ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
১৯৭৮ সাল। ২ জানুয়ারি। নয়াদিল্লিতে কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশন। আড়াআড়ি দু’ভাগ হয়ে গেল ওয়ার্কিং কমিটি আর কংগ্রেসের এমপিরা। রেড্ডির সঙ্গে থেকে গেলেন অধিকাংশ বর্ষীয়ান কংগ্রেসি। আর ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বেরিয়ে এলেন সিংহভাগ সাংসদ। জন্ম নিল ইন্দিরা কংগ্রেস। সঞ্জয় গান্ধী যে ভুল বলেননি, তার প্রমাণ মিলল বিধানসভা ভোটেই। রেড্ডির রাজ্য অন্ধ্রে বিপুল জয় পেল ইন্দিরার কংগ্রেস। ২৯৪টি আসনের মধ্যে ১৭৫টিরই দখল নিল ম্যাডাম গান্ধীর নয়া পার্টি। একই ছবি কর্ণাটকেও। শুধু তাই নয়, মহারাষ্ট্রেও ভরাডুবি হল রেড্ডি কংগ্রেসের। জরুরি অবস্থার গেরো কাটিয়ে ধীরে ধীরে তখন আবার ছড়াচ্ছে ম্যাডামের রাজনৈতিক গ্ল্যামার। পরের লক্ষ্যও স্থির... মোরারজি দেশাইয়ের পতন।
অবাক চোখে রাজীবের সেক্রেটারির দিকে তাকালেন সোনিয়া। ওঁকে কি ফ্লাইটের খোঁজ নিতে বলেছিলাম? মনে পড়ছে না সোনিয়ার। কিছুই এখন আর মনে থাকে না। চোখের সামনে শুধু ভাসে একটা ধ্বংসস্তূপ... রক্ত... আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শরীরের টুকরো... রাজীবের। কী করব? পাড়ি দেব ইতালি? মা বলেছেন, ‘মনে হয় এবার তোমার ফিরে আসা উচিত।’ গলা জড়িয়ে গিয়েছে। মনজুড়ে ভাবনার ঝড়... আবার একটা নতুন শুরু? ছেলেমেয়ের নিরাপদ ভবিষ্যৎ... রাজনীতি থেকে... মৃত্যুর আশঙ্কা থেকে বহুদূরে? নাকি এখানেই থেকে কয়েকটা স্মৃতির অভিভাবকত্ব করা... স্মৃতিগুলো বয়ে চলা... নিরন্তর। বহন করা নেহরু-গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিক ঐতিহ্যকে। কত লোক এসেছিল রাজীবের শেষযাত্রায়...! মানুষ ভালোবাসে এই পরিবারকে। সম্মান করে। সেই সম্মানের মর্যাদা রাখাটাও যে কর্তব্য!
‘মা... মনে হচ্ছে, আমার জীবনটা এখানেই...।’
দু’বছর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মোরারজি। কিন্তু একদিনের জন্যও তাঁকে চরণ সিং ও রাজনারায়ণ জুটি স্বস্তি দেয়নি! সরকার বিরোধী কার্যকলাপের জন্য কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষমেশ সাফল্য হাতে আসেনি তাঁর। বরখাস্ত করেও ফের মন্ত্রিসভায় তিনি ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন চরণ সিংকে। অবশ্য তখন তাঁর গোঁ ছিল একটাই—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক আর দেব না। উপ-প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং পাশাপাশি অর্থমন্ত্রক... এই ছিল চরণ সিংয়ের সান্ত্বনা পুরস্কার। আপাতত। কোণঠাসা বাঘের মতো সুযোগ খুঁজছিলেন তিনি। আর সেটাই মোক্ষম ধরে ফেলেছিলেন সঞ্জয় গান্ধী। এ ক্ষেত্রে তাঁর দাবার বোড়ে ছিলেন কপিল মোহন... তখন ভারতের বৃহত্তম মদ প্রস্তুতকারক সংস্থা মোহন মেকিনয়ের মালিক। একাধারে কান্তি দেশাইয়ের বন্ধুবিশেষ, আবার উল্টোপিঠে সোশ্যালিস্ট পার্টির রাজ নারায়ণের ঘনিষ্ঠ। চৌধুরী চরণ সিংয়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষার দোসর ছিলেন রাজ নারায়ণ। সঞ্জয় বুঝেছিলেন, এটাই সুযোগ... পাল্টা আঘাত হানার। মোরারজি দেশাইয়ের মদ বর্জন নীতি পথে বসাবে... এই আশঙ্কা কপিল মোহনের ছিলই। তাই তিনিও চেয়েছিলেন, যেভাবে হোক জনতা সরকার বিদেয় হোক। কান্তি দেশাইয়ের আড্ডাক্ষেত্রে কী চলত, তার সবটাই তিনি উগরে দিতেন বিরোধী শিবিরের কাছে। সঞ্জয় গান্ধীকে তিনিই বুদ্ধি দিয়েছিলেন, রাজ নারায়ণের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সরকার ভাঙার চেষ্টা করো। বলেছিলেন, ‘তুমি একদিন রাজ নারায়ণের সঙ্গে কথা বলো। আমি ব্যবস্থা করছি।’ প্রথম বৈঠক হল গাড়িতে। তারপর একে একে। সঞ্জয়ের কাছে তখন গোটা ব্যাপারটা পরিষ্কার— চরণ সিং এবং রাজনারায়ণ জোট ভেঙে বেরিয়ে আসতে আগ্রহী। সঙ্গে আসবেন শ’খানেক এমপি। তবে, সরকার গঠনে ইন্দিরাকে পাশে থাকতে হবে। নিঃশর্তভাবে। সেই ছিল প্রথম পদক্ষেপ... ঘুরে দাঁড়ানোর।
সোনিয়া তাকিয়ে রয়েছেন তাঁদের দিকে... কংগ্রেসের নেত্বত্ব... কেউ ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ, কেউ রাজীবের, আবার কেউ আদ্যোপান্ত দলের বিশ্বস্ত কর্মী। কিন্তু জীবনটা যে বড্ড নিষ্ঠুর সময়ের মধ্যে দিয়ে চলছে। হাসতে ভুলে গিয়েছেন সোনিয়া। এমন একটা সময়ে এই প্রস্তাব?
—আমরা প্রত্যেকে এই বিষয়ে একমত। আপনি দায়িত্ব গ্রহণ করুন।
—আমি এটা পারি না। আপনারা জানেন, রাজনীতি আমার জীবন নয়... বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য নয়। আমি এর থেকে অনেক দূরে।
—বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন দলের সর্বময় ক্ষমতা আপনার সামনে রুপোর প্লেটে সাজিয়ে আমরা নিয়ে এসেছি। এই দেশ আপনি একদিন শাসন করতে পারবেন। সবথেকে বড় কথা, আপনার স্বামীর উত্তরসূরি হিসেবে দাঁড়াবেন আপনি। যাতে তাঁর মৃত্যুটা বিফলে না যায়...
—এ ব্যাপারে কথা বলার এখন সঠিক সময় নয়।
—আপনি আমাদের সবরকম সহযোগিতা পাবেন। আপনি শুধু পরিবারের ধারা বজায় রাখুন
—১০০ কোটির মহান দেশ ভারত... এখানে সবার থেকে আলাদা হয়ে উঠে দাঁড়াতে আমি পারব না। সেই যোগ্যতা আমার নেই।
—কিন্তু আপনিই তো একমাত্র গান্ধী...!
—আমার মনে হয়, আপনাদের নরসিমা রাওকেই বেছে নেওয়া উচিত। রাজীবও ওঁর কথাই বলতেন।
মে মাস। সংসদের আস্থা হারাল বিজেপি। সোনিয়া দাবি করলেন, আমরা সরকার গড়ব। আর তারপরই তিনি বুঝলেন... ভারতের মেয়ে হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। কংগ্রেসের নেতারা তাঁকে যা বুঝিয়েছিলেন, ততটা মসৃণ নয় রাজনীতির পথ। বিদ্রোহ হল দলে... ‘সোনিয়া বিদেশিনী’। শারদ পাওয়ার, পি এ সাংমা, তারিক আনোয়ার... ভেঙে গেল দল। সীতারাম কেশরীর বিরুদ্ধে সরব হয়ে তার ঠিক আগেই বেরিয়ে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শারদ পাওয়াররা। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন না সোনিয়া। বিদেশিনী ইস্যুতে বহু আঞ্চলিক ও ছোট দল কংগ্রেসকে সমর্থনে বেঁকে বসল। থমকে গেলেন সোনিয়া।
—‘তুমি কি তাহলে এবার সরে যাবে?’ জিজ্ঞেস করলেন রাহুল।
—এখন? এখন কি সরে যাওয়ার সময়? নিজেকে প্রমাণ করার আগে নয়।
বাইরের থেকে আঘাত প্রত্যাশিত। কিন্তু নিজের ঘর... নিজের পার্টি! এই ধাক্কা সামাল দেওয়া সহজ নয়। সোনিয়া সেটা বুঝেছিলেন। তাও পিছু হটেননি তিনি। দ্রুত শিখতে পারেন তিনি... এটাই তাঁর ইউএসপি। আর সেই ভরসাতেই আবার নতুন করে গুছাতে শুরু করলেন তিনি। ‘দলের জন্য কাজ করতে এসেছি... কোনও পদের লোভে নয়! কারণ, এখন পার্টির দুঃসময়... অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে কংগ্রেস। এখন আমি হাত গুটিয়ে থাকতে পারব না।’
১৮ মে, ২০০৪। ওয়াশিংটন ডিসিতে একটি সেমিনারে বসে আছেন মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া। যোজনা কমিশনের এক সময়ের চেয়ারম্যান, মনমোহন সিংয়ের বন্ধু। খবরটা তিনি সেখানেই পেলেন... সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন না। অথচ, এটাই ছিল স্বাভাবিক! সবাই ধরে নিয়েছিলেন, সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া থেকে আর কেউ রুখতে পারবে না। কিন্তু সব অঙ্ক ভুল... সোনিয়া গান্ধী ঘোষণা করলেন মনমোহন সিংয়ের নাম... ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
২২ মে... শনিবার। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ফিরছেন সোনিয়া গান্ধী। এখন শান্তি... গত তিনদিন দলের মধ্যেই প্রচুর প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে... ‘আপনি সিদ্ধান্ত বদলান’। কিন্তু সোনিয়া অটল থেকেছেন। প্রথম শিখ প্রধানমন্ত্রী... যাঁকে শপথবাক্য পাঠ করালেন একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বী রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম। আর নেপথ্যে... ইতালীয় বংশোদ্ভূত, জন্মসূত্রে ক্যাথলিক এক মহিলা... সোনিয়া মাইনো গান্ধী।
১) ইন্দিরার পাশে একজন সঞ্জয় গান্ধী ছিলেন। রাজনীতি এবং কূটনীতির সিদ্ধান্তে তাঁর উপর অনেকটাই নির্ভর করতেন ইন্দিরা। তার জন্য ধাক্কাও অবশ্য কম খেতে হয়নি! সঞ্জয়ের আগ্রাসন এবং অনেক ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত ইন্দিরাকে অপদস্থ করেছে। বিষিয়েছে মানুষের মন। তাও সঞ্জয়ের কূটনীতি ফেলে দেওয়ার মতো ছিল না। সোনিয়ার পাশে কিন্তু কোনও সঞ্জয় নেই। বরং ‘পরামর্শদাতা’ বলতে আছেন রাহুল গান্ধী। এক যুগ পরেও যাঁর কোনও রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। দলের বাইরে তো নয়ই, মধ্যেও নয়।
২) ইন্দিরার জমানায় কংগ্রেস ভেঙেছে। তারপরও বিশ্বস্ত সৈনিকের অভাব ছিল না। পণ্ডিতজি... অর্থাৎ কমলাপতি ত্রিপাঠি ইন্দিরাকে বলতে পারতেন, ‘চরণ সিংকে বিশ্বাস করা যায় না। তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থনে আমার সায় নেই।’ ইন্দিরা গান্ধী রাজনৈতিক স্বার্থে এই পরামর্শ হয়তো মেনে নেননি, কিন্তু সতর্ক হয়েছিলেন। সেইমতো সাজিয়েছিলেন রণকৌশল। ছিলেন কমল নাথ। চরণ সিংয়ের মুখোমুখি বসে চ্যালেঞ্জ ছোড়ার ক্ষমতা ছিল তাঁর। কতই বা বয়স ছিল তখন? মাত্র ৩৩ বছর। তারপরও তিনি প্রধানমন্ত্রী চরণ সিংয়ের সামনে বসে বলেছিলেন, ‘তাহলে কি আমরা ধরে নিতে পারি যে, আপনি আমাদের সহযোগিতা চান না?’ আহমেদ প্যাটেলের প্রয়াণের পর এমন সৈনিক বা সেনাপতি সোনিয়ার আস্তিনে নেই। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী মূলস্রোতের রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কিন্তু এখনও তিনি শিক্ষানবীশ। অর্থাৎ, মাথা খাটানোর কাজ পুরোটাই সোনিয়ার।
৩) ইন্দিরা গান্ধী মানসিকভাবে যতটা শক্ত ছিলেন, ততটাই অসুখ-বিসুখ থেকে দূরে থাকতেন তিনি। সোনিয়ার পরিস্থিতি একেবারেই বিপরীত। ২০১৩ সালের আগস্ট মাস। রাত ১২টা বেজে গিয়েছে। প্রবল প্রতিরোধ সামলে খাদ্য সুরক্ষা বিল পাশ হল। বেরিয়ে আসছেন সোনিয়া গান্ধী। আচমকাই টাল খেয়ে গেলেন। পড়েই যেতেন... ঝটিতি ধরে নিলেন কুমারী শেলজা। সেদিন থেকেই বোঝা গেল... শরীর আর সঙ্গ দিচ্ছে না তাঁর। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হয়েছে তাঁকে। অবসর নিয়েছেন। কিন্তু আবার ফিরে এসেছেন... বাধ্য হয়েছেন। কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ঘোষণা করেছেন, ‘আমিই ফুল টাইম সভানেত্রী’। সমঝেছে দল। বিদ্রোহীরাও।
এবং ৪) ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিপক্ষ ছিলেন অনেক... কিন্তু তাঁরা প্রত্যেকেই ইন্দিরার তুলনায় মাঝারি স্ট্যান্ডার্ডের। সোনিয়ার প্রতিপক্ষ কিন্তু নরেন্দ্র মোদি...।
বাংলার মতো বহু রাজ্যেই কংগ্রেস এখন কার্যত সাইনবোর্ডে পরিণত। নরেন্দ্র মোদির বিকল্প কে হতে পারেন? এটাই এখন জনতার প্রশ্ন। বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্যই বিরোধী রাজনীতির মুখ। কিন্তু তাঁর একার পক্ষে জাতীয় স্তরে বিজেপির মতো মহীরুহের টক্কর দেওয়া সম্ভব নয়। জোট দরকার... ভীষণভাবে। কারণ, শাসক কীই না পারে!
তাও কংগ্রেসের সম্ভাবনা এখনও মরে যায়নি। কারণ, সোনিয়া গান্ধী এখনও বেঁচে। আর রয়েছে ইতিহাস... তার পুনরাবৃত্তির প্রবণতা। প্রশ্ন একটাই—ইন্দিরা পেরেছিলেন... সোনিয়া কি পারবেন? চ্যালেঞ্জ সামনে... ২০২৪। কংগ্রেস কি সত্যিই বেঁচে উঠবে?
ইন্দিরাও অজানা-অচেনা কোনও জায়গা থেকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছেন... প্রিয় পূত্রবধূর দিকে।
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়