ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
ফাঁসির আগে জীবনের চরমতম মানবিকবৃত্তি— যেমন শোক, দুঃখ, ভালোবাসা ইত্যাদির প্রকাশ ঘটেছিল এই চিঠিতে। বহু বিপ্লবী কারাগারে বন্দি অবস্থায় চিঠি পাঠিয়েছেন প্রিয়জনদের কাছে। এ ছাড়াও লিখেছেন আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ইত্যাদি। নজরুল ইসলাম ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’ এইরকম অনেক কবিতা লিখেছেন জেলে বসেই। এই প্রসঙ্গে তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘রাজার পিছনে ক্ষুদ্র, আমার পিছনে রুদ্র। রাজার পক্ষের যিনি, তার লক্ষ্য স্বার্থ, লাভ অর্থ; আমার পক্ষে যিনি তার লক্ষ্য সত্য, লাভ পরমানন্দ।’ অন্যদিকে সুভাষচন্দ্রের লেখা চিঠির ভাষারীতি আমাদের অবাক করে দেয়। তিনি লিখেছেন, ‘...জিজ্ঞাসা করিলেন অদ্বৈত জ্ঞান ব্রহ্ম সত্য, জগন্মিথ্যা— একটা থিয়োরি কিনা? বলিলাম, যতক্ষণ মুখে বলছি, ততক্ষণ থিয়োরি কিন্তু রিয়ালাইজ করিলে সত্য এবং রিয়ালাইজ করা যায়।’
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সূচনা হয়েছিল ১৭৫৭ থেকে। দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন হয়েছে। ইতিহাস বলছে, এইসব আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বাংলার বিপ্লবীরা। জেলবন্দি বিপ্লবীরা কী ভয়ানকভাবে দিন কাটিয়েছেন, তা তাঁদের রোজনামচা পড়লেই অনুভব করা যায়। নগ্ন করে রাখা, ডাণ্ডাবেড়ি পরানো, তালাবন্ধ করে রাখা, বিচারাধীন বন্দিদের বেত্রাঘাত, নখে সুচ বিঁধিয়ে দেওয়া, দিনরাত নির্জন কক্ষে বন্দি করে রাখা ইত্যাদি। কমলা দাশগুপ্ত ‘রক্তের অক্ষরে’ বইয়ের মধ্যে একইরকমের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। জেলখানা প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধী এক জায়গায় বলেছিলেন, ‘জেলগুলি মানুষের সৃষ্ট বাস্তব নরক, কল্পিত নরক নহে।’ এই নরকে বসেই বিপ্লবীরা নিজের খেয়ালে সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছেন।
কারাজগৎ বন্দির দেহকে শৃঙ্খলিত করেছিল বটে, কিন্তু মনকে পারেনি। তাই তাঁদের মনে দার্শনিক জীবনজিজ্ঞাসা, সাহিত্যানুভূতি ও দিব্যদৃষ্টির উন্মোচন ঘটেছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ তখন কারাগারে। দেশবন্ধুর সাপ্তাহিক বাংলা কাগজে ছাপানোর জন্য বাসন্তী দেবী লোক পাঠালেন নজরুলের কাছে। বিদ্রোহী কবি সেখানে বসেই লিখে দিলেন, ‘কারার ওই লৌহ কপাট...’ । এই লেখাটির অন্য একটি প্রাসঙ্গিকতাও আছে। সুভাষচন্দ্র তাঁর বন্ধু দিলীপকুমার রায়কে জেলখানায় বসে লিখেছিলেন, ‘জেলে যখন লোহার দরজা বন্ধ করে দেয়, তখন মনে যে কী আকুলি-ব্যাকুলি করে কী বলব! তখন বার বার মনে পড়ে যায় কাজীর গান। কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট। কাজীকে ভাগ্যিস জেলে যেতে হয়েছিল।’
তবে লেখার জন্যে সবসময় যে জেলখানায় কাগজ-কলম পাওয়া যেত তা কিন্তু নয়। কোনও কোনও রাজবন্দির কাছে অনেক সময় কাগজ-কলম থাকত, কিন্তু সবার কাছে থাকত না। উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’-য় দেখা যায় যে তাঁরা চুন-সুড়কি দিয়ে জেলের মেঝেতে বসে তৈরি করতেন একটা রং। সেই রং দিয়ে তাঁরা দেওয়ালের গায়ে লিখতেন। কখনও বা নখ দিয়ে কাগজের উপরে লিখতেন। বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘লিখিবার জন্য আমাদের কাগজ-কলম কিছু ছিল না— মুখে মুখেই কবিতা তৈয়ারি করিতে হইত এবং পরে চিৎকার করিয়া পরস্পরকে শুনাইতাম। কখনও সেলের দেওয়ালে সুড়কি দিয়া লেখা হইত।’ অন্যদিকে সতীনাথ ভাদুড়ী সম্পর্কে ফণীশ্বরনাথ রেণু বলেছিলেন, ‘একদিন ডিগ্রিতে বসে চা খাচ্ছিলাম, সামনে একটা খাতা ছিল। হাতে নিয়ে পাতা খুলে দেখি লেড পেন্সিল দিয়ে লেখা।’ আসলে লেড পেন্সিল আর খাতা দিয়ে সতীনাথ জেলের মধ্যেই লিখে ফেলেছিলেন ‘জাগরী’।
চিঠিপত্র লেখার পাশাপাশি বিপ্লবীরা গল্প, কবিতাও লিখেছেন। এই ভাবনাকে সামনে রেখেই বাংলা সাহিত্যে ‘কারাসাহিত্য’ নামে একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছে।
জেলে বসে যাঁরা কারাসাহিত্য লিখেছেন তাঁদের সিংহভাগই সাধারণ মানুষ। তাঁদের স্বপ্ন ছিল দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা। এঁরা কেউই লেখক হতে চাননি। সাময়িক আগ্রহে দণ্ডিত জীবনের নিষ্ঠুর ও করুণ অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। ব্যক্তি অভিজ্ঞতাই ছিল তাঁদের মুখ্য অবলম্বন। এর মধ্যে দিয়ে তাঁরা জীবন্ত হৃদয়ের উষ্ণতা ও অনুভূতিকে প্রকাশ করেছিলেন। দেশকে তাঁরা ‘মা’ বলে ডাকতেন। সাহিত্যের উপাদান হিসেবে তাঁরা সংগ্রহ করেছিলেন নিজেদের নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব, ইন্দ্রিয়পীড়ন এবং বিভীষিকাময় মানসিক অবস্থা। কারাগ্রন্থগুলিতে রয়েছে ‘লিটারারি টোন’—যাকে বলা যেতে পারে ‘বেদনাসিক্ত স্মৃতি’।
উল্লেখ্য, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ ‘নাইট’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। আন্দামান সেলুলার জেলের বন্দিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি কলকাতার টাউন হলে ভাষণ দিয়েছিলেন। কেবল ভাষণ বা সভাসমিতিই নয়—বিভিন্ন প্রবন্ধ, চিঠিপত্রের মাধ্যমে রাজবন্দিদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছেন। আমরা জানি, ৬২ দিন অনশনের পরে বিপ্লবী যতীন দাশ মারা গিয়েছিলেন। এই মৃত্যু এতটাই প্রভাব ফেলেছিল যার জন্যে জওহরলাল নেহরু তাঁর নিজের সভার কাজ মুলতবি রেখেছিলেন। শান্তিনিকেতনে ‘তপতী’ নাটকের মহলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই রাতেই তিনি এই বেদনাকে প্রকাশ করেছিলেন কবিতায়—
‘সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ,
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো।।
দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র—
মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উৎসাহ।।
দুঃখের মন্থন বেগে উঠিবে অমৃত,
শঙ্কা হ’তে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত।।’
সেইসময় ব্রিটিশরা অত্যাচার করেছিল বিপ্লবীদের মনটাকে ভেঙে দেওয়ার জন্যে। কিন্তু অত্যাচারই বিপ্লবীদের সংকল্পকে জোরালো করে তুলেছিল অন্তরের শক্তিতে। তাই কারাগারে থেকে বা পরে কারাজীবনকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তবে এই সাহিত্যের কোনও ধারাবাহিকতা ছিল না। প্রকরণগতভাবে কারাসাহিত্য কতখানি সাহিত্য হয়ে উঠেছিল এ প্রশ্ন থেকেই যায়। উপাদান হিসেবে জেলজগৎ, জেলের শাসকবর্গ ইত্যাদি কারাসাহিত্যকে পল্লবিত করেছিল। তবুও সাহিত্যের নান্দনিকতা এর মধ্যে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে বইকি। ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত তাঁর ‘বন্দীমন’ কাহিনিতে লিখেছেন, ‘ভোরের এ আলোকোচ্ছ্বাসের সঙ্গে কথা কয়ে খুশী হয়ে উঠল বন্দীমন। ও যেন ছোট একখানি সম্পূর্ণ চিঠি। তেমন চিঠি, যার প্রত্যাশায় মন থাকে চঞ্চল।’
কারা অভিজ্ঞতাকে কোনও শিল্পমাধ্যমে প্রকাশ করবেন এ বিষয়ে কিন্তু জেলবন্দিরা সচেতন ছিলেন না। ব্যক্তিগত ঘটনা, অমানবিক নির্যাতন, রাজনৈতিক চেতনা ইত্যাদিই তাঁদের ভাবিয়েছিল। শ্রীঅরবিন্দের লেখা ‘কারাকাহিনী’ এ বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারাজীবনের গ্লানি ও দমনপীড়নের অভিজ্ঞতা তাঁর মননে দার্শনিক চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। নির্জন কারাকক্ষে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন এইভাবে, ‘প্রাণের কঠিন আবরণ খুলিয়া গেল এবং সর্বজীবের উপর প্রেমের স্রোত বইতে লাগল।’ এ কথা বলার অপেক্ষা থাকে না, কারাজীবনের নির্জনতাই শ্রীঅরবিন্দকে উপলব্ধির জগতে নিয়ে গিয়েছে। একদিকে জেলখানার বস্তুগ্রাহ্য দৃশ্য জগৎ, অন্যদিকে অদৃশ্য উপলব্ধির জগৎ। তিনি লিখেছেন, ‘শিশু মাতৃক্রোড়ে যেমন আশ্বস্ত ও নির্ভীক হইয়া থাকে আমিও যেন বিশ্ব জননীর ক্রোড়ে সেইরূপ শুইয়া রহিলাম।’ বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষের কাহিনিতে রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, বৈপ্লবিক ঘনঘটার পাশাপাশি রয়েছে চিন্তাশীলতা। তিনি লিখছেন, ‘ভগবানের পথ বড় সহজ; দুর্লভ হইয়াও, কঠিন হইয়াও, ক্ষুরের ধারের অধিক সুতীক্ষ্ণ হইয়াও বুঝি সহজ। মানুষ কিন্তু সহস্র বাসনার ফেরে, সে সহজ পথকে দীর্ঘ ও জটিল করিয়া রাখিয়াছে।’ এই বিষয়ে বারীন্দ্রের লেখা ‘দ্বীপান্তরের কথা’, ‘বারীন্দ্রের আত্মকাহিনী’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এর পাশাপাশি উল্লাসকর দত্ত লিখেছেন ‘আমার কারাজীবনী’, বিধুভূষণ বসু ‘পুরনো জেলের কথা’ ও ‘স্মৃতিকথা’, মদনমোহন ভৌমিক ‘আন্দামানে দশ বৎসর’, অমলেন্দু দাশগুপ্ত ‘ডেটিনিউ’, ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ‘জেলে ত্রিশ বছর’, হেমচন্দ্র কানুনগো ‘বাংলার বিপ্লব কাহিনী’, নওসের আলির লেখা ‘বন্দীর চিঠি’ ইত্যাদি। বিধুভূষণই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম ব্যক্তিত্ব যিনি গল্প লিখে কারাবরণ করেছিলেন। গল্পটির নাম ছিল ‘শিকার’। গল্পটি ১৯০৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পাশাপাশি জেলবন্দি জীবনই তাঁদের নিত্যনতুন শব্দ সৃষ্টি ও ব্যবহারে প্রেরণা দিয়েছিল। নাহলে আমরা জানতেই পারতাম না ‘খাণ্ডারবাণী’ শব্দের অর্থ ‘জেলখানার গানের আসর’, ‘কঞ্চি’ শব্দের অর্থ ‘ফেনা ভাত’, ‘চেড়ি’—জেলকর্মী, ‘বি কেলাস’—জেলখাটা কয়েদি, ‘এ কেলাস’—ছিঁচকে চোর ইত্যাদি।
তবে এটা ঠিক, বন্দিরা জেলে বসেই আকাশ দেখতেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য গোপাল হালদারের ‘কয়েদীর আকাশ’-এর কথা। কয়েদিরা লিখেছেন জেলে বসে, অনেকেই আবার লিখেছেন জেল থেকে বেরনোর পর। কয়েদিদের বেশিরভাগেরই সময় কাটত আকাশের দিকে তাকিয়ে। ১৯৩৩ সালের ৮ আগস্ট কন্ডেম সেল থেকে সূর্য সেন একটা চিঠিতে তাঁর দাদাকে লিখছেন, ‘শ্রীচরণকমলেষু দাদা, মানুষের মন একা কিছুতেই থাকতে চায় না। তার নিজের সঙ্গী জুটিয়ে নেবেই। আমার মনও দু-চার দিনের মধ্যেই প্রকৃতির মধ্যে নিজের সঙ্গী জুটিয়ে নিল। সেই সঙ্গী হচ্ছে টু ট্রিস দ্য স্কাই। যেদিন চাঁদ দেখা যেত না, সেদিন তারাগুলোর দিকে চেয়ে থাকতাম। এইভাবে পনেরো দিন কেটে গেল। তখন আপনার প্রেরিত তিনখানা বই গীতা, মহাভারত এবং চয়নিকা পেলাম। আমার মোস্ট ফেভারিট এই তিনখানা বই তখন আমার অ্যাডিশনাল সঙ্গী হল। প্রকৃতির জিনিসগুলি থেকে এবং এই তিনটি বই থেকে মৃত মনের খোরাক সংগ্রহ করে মনটাকে ভরিয়ে রাখলাম।’ উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘নির্বাসিতের আত্মকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘প্রাচীরের উপর দিয়া খানিকটা আকাশ ও একটা অশ্বত্থ গাছের মাথা দেখিতে পাওয়া যাইত। জেলখানার কবিত্ব কেবল এইটুকু লইয়াই...।’ দুঃখের বিষয়, বেশিরভাগ কারাকাহিনিরই আজও সেভাবে মূল্যায়ন হল না!