ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
ভূ-উষ্ণায়ন ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস
উত্তরমেরুর বরফ গললে স্বাভাবিক ভাবেই সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা ৪ থেকে ৯ ফুট বাড়বে। তাতে ২০৫০-এর মধ্যেই সুন্দরবনসহ সাগর দ্বীপপুঞ্জ মায় কলকাতার হতে পারে সলিলসমাধি। ডুববে মুম্বই, চেন্নাইও। তার আগাম পূর্বাভাস মিলছে বানভাসি কলকাতা, মুম্বই বা চেন্নাই-এর দুরবস্থা দেখেই। কিছুদিন আগে ‘নেচার কমিউনিকেশনস’-এ স্কট এ কাল্প এবং বেঞ্জামিন এইচ স্টাউস ‘নিউ এলিভেশন ডাটা, ট্রিপল অব গ্লোবাল ভালনারেবিলিটি টু সি-লেভেল রাইজ অ্যান্ড কোস্টাল ফ্লাডিং’ শীর্ষক একটি গবেষণা নিবন্ধে দেখিয়েছেন— বেশিদিন নয়, আগামী ৩০ বছরের মধ্যেই মানচিত্র থেকে সাগরদ্বীপ, সুন্দরবনের কিয়দংশ এবং কল্লোলিনী তিলোত্তমা উবে যেতে পারে। বনগাঁ, হাওড়া বা বারাকপুরেরও নাহিকো নিস্তার। দূষণে লাগাম পরাতে না পারলে ডুববে গোটা মুম্বইও। ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ সমুদ্রজলের উচ্চতা বাড়ার কারণে উদ্বাস্তু হবেন ভারতে। ২০৭০-এ ভারতকে ‘নেট জিরোর’ গর্বিত অংশীদার করবেন মোদিজি। ততদিনে অর্ধেক ভারতই যে হাবুডুবু খাচ্ছে সমুদ্রগর্ভে!
পেট্রপণ্যে ভর্তুকির রাজনীতি
গ্লাসগো জলবায়ু সম্মেলনে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইলেও আজও গোটা বিশ্ব পেট্রপণ্যে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয়। সমগ্র বিশ্বের জিডিপি-র ৭ শতাংশ ব্যয়িত হয় পেট্রপণ্যে ভর্তুকি বাবদ। ধনী, উন্নত দেশগুলোরই পেট্রপণ্যে ভর্তুকির পরিমাণ সর্বাধিক। অজস্র গাড়ি, বিলাস-ব্যসন-বৈভবে, গ্রিনহাউস গ্যাসের লাগামছাড়া উদগিরণেও সমান অপরাধী তারা। ধনী দেশগুলোর কৃতকর্মের খেসারত দিচ্ছে ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের নুন আনতে পান্তা ফুরনো দেশগুলো। তাই মন্ট্রিয়েল থেকে কিয়োটো, প্যারিস হয়ে গ্লাসগো, ২৬টা জলবায়ু সম্মেলন পার করেও, অযুত সবুজ প্রতিশ্রুতির বিলোল কটাক্ষের পরেও ধরিত্রী থেকে যায় ঊষর-ম্যাড়মেড়ে-বিবর্ণ-ধূলিমলিন।
প্রতিবছর ভিটে-মাটি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হন ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলের অগুনতি মানুষ। সরকার প্রকৃতির রুদ্ররোষকে সামলাতে নামকাওয়াস্তে ব্যয় বরাদ্দ করে। সে টাকা সাতভূতে লুটেপুটে খায়। অবৈজ্ঞানিক মাটি বা কংক্রিটের বাঁধ এবং টেট্রাপোরের নামে বরাদ্দকৃত অর্থের ভাগ-বাঁটোয়ারায় সাগর ব্লকের ঘোড়ামারা-খাসিমারা-ধবলাট-মনসাদ্বীপ-সুমতিনগর-বঙ্কিমনগর-গোবিন্দপুর-শিকারপুর-মুড়িগঙ্গাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে বুভুক্ষু সমুদ্র। একদা সম্পন্ন পরিবারগুলো পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে চোখের জল ফেলতে ফেলতে পাড়ি জমায় কেরলে। পড়াশোনায় দাঁড়ি পড়ে ছেলেমেয়ের।
কপ ২৬, অসাড় প্রতিশ্রুতির বন্যা
গ্লাসগোর মঞ্চ থেকে সোচ্চারে ঘোষিত হল— গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণকে ২০৩০-এ বর্তমানের ৫২.৪ গিগাটনের জায়গায় নামিয়ে আনা হবে ৪১.৯ গিগাটনে। ভূ-উষ্ণায়নকে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি বেঁধে রাখতে হলে ২০৩০-এই গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে ২৬.৬ গিগাটন করা প্রয়োজন। অর্থাৎ ক্ষতিকর গ্যাসের নিঃসরণ সেইসময়েই কমাতে হবে ৪৫ শতাংশ। ২০৫০-এ গোটা বিশ্বকে পৌঁছতে হবে ‘নেট জিরো’তে।
ডিসেম্বরের শেষে ‘ওপেক’ প্রতিদিন ৪ লক্ষ ব্যারেল অশোধিত তেল জোগান দেবে বলেছে। কপ ২৬-এর মঞ্চ থেকে নেমেই বাইডেন ‘ওপেক’কে অনুরোধ করলেন তেলের জোগান ৪ লক্ষ ব্যারেলের কিছু বেশি বাড়াতে। অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারের এখানেই শেষ নয়। চিরশত্রু চীন-আমেরিকা একজোট হয়ে ঘোষণা করল ভূ-উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে বেঁধে রাখতে হাতে হাত ধরে কাজ করবে তারা। ব্রাজিল সহ ১০০টি দেশ অঙ্গীকার করল ২০৩০-এর মধ্যে সর্বশক্তি দিয়ে তারা বনসৃজনে ঝাঁপাবে। অথচ, ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে ফুটবল মাঠের সাইজের অ্যামাজনের জঙ্গল হরবখত বিক্রি করে দিচ্ছে ব্রাজিলই। আমেরিকা-চীন-ব্রাজিল-ভারতের সৌজন্যের বহর দেখে চুনোপুঁটি ৪০টি দেশ লজ্জায় অধোবদন হয়ে বলল তারা আর কয়লা পোড়াবে না! সবচেয়ে বেশি কয়লা পোড়ায় চীন ও আমেরিকা আর তারাই কপ ২৬ রঙ্গমঞ্চে রইল নীরব-নিশ্চুপ।
ভূ-উষ্ণায়নজনিত বন্যা-খরা-ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বিশ্বের প্রতি ৫ জন বিপন্ন মানুষের ৪ জন এশীয়বাসী। ২৭ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ ভূ-উষ্ণায়নে হবেন উদ্বাস্তু। ভারতের এক বিশাল জনসমষ্টিও তার অন্তর্ভুক্ত। ধনী উন্নত দুনিয়ার মানুষ রসিয়ে ঠান্ডাকে উপভোগ করবেন, কাচের জানলার বাইরে ঝিরঝিরে বরফ বৃষ্টি দেখবেন ফায়ার প্লেসে কাঠকয়লা জ্বেলে, মদিরার পাত্র হাতে নিয়ে আর তার খেসারতে উত্তরমেরুর বরফ গলা জলে সমুদ্র ফুঁসে উঠে গ্রাস করবে দীঘা-সুন্দরবন-কলকাতা-মুম্বই-চেন্নাইকে। ঘোড়ামারা বা খাসিমারার সবখোয়ানো মানুষগুলো ঘুণাক্ষরে টেরও পেলেন না, মোদি-বাইডেন-জনসন-বোলসেনোরো তাদের জীবন-সম্পত্তিকে বন্ধক রেখে কি পরিমাণ রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড কপ ২৬-এর মঞ্চ থেকে অনায়াসে তাঁদের ঝুলিতে ভরে নিলেন।
গল্প হলেও সত্যি
ধবলাট, মনসাদ্বীপ। অলস মধ্যাহ্ন গুটিগুটি পা বাড়াচ্ছে বিকেলের দিকে। রুপোলি থালার পশ্চিমী সূর্য লুকোচুরি খেলছে দিগন্তবিস্তৃত ধ্যানমগ্ন নিস্তরঙ্গ শান্ত সমুদ্রের বুকে। সর্বশেষ জনগণনায় ধবলাটে ১ হাজার ২২৪টি বাড়িতে ৬ হাজার ৮২৭ জন মানুষ বাস করতেন। ‘যশ’-এর পর জনসংখ্যা কমে হয়েছে অর্ধেক। গ্রামের মাঝ বরাবর চলে যাওয়া মাটির বাঁধের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে মাঝবয়সি অশোক পণ্ডিত। চোখেমুখে একরাশ হতাশা। নীচে নারকেল গাছের তলায় দুমড়ে মুচড়ে পড়ে বাঁশ, ত্রিপল, মাটির হাঁড়ি-কলসির টুকরো। ভাঙা সংসারের সজীব উপস্থিতি। সামুদ্রিক ঝড়জলে পাঁচবার তিনি গৃহহারা। বর্তমানে তিনি কেরলের পরিযায়ী শ্রমিক, দুই ছেলের পড়ার খরচ আর তিনি টানতে পারছেন না।
ভাটায় তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে সরে সমুদ্র আনমনে এক্কাদোক্কা খেলছে। পাড়ের দিক থেকে সমুদ্রের গভীরে যতদূর চোখ যায় মাথা উঁচিয়ে আছে বাঁশের ছোট ছোট খুঁটি। তিন মিটারের খুঁটির পুরোটাই প্রায় বালির নীচে অন্তঃসলিলা। বাঁশের খুঁটি আসলে ইটবাঁধানো রাস্তার নিশান। ৬ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত সোজা রাস্তা, সম্পন্ন জনপদ, বিঘের পর বিঘে ধানের জমি সটান সমুদ্রগর্ভে। বড় বড় ঢেউ ভাঙছে সেখানে। অশোকবাবু না বললে বিশ্বাস করা শক্ত কিছুদিন আগেও সেখানটা ছিল বহু মানুষের কলরব-কোলাহলে পূর্ণ। ধবলাটের সেই হতভাগ্য মানুষগুলো স্বপ্নেও ভাবেননি দিকচক্রবালের অতলান্ত নির্লিপ্ত সমুদ্র হঠাৎই আড়মোড়া ভেঙে তেড়ে এসে গিলে খেতে পারে তাদের!
সরকারি হিসাবে গোবিন্দপুরের জনসংখ্যা ছিল ২ হাজার ৪২০। এক ‘যশ’-এ জনসংখ্যা তলানিতে। মাটির বাঁধ টপকে সন্তর্পণে জনমানবহীন গ্রামের মাঝখানে গেলে কেবল টের পাওয়া যায় নাম না জানা হরেক পাখির সুরেলা কলকাকলি। দু-একটি ছাগল অচেনা মানুষ দেখে ম্যা ম্যা করে ওঠে। পথের ধারে আজও বিরাজমান ‘যশ’-এর প্রবল-প্রতাপী স্মৃতিচিহ্ন। গোবিন্দপুরের পাশের গ্রাম বঙ্কিমনগর। সর্বশেষ আদমশুমারি অনুযায়ী ৪ হাজার ২৭৪ জন মানুষের বাস। কাকলি ভুঁইয়া দূরে দেখালেন ‘যশ’-এ ধসে যাওয়া তার বাড়ির খণ্ডহর। মাঝ-সমুদ্রে উঁকি দিচ্ছে বাঁধের ধ্বংসাবশেষ। ‘যশ’-এর আলতো টোকায় খসে গিয়েছে বাঁধের গরিমা। বর্তমানে পাশেই আবারও চলছে নব উদ্যমে কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ। কাকলি দেবী জানেন কংক্রিটের বাঁধ বা টেট্রাপোর প্রকৃতির কাছে নস্যি। ‘যশ’-এর জলোচ্ছ্বাসে ভেসে তিনি একটি দোকানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপর দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীর লোকেরা তিনদিন পর উদ্ধার করে তাঁকে। শিকারপুর বা মুড়িগঙ্গার কাহিনিটাও মোটামুটি এক। এই মানুষগুলোর সীমাহীন দুরবস্থার জন্য দায়ী দূষণ, ভূ-উষ্ণায়ন। দায়ী ধনী-উন্নত দেশগুলোর অসংযমী আচরণ।
ঘোড়ামারা, খাসিমারার শেষের সেদিন
বিগত কয়েক বছরে ঘোড়ামারায় সমুদ্রজলের উচ্চতা বেড়েছে বার্ষিক ২৫০ শতাংশ। গোটা বিশ্বে বছরে সমুদ্রজলের উচ্চতা বাড়ছে ৩.২৩ মিমি হারে, ঘোড়ামারায় সেই হার ৮ মিমি। ঘোড়ামারার আয়তন একদা ছিল ২৬ বর্গ কিলোমিটার। দুর্নিবার ভাঙনে বর্তমানে আয়তন ৬.৭ বর্গ কিলোমিটার। ঘোড়ামারার আত্মজ লোহাচরা বহুকাল বিলীন সমুদ্রগর্ভে। খাসিমারাও প্রহর গুনছে সমুদ্রের বুকে নিঃস্বার্থ আত্মসমর্পণের। কলকাতার পরেই সর্ববৃহৎ পোস্ট অফিস ছিল নাকি ঘোড়ামারাতেই। ৩৬ একর জমির ওপর নির্মিত দোতলা বাড়ি ছিল পোস্ট অফিসের। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায় সেটি। ভাড়া করা এক কামরার ঘরে এখন চলছে পোস্ট অফিস। ঘোড়ামারায় উৎকৃষ্ট পান পাতার চাষ হতো। সব পানের বরজ সমুদ্রের নোনা জলের চৌবাচ্চা। সেখানে মনের সুখে খেলা করে বেড়াচ্ছে ভেটকি মাছ। আগ্রাসী সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ সঞ্জয় কয়াল দূরে আঙুল তুলে দেখান একটি জায়গা— সেখানে দুর্গাপুজো হতো। এবছর দীপাবলির আগে সেখানটাতেই একটি জাহাজ-ডুবি হয়। পাড়ের কাছে অপস্রিয়মাণ একটি চৌখুপি দেখিয়ে স্বগতোক্তির ঢঙে তিনি বলে চলেন এই জায়গাটিতে ছিল একটি মসজিদ। ‘যশ’-এর তাণ্ডবে দিশাহারা সঞ্জয়বাবু মাটির বাড়ি আগলে বসেছিলেন, বেরতে চাননি। পাড়া-প্রতিবেশীরা তাকে টেনে হিঁচড়ে ফ্লাড সেন্টারে নিয়ে যান। দু’দিন অভুক্ত সঞ্জয়বাবুর খিদে-ঘুমের অনুভূতি চলে গিয়েছিল। ফ্লাড সেন্টারে খিচুড়ি রান্না দেখে খিদেটা তার চাগাড় দেয়। একটা প্রবল ঢেউ অতর্কিতে ফ্লাড সেন্টারের খিচুড়ির হাঁড়িকে চ্যাংদোলা করে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। দিনেদুপুরে ঢেউয়ের ধাক্কায় টুক করে সমুদ্রে খসে পড়ল সুউচ্চ খাসিমারা নিম্ন বুনিয়াদি বিদ্যালয়। এইসব অতিপ্রাকৃত দৃশ্যে, হতবুদ্ধি-বিস্ময়াভিভূত খাসিমারা, ঘোড়ামারার অধিকাংশ বাসিন্দা। হয়তো তারা ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’-এরও শিকার।
শ্যামলী মেটে, ‘যশ’-এর সকালে (২৩-২৬ মে’ ২০২০) তাঁর কোলের ছেলেকে নিয়ে প্রথমে একটি খড়ের গাদায় ওঠেন, জল খড়ের গাদা টপকানোর মুহূর্তে গ্রামবাসীরা তাকে টেনে পাশের আমগাছে তুলে আনেন। ভিজে কাপড়ে আমগাছেই দু’দিন-দু’রাত কাটে তাঁর। সাগর ব্লকের প্রতিটা মানুষ ভূ-উষ্ণায়নজনিত সামুদ্রিক রুদ্ররোষের শিকার। এই দুর্বল-অসহায় মানুষগুলোর বুকফাটা কান্নার অস্ফুট মর্মন্তুদ বিলাপের ছিটেফোঁটাও কি কপ ২৬ নামক প্রহসন মঞ্চে কোনওরকম অভিঘাত তুলতে পারল? ‘দি আনসার মাই ফ্রেন্ড ইজ ব্লোইন ইন দি উইন্ড’।
ঋণস্বীকার: বাপি-পিন্টু-পরেশ, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, গ্রামীণ বিকাশ কেন্দ্র, মহেন্দ্রগঞ্জ