ চলাচলের অযোগ্য আর ভাগীরথী হয়ে সপ্তগ্রামে যাওয়াও সহজ ছিল না— বিশেষত ভাটার সময়। বড় জাহাজগুলি হাওড়ার বেতোড়ে নোঙর করত আর সেখান থেকে পণ্যসামগ্রী ছোট ছোট বজরায় বোঝাই করে সপ্তগ্রামে আনা হতো। নাব্যতার এই সমস্যার জন্য পর্তুগিজরা ১৫৭৯ সালে ত্রিবেণী থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে হুগলিতে নতুন বন্দর গড়ে তোলে। পর্তুগিজরা বাংলায় বাণিজ্য শুরু করেছিল সম্রাট আকবরের অনুমতি নিয়ে। কিন্তু পরবর্তী কালে তাদের আগ্রাসী মনোভাব, স্থানীয় মানুষদের ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা এবং জলদস্যুতা সম্রাট জাহাঙ্গিরের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে এবং তিনি ১৬৩২ সালে হুগলি আক্রমণ করেন। অনেক পর্তুগিজকে বন্দি করে আগ্রায় নিয়ে যান। ১৬৬৮ সালে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম জয় করার পর বাংলার নৌবাণিজ্যে পর্তুগিজ আধিপত্যের অবসান হয়। এর পরে ইংরেজ আমলের নতুন বন্দর গড়ে ওঠে কলকাতা আর স্বাধীনতা-উত্তর কালে হলদিয়া। নদীর নাব্যতা যত কমেছে বন্দর ক্রমশ বঙ্গোপসাগরের দিকে সরে এসেছে।নদীমাতৃক বাংলা থেকে নদীরা হারিয়ে যাচ্ছে। গত কয়েক শতাব্দীতে কত নদী হারিয়ে গিয়েছে তার তালিকা আমাদের হাতে নেই। বাংলাদেশ ছয় খণ্ডে ওই দেশের নদীর তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রতিটি নদীকে একটি সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এপার বাংলায় এমন কথা কেউ ভাবেননি। নদীর কথা না জানলে নদীমাতৃক বাংলার ভূগোল বা ইতিহাস জানার চেষ্টা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
ছবি : ইন্দ্রজিৎ রায়
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস