ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
জগদ্ধাত্রী পুজো ও শীত
সমীরণের জগদ্ধাত্রী পুজোর জমক দেখার ইচ্ছে বহুদিনের। গেলেই হয়... অবলাই তো আছে! দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা গ্রামে ওদের জমিদারবাড়ি। এককালের জমিদার। জমি গিয়েছে, দাপট কিন্তু নয় (অবলাকান্ত নামেই বোঝা যায়)! তাও অনেক তাক কষেছে সমীরণ। যাওয়া আর হয়নি। এবার হয়েছে সুযোগ। প্রথমে ভেবেছিল বালিগঞ্জ থেকে ট্রেন ধরবে। একটু অন্য অভিজ্ঞতা। কিন্তু শেষমেশ চাপ নিল না। ৪০ কিলোমিটার রাস্তা, গাড়ি হাঁকিয়েই চলে এল।
জগদ্ধাত্রী পুজো... সঙ্গে পাঁচদিনের মেলা ফ্রি। এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে খেয়াল হল সমীরণের, ক্যানিং রোড দিয়ে অনেকটা চলে এসেছে। এবার ফোন লাগাতে হবে...। গাড়িটা একপাশে দাঁড় করাল সমীরণ। অবলার থেকে ঠিকঠাক জায়গাটা শুনে জিপিএস সেট করল। তারপর হালকা ভল্যুমে বিটলস চালিয়ে রওনা দিল।
মোড়ের মাথাতেই দাঁড়িয়েছিল অবলা। সমীরণের পাশের সিটে বসে বলল, সামনে থেকে ডানদিকে নিবি। কাছেই আমাদের বাড়ি। তারপর আড়চোখে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন, ‘সোয়েটার পরিসনি কেন?’ আকাশ থেকে পড়ল সমীরণ... ‘এই গরমে সোয়েটার?’ তোর মাথাটা গেছে নাকি? এখনও আমার বালিগঞ্জের বাড়িতে রাতে ফুল স্পিডে ফ্যান চালাতে হয়!’
—এটা তোদের বালিগঞ্জ না। বেলা গড়ালে ঠান্ডা লাগবে দেখবি।
—হুঁ! তোদের জন্যই এদেশে আর ঠান্ডা পড়ে না। লেবু-লঙ্কা ঝোলাতে হয় শীতের গায়ে।
—বুঝবি... বুঝবি। যাই হোক, বেলা হয়েছে। লাঞ্চ সেরে ছোট্ট একটা ন্যাপ দিয়ে নে। বিকেলে বেরব।
শুতে এসে আর একটু চমক—বিছানায় কম্বল! এবার একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না? অবলাকে আচ্ছা গাল দিতে হবে।
দুপুরে এমনিতে ঘুমোয় না সমীরণ। কিন্তু এখানে আতপ চালের ভাত, পুকুরের মাছ আর কচি পাঁঠা অভ্যেসটা রাখতে দিল না। দরজায় শব্দ শুনে ঘুমটা ভাঙল। কব্জি ঘুরিয়ে দেখল, বিকেল পাঁচটা। দরজা খুলল সমীরণ... চা এসেছে। আর ঠিক পিছন পিছন অবলাকান্ত। ফুলহাতা সোয়েটার, মাফলার, মাথায় একটা টুপিও আছে। হেসেই ফেলল সমীরণ। গা করল না অবলা। একটা জ্যাকেট ছুঁড়ে দিয়ে বলল, ‘গায়ে দিতে ভুলিস না। আমি নীচে আছি।’
জিনস, টি-শার্টই গায়ে চাপাল সমীরণ। জ্যাকেটটা বেঁধে নিল কোমরে। বাড়ি থেকে পুজোমণ্ডপ মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ। সাবেকি ঘরানার বিরাট প্রতিমা। চত্বরেই মেলা। মনটা খুশি খুশি হয়ে গেল সমীরণের। বেশ তো! ছেলে-মেয়ে-বুড়ো মিলে যেন মেলাতেই মিশে গিয়েছে। ভিড় বাড়ছে। আর অবাক হচ্ছে সমীরণ। প্রত্যেকেরই গায়ে গরম জামা। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক তো রীতিমতো থ্রি-পিস স্যুট পরে জেমস বন্ডের মতো হাঁটাচলা করছেন। কেউ বা আবার মাঙ্কি টুপি পরে গরম জিলিপি কিনতে ব্যস্ত। থাকতে না পেরে চায়ের দোকানে বসা এক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেসই করে ফেলল, ‘কী ব্যাপার বলুন তো? ঠান্ডা তো নেই। তা সত্ত্বেও সবাই এরকম সোয়েটার-টোয়েটার পরেছে?’ সেই ভদ্রলোক উত্তর দেওয়ার সময়ই পেলেন না। কেটলি থেকে গ্লাসে গরম জল ঢালতে ঢালতে দোকানির বিশ্লেষণ, ‘আপনি মশায় শহরের লোক। আজকেরে এখানে থাকবেন। কালকেরে চলে যাবেন। তাই কিসুই জানেন না। জগদ্ধাত্রী পুজো এলেই আমরা গায়ে গরম জামা চাপাই। দুগ্গাপুজোর পরই লেপকাঁথা রোদ্দুরে দেওয়া শুরু। আর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো থেকে চ্যবনপ্রাশ।’
দেখছে সমীরণ। মেলা... মানুষ। ঘুগনি শেষ করে পাতাটা ফেলার পরই বুঝতে পারল, এই চত্বরের সঙ্গেই মিশে যাচ্ছে সে। কোমর থেকে জ্যাকেটটা খুলে গায়ে চাপাল সমীরণ। ঠান্ডা লাগছে!
পিঠেপুলি, পাটালি, খেজুর গুড়
‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। অন্য অনেকের মতো উজ্জ্বলেরও প্রথমে মনে হয়েছিল, যাক বাবা, বাড়িতে বসেই অফিসের কাজকর্ম সেরে ফেলা যাবে। যাওয়া-আসার ঝক্কি নেই। কিন্তু সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই সত্যিটা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া গেল। সকাল ন’টায় লগ ইন। আর ল্যাপটপ বন্ধ করতে করতে রাত দশটা। অশান্তির জীবন। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল। দেবপর্ণারও একই দশা। দু’জনেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উঁচু পদে। উইকএন্ডে অফিস নয়, স্ত্রীর চাপ সামলাতে হয় উজ্জ্বলকে। রবিবার দুপুরে মোগলাই ডিশ দেবপর্ণার চাই-ই চাই। এখানেই শেষ নয়। রাতে চাইনিজ। আসলে বড়লোক বাপ-মায়ের আদুরে মেয়ে তো। মেঘ চাইলে আকাশে ভাসা ছাড়া গতি নেই।
শীত পড়লেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। বর্ধমানের আউশগ্রামেই জন্ম উজ্জ্বলের। পড়াশোনা, বড় হয়ে ওঠা ওখানেই। ক্ষণস্থায়ী হেমন্ত অতীত হলেই পিঠে-পুলির জন্য মন কেমন করত। পাটালি, পয়রা গুড়ের নাম শুনলে এখনও জিভে জল আসে। কলকাতা তাকে অনেক কিছু দিয়েছে। ঝকঝকে চাকরি, সুন্দরী স্ত্রী, একঝাঁক ট্যাঁশ বন্ধুবান্ধব ইত্যাদি। কিন্তু নতুন গুড় দিয়ে পিঠে তো আর নেই উজ্জ্বলের জীবনে! এই তো সেদিন, এক শনিবার। ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে মৃদু স্বরে পিঠে খাওয়ার আবদার করেছিল সে। চিকেন-চিজ স্যান্ডউইচে কামড় দিতে দিতে সফিস্টিকেটেড দেবপর্ণার মুখঝামটা, ‘আদিখ্যেতা আর দেখিও না তো। ব্র্যান্ডেড জামাকাপড় পরলেই শহুরে হওয়া যায় না। এখনও গেঁয়ো খাবারের লোভ তাড়া করে বেড়ায়। চালের গুঁড়োর ভিতর নারকেলের পুর, তার উপর ওরকম ল্যালল্যালে গুড়ে ডুবিয়ে খাওয়া। ওহ মাই গড!’ এখানেই শেষ নয়। মালকিনের সুরে সুর মিলিয়ে রান্নার মাসিও বলে ওঠে, ‘পিঠে করার কি ঝক্কি কম গো দাদাবাবু? পাড়ার মিষ্টির দোকানে আর ক’দিন পরেই পিঠে পাওয়া যাবে। কিনে খেও তখন!’
একে রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর। কীই আর করা যাবে? শীত আসে শীত যায়, ভরসা শুধুই স্মৃতিরোমন্থন। ঘাসের আগায় শিশির, রাতে টালির চালে হিম ঝরার শব্দ, কর্মচঞ্চল ঢেঁকির ওঠানামা, চাল কিংবা গুড়ের মনভরা আমুদে গন্ধ—সবই তো উজ্জ্বলের পাণ্ডুলিপিতে ধূসর। সাত বছরের ছেলেও ইনস্ট্যান্ট খাবার চেটেপুটে খায়। কিন্তু পিঠে? নামই শোনেনি। তাই তো নুডলস মুখে তুলতে তুলতে সেও বলে, ‘ড্যাড, আজ মোমো খাব। উইদ চিকেন স্যুপ।’ ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে দেবপর্ণা বলে ফেলে, ‘কারেক্ট। মোমোই তো পিঠের মডার্ন ফর্ম। নেক্সট উইকে তোর জন্য চকোলেট দিয়ে মোমো করে দেব। দারুণ হবে। ওই তো অফিসের ঋতুদি ওর মেয়ের জন্য ক’দিন আগেই করেছিল। রেসিপিটা মেল করতে বলেছি।’
মনের কষ্ট মনেই লুকিয়ে রাখে উজ্জ্বল। শীত এলেই বাজার থেকে কেক তৈরির যাবতীয় উপকরণ নিয়ে আসা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। খেতে ভালো না লাগলেও বলতে হয় টেস্টি। সত্যি জীবনটা কতই না বদলে গেল...। বেজে উঠল মুঠোফোন। উল্টোদিকে হিমাদ্রী। ‘শোন না, ডিসেম্বরের গোড়ায় গড়িয়ায় পিঠেপুলি উৎসব আছে। যাবি?’ এ তো মেঘ না চাইতেই জল। তবে বাড়িতে জানলে কিছুতেই যেতে দেবে না। তাই উজ্জ্বল বলল, ‘আমি তোকে হোয়াটসঅ্যাপ করছি।’
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হিমাদ্রী দেখল উজ্জ্বলের মেসেজ, ‘যাব তো বটেই। পেটভরে খাব। কিন্তু নিয়ে আসা যাবে না। ও জানলে আবার অশান্তি করবে।’
পিকনিক ও শীতের খেলাধুলা
বাসের মধ্যেই সেরে নিতে হবে ব্রেকফাস্ট। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ পাউরুটি, ডিমসেদ্ধ, সন্দেশ ও কমলালেবু। ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্বে বিলে। আর ডিমের খোসা ছাড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে ‘স্বেচ্ছাসেবক’ বীরু। প্রত্যেকের প্যাকেট থেকে যেচে ডিমসেদ্ধ নিয়ে সামনের সিটে বসা নদের মাথায় ঠুকছে সে। তারপর হাতের আলতো ছোঁয়ায় খোসা ছাড়িয়ে দেওয়া। নদে একরাশ বিরক্তি নিয়েই মাঝেমধ্যে বারণ করছে, ‘এই ঠান্ডার মধ্যে সাতসকালে শ্যাম্পু করে এসেছি। ফালতু ইয়ার্কি মারছিস কেন?’ কিন্তু বীরু তো থামার পাত্র নয়। কর্তব্যে সে মনোযোগী।
গোটা ব্যাপারটা লক্ষ করেছে সন্টু। আজন্ম ছ্যাবলা। নদে ও বীরুর মধ্যে ঝগড়া বাঁধানোর ফন্দি মুহূর্তে তার মাথায় এল। বাসের পিছনদিকে রয়েছে কাঁচা বাজার। সিট ছেড়ে উঠে সেদিকেই এগল সে। ক্রেট থেকে একটা কাঁচা ডিম বের করল চুপিসারে। বীরুর হাতে দিয়ে সন্টুর অনুরোধ, ‘এটা ছাড়িয়ে দে।’ যেমন কথা তেমনই কাজ। নদের মাথায় ঠোকামাত্রই কাঁচা ডিম ভেঙে একসা। হলুদ কুসুম গড়িয়ে পড়ছে ওর মাথা বেয়ে। বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিল নদে। তারপরই চিল চিৎকার। সঙ্গে বাছাই করা সব বিশেষণ। ‘অনেকক্ষণ ধরে বারণ করছি। শুনছিস না তো। দেখলি কী হল?’। সমবেত প্রচেষ্টায় মিনিট দশেক পরে সে শান্ত হল।
‘নতুন দিগন্ত’ ক্লাবের পিকনিকে যাওয়ার পথে এই ঘটনা। গন্তব্য উলুবেড়িয়ার আটান্ন গেট। রাঁধুনি ও তার অ্যাসিস্ট্যান্টও রয়েছে বাস ড্রাইভারের পাশে। পৌঁছেই চিকেন পকোড়া আর কফি। দুপুরে খাসির মাংস-ভাত। সঙ্গে ডাল, আলুভাজা, চাটনি, পাঁপড়। বিকেলের কফিতে চুমুক দিয়ে পাড়ার উদ্দেশে রওনা।
স্পটে পৌঁছেই বীরু চটপট ব্যাট, বল, উইকেট বের করল। শীতের পিকনিক ক্রিকেট ছাড়া অসম্পূর্ণ। শুরু হল টিম করা। বিলে আর সন্টু দুই টিমের অধিনায়ক। এরইমধ্যে সন্দীপা-কাকলিরা এসে একপ্রস্ত ঝগড়া করে গেল। ব্যাডমিন্টন ও ফ্লাইং ডিস্ক খেলার জন্য তাদেরও জায়গা দিতে হবে। ফলে কমল ক্রিকেটের মাঠের আয়তন। খেলা শুরু হল। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই মধ্যাহ্নভোজ। প্রথমে ব্যাট করায় সন্টুর দলের প্লেয়াররা তরতাজা। আর বিলের টিমমেটরা ক্লান্ত। হাত ঘুরিয়ে কাঁধে ব্যথা। এর মধ্যে শরীর ছুঁড়ে ক্যাচ নিতে গিয়ে পা মচকেছে বিলে। বরফ না থাকায় সামনে দাঁড়ানো এক আইসক্রিমওলাই ভরসা। দু-তিনটে অরেঞ্জ আইসক্রিম দেওয়া হল তার পায়ে।
এদিকে আর এক বিপত্তি। সন্দীপাদের ফ্লাইং ডিস্ক উড়ে গিয়েছে সীমানার ওপারে। অন্য পিকনিক পার্টির জায়গায়। দু’-একবার তারা ফেরত দিয়েছে। কিন্তু এবার কিছুতেই দেবে না। শেষে নদে গিয়েই তা নিয়ে এল। ঠিক হল, লাঞ্চের পরে আর কোনও খেলাধুলো নয়। সময় কাটবে গানের লড়াইয়ে। এই পর্বে কমলালেবুর খোসা বীরু টিপল নদের চোখের সামনে। কোনওরকমে চোখেমুখে জল দিয়ে বীরুকে মারতে দৌড়ল নদে। প্রায় পঞ্চাশ গজ দৌড়ে নাগালও পেল। প্রথমেই সজোরে এক ঘুসি। যা খেয়ে বসে পড়ল বীরু। ‘দেখ কেমন লাগে... কথা শেষ হওয়ার আগেই ফের চোখ ধরে বসে পড়ল নদে। বীরু যে ধুলো ছুড়েছে! এবার একে অপরের গলা জড়িয়ে মারামারি। বাকিরা উদ্বিগ্ন। পিকনিকের শেষে এই ঘটনা না ঘটলেই ভালো হতো। মাটিতে লুটোপুটি খেতে খেতে এটাই হয়তো ভাবছিল বীরু-নদে। তাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দু’জনে উঠতেই হাততালি দিল সকলে। নদে দাঁত বের করে বলছে, ‘আমরা তো শোলের জয়-বীরু। ইয়ে দোস্তি হাম নেহি ছোড়েঙ্গে...।’