ব্যবসায় অগ্রগতি ও শুভত্ব বৃদ্ধি। ব্যয়ের চাপ থাকায় সঞ্চয়ে বাধা থাকবে। গলা ও বাতের সমস্যায় ... বিশদ
ছোটবেলায় স্কুলের বইতে বায়ুদূষণ নিয়ে যা পড়েছিলাম সেই ধারণার একটা পরিবর্তন করা দরকার। আমাদের পাঠ্য বইতে বায়ুদূষণের বেশিরভাগ অংশটাই ছিল সালফার-ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড কেন্দ্রিক। আমরা পড়েছিলাম, এই দুই গ্যাস কলকারখানা এবং গাড়ির ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে অ্যাসিড বৃষ্টির সৃষ্টি করে। এখন কথা হচ্ছে, এই গ্যাস দুটো তাই-ই করত এবং একসময় এই দুই গ্যাসের দাপটে আচ্ছা আচ্ছা দেশ নাজেহাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই দিন এখন অতীত। এখন পুরোটাই ধুলোকণার যুগ। বাতাসে ভাসমান ধুলোকণা যা কি না ২.৫ মাইক্রো মিটারের থেকে ছোট হয় সেই কণাই এখন বায়ুদূষণের বিরাট কোহলি। কতটা ছোট এই ২.৫ মাইক্রো মিটার? মোটামুটি একেবারে ছুঁচলো করে কাটা পেন্সিলের মুখটা ২০০ মাইক্রো মিটার মতো হয়। বা ধরুন দিঘাতে বেড়াতে গিয়ে সমুদ্রের ধারে পড়ে থাকা এক কণা বালি হাতে তুলে নিতে পারলে সেটি ৯০ মাইক্রো মিটার। চুল লম্বায় তো হাত দুয়েকও হতে পারে কিন্তু চওড়ায় ৫০ মাইক্রো মিটারের কাছাকাছি। তার থেকেও অনেকটাই ছোট এই ধুলোকণাগুলির পোশাকি নাম হল পিএম ২.৫ বা ধুলোকণা ২.৫। এটি মাপা হয় মাইক্রোগ্রাম প্রতি ঘন মিটার এককে। সাধারণত আগে থেকে ওজন করে রাখা ফিল্টার কাগজ নিয়ে তার ওপর একটি নির্দিষ্ট শক্তির পাম্প চালানো হয় যার সাহায্যে বাতাস টানা হয়। ধুলোকণাগুলি ওই কাগজের ওপর জমা হয়। এইবার ওই কাগজটিকে আবার ওজন করা হয়। ওজন করার পর প্রথম বার পাওয়া ওজনের থেকে পার্থক্য করলেই কতটা ধুলোকণা জমা পড়েছে, তা জেনে নেওয়া সম্ভব। এবারে কত ঘন মিটার বাতাস টানা হয়েছে সেটা দিয়ে এই ওজনের অন্তরকে ভাগ করলেই বাতাসের ধুলোকণার মাত্রা নির্ধারিত হয়। নামেই ধুলোকণা, কিন্তু এর উৎস গাড়ি বা কারখানার ধোঁয়া, রাস্তা বা বাড়ি তৈরির ধুলো বা জ্বালানি যেমন হতে পারে, তেমনই হতে পারে রান্নার সময়ের ধোঁয়া বা ধূপ অথবা মশা মারার কয়েলের ধোঁয়া।
কেন ধুলোকণা ২.৫:
এখন প্রশ্ন হল, চোখে দেখা যায় না এমন ধুলোকণা, সে কত বড় না ছোট এত জেনে কী হবে! আর এই ‘২.৫’ মাপটাই বা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? দেখা গিয়েছে, এই আকারের ধুলোকণাগুলি আমাদের শ্বাসনালীর বেড়াজাল ভেদ করে একেবারে ফুসফুসের ভেতরে ঢুকে পড়ে। বড় কণাগুলিকে আটকানোর কৌশল বা ব্যবস্থা আমাদের শরীরে আছে। কিন্তু ছোটগুলি এদিক-ওদিক দিয়ে গলে ঠিক চলে যায়। এই যেমন নন্টে-ফন্টে ঠিক হেডমাস্টার মশাইয়ের হাত থেকে বেরিয়ে যেত আর কেল্টুদা ধরা পড়ত। তেমনই আমাদের শরীর হল হেডমাস্টার মশাই। যে কেল্টু কুমারকে ধরতে পারলেও নন্টে-ফন্টে অধরাই থাকে। নন্টে-ফন্টে যেমন বিচ্ছু, এই ধুলোকণা ২.৫-ও একই রকম দুষ্টু। তারা নাকের মধ্যে দিয়ে ফুসফুসে পৌঁছয়। তারপর একেবারে ক্যান্সার থেকে শুরু করে হার্টের রোগ, হাঁপানি থেকে শুরু করে স্ট্রোক কী না বাঁধায়!
যে কথা বলতে গিয়ে এত কথা এল, সেই সালফার-ডাই-অক্সাইড আর নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইডকে পাত্তা না দেওয়ার আর একটা কারণ হল, বাতাসে এদের পরিমাণ বেশ কম। একেবারে ধোঁয়া ভর্তি রাস্তা বা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া বাতাসে এদের মাত্রা ক্ষতিকারক সীমার তুলনায় অনেকটাই কম। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতের ১ শতাংশেরও কম অঞ্চলে এই দুই গ্যাসের মাত্রা বেশি। বাদবাকি জায়গায় এই দুই গ্যাসের মাত্রা ঠিকই আছে।
কতটা বেশি হলে খারাপ:
ক্ষতিকারক সীমার কথা যখন উঠলই, তখন সেই সম্বন্ধেও আমাদের জানা দরকার। যেমন— স্কুলে আমাদের স্যাররা অনেক সময়ই প্রশ্রয় দেন। কিন্তু যখন বাইরে থেকে কেউ আসেন, তখন আবার তিনি অত্যন্ত কড়া। সাধারণত ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলেটি একেবারে যা তা রকমের বদমাইশি না করলে উত্তম-মধ্যম দেন না। অথচ, বাইরের কারও সামনে পান থেকে চুন খসলেই একেবারে আড়ং ধোলাই কপালে নাচে। এখন, ধুলোকণা ২.৫-এর ক্ষেত্রেও এর বিপজ্জনক সীমার রকমফের আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, ধুলোকণা ২.৫-এর মাত্রা ১০ মাইক্রো গ্রামের বেশি প্রতি ঘন মিটার বাতাসে থাকলে বিপজ্জনক। আর ভারতীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কথা অনুযায়ী, বছরে গড় ৪০ মাইক্রো গ্রামের বেশি ধুলোকণা ২.৫ প্রতি ঘন মিটার বাতাসে থাকলে, তা বিপজ্জক। অর্থাৎ হিসেবের রকমফের রয়েছে। ভারতীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের সীমাটা হল— স্কুলের সবথেকে দুষ্টু ছেলেটার যা তা বদমাইশি। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম হল, বাইরের কেউ যখন আসে। যাই হোক, ভারতে যে সীমাই ধরি না কেন, সব সীমা ছাড়িয়ে ধুলোকণা ২.৫ বহুদূরে পৌঁছে গিয়েছে। ধুলোকণা ২.৫-এর জন্যে ভারতে গড় মান হল ৭০ মাইক্রো গ্রাম প্রতি ঘন মিটারে। তবে, একথা বললেই পুরোটা বলা হয় না। হেমন্ত এবং শীতকালে মানে অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত একেবারে শহরে শহরে যুদ্ধ চলে— কখনও কলকাতা এগিয়ে যায় তো কখনও দিল্লি কখনও আবার লখনউ। তখন কোথায় ১০ বা ৪০, পাঁচশো-সাতশো এমনকী মাঝে মাঝে হাজারও মাত্রা ওঠে। মানে যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১০ বলছে, সেখানে যদি ৫০০ হয়, মানে প্রায় ৫০ গুণ বেশি।
কীভাবে গণনা করা হয় বায়ুদূষণের প্রভাব:
মানুষের আয়ু কমে যাওয়ার পিছনে খাদ্যাভ্যাস থেকে জল, রোগের প্রাদুর্ভাব থেকে জীবনযাপন অনেক কিছুরই ভূমিকা রয়েছে। শুধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণে কতটা আয়ু কমবে সেটা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে বেশ কয়েক দশক আগের চীন দেশে। প্রায় এগারোশো কিলোমিটার জুড়ে বয়ে চলা হুয়াই নদী চীন দেশকে উত্তর ও দক্ষিণে ভাগ করছে। চীনের উত্তর দিকে ঠান্ডা একটু বেশি হওয়ায় সরকার পাঁচ থেকে সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সেই অঞ্চলের বাসিন্দাদের বিনামূল্যে কয়লা দিত। যাতে তারা কয়লা পুড়িয়ে গরম করতে পারে নিজেদের ঘর। চীনের দক্ষিণে অবশ্য এরকম কোনও নিয়ম ছিল না। যদিও ঠান্ডা থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বাঁচার জন্য এই নিয়মের কোনও বিকল্পও হয়তো ছিল না। কিন্তু নিয়ম করে এভাবে কয়লা দেওয়ার ফলে চীনের উত্তর ও দক্ষিণে কয়লা ব্যবহারের একটা পার্থক্য দেখা দিয়েছিল। এই ব্যবস্থাপনার প্রভাব আজও চীনে দেখা যায়— উত্তর চীনের বিস্তীর্ণ এলাকায় এখনও বাড়ি গরম করার জন্য কয়লার উপর নির্ভরশীল। একই সঙ্গে এখানে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেই সময় চীনের উত্তর থেকে দক্ষিণে বা দক্ষিণ থেকে উত্তরে স্থানান্তরিত হওয়া খুব ঝামেলা ছিল। শুধু তাই নয়, যাঁরা যে অঞ্চলে জন্মেছেন, তাঁরা যাতে সেই অঞ্চলেই থেকে যায়, সে ব্যাপারে উৎসাহ দিত দেশের সরকারও। চীনের উত্তর দিকে কয়লার বহুল ব্যবহারের ফলে বায়ুদূষণ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং দুই অঞ্চলের বায়ুর যে পার্থক্য, তা বোঝা যেতে থাকে। নিয়ম কানুনের কড়াকড়ি থাকার জন্যে চাইলেও এক অঞ্চলের মানুষ অন্য জায়গায় যেতেও পারত না। এর ফলে নদীর একদিকে দীর্ঘকালীন অতিরিক্ত বায়ুদূষণের মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষ এবং অন্যধারে অপেক্ষাকৃত কম দূষণে বেঁচে থাকা মানুষের গড় আয়ুর হিসেব বিজ্ঞানীদের কাছে এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। দুই অঞ্চলের হাসপাতালে সংগ্রহ করা হয় মৃত্যুর কারণ, কোন বয়সে মৃত্যু, পারিবারিক অবস্থা ইত্যাদি তথ্য। সেই সঙ্গে ওই নির্দিষ্ট অঞ্চলের বায়ুদূষক পদার্থের তথ্য নিয়ে তুলনামূলক গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করতে থাকেন, বাতাসে ভাসমান ধুলোকণার পরিমাণ কতটা বাড়লে কতটা আয়ু কম হবে সেই হিসেব। এবার গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বায়ুতে মূল দূষণকারী উপাদান বা ধুলোকণা ২.৫-এর পরিমাণ মাপা হল। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতে শুধু মাত্র বায়ুদূষণের কারণে গড় আয়ুষ্কাল ৬ বছরের কাছাকাছি কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে সেই সংখ্যাটা ৫.৪ এবং পাকিস্তানে তা ৩.৯ বছর।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে পৃথিবীর মানুষের গড় আয়ু ছিল মোটামুটি ৪০ বছরের আশপাশে। সীমাহীন দারিদ্র্য এবং অবহেলিত ও অনুন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়। ক্রমশ মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বেড়েছে। যদিও উন্নত দেশগুলিতে উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় আয়ুষ্কাল বেশ খানিকটা কম। যাইহোক, সারা পৃথিবীর গড় নিয়ে যদি দেখা হয় তাহলে শুধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণে মানুষের ২.২ বছর আয়ুষ্কাল কমছে। এই তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, অন্য একটি পরিসংখ্যান বলছে, নিয়মিত সিগারেট খাওয়ার ফলে আয়ুষ্কাল কমে ১.৮ বছর। মদ খেলে ৭ মাস। এই পরিসংখ্যান দু’টির তুলনা করলেই বোঝা যাচ্ছে, বায়ুদূষণই পৃথিবীর সব থেকে বেশি মানুষের শরীরের ক্ষতি করছে। একেই দূষিত বায়ু, তার উপর যাঁরা বিড়ি-সিগারেট খাচ্ছেন, তাঁদের অবস্থা তো গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো।
বায়ুদূষণ ও ভারত:
ভারতের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১৩০ কোটি মানুষ এমন জায়গায় থাকেন, যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দিষ্ট করে দেওয়া মাত্রার থেকে বেশি। সিন্ধু ও গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চল যাকে ইন্দো-গ্যাঞ্জেটিক প্লেন বলা হয়, সেই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অসংখ্য কলকারখানা, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, শীতের সময় কাঠকয়লা পুড়িয়ে আগুন জ্বালানো এবং ফসল তোলার পরে জমিতে আগুন দেওয়ার রীতির কারণে ভারতীয় উপমহাদেশের বাকি অঞ্চলের থেকে এই অঞ্চলে বায়ুদূষণের পরিমাণ অনেকটাই বেশি। শুধু বায়ুদূষক পদার্থের উৎপাদনের কারণেই নয়, শীতকালে বায়ুর গতিবেগ অত্যন্ত কম থাকে। কম তাপমাত্রার ফলে দূষিত বায়ু এক জায়গায় আটকে যায়। ফলে পাকিস্তান থেকে শুরু করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার হয়ে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বায়ুদূষণের পরিমাণ অনেকটাই বেশি। উত্তর ভারতে বায়ুদূষণের কারণে এই অঞ্চলের প্রায় ৫০ কোটি মানুষের গড় আয়ুষ্কাল কমছে প্রায় ৮.৫ বছর। লখনউতে দূষণ সব থেকে বেশি এবং তা মানুষের জীবন থেকে গড়ে ১১.২ বছর মুছে দিচ্ছে। বায়ুদূষণের মাত্রা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের স্থান ৬ নম্বরে। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, হরিয়ানা, ঝাড়খণ্ডের পরেই। যদি আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দিষ্ট করে দেওয়া মাত্রা মেনে চলতে পারি তাহলে আমরা প্রায় ৭ বছরের কাছাকাছি আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারব। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলিতে দূষণের মাত্রা অনেকটাই বেশি। তুলনামূলকভাবে কোচবিহার, দিনাজপুর, আলিপুরদুয়ার ও দার্জিলিঙে খানিকটা কম। যদিও তা ভারতীয় মাত্রা বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দিষ্ট মাত্রার থেকে অনেকটাই বেশি।
সমস্যাটা কোথায়?
প্রথম সমস্যা হল, বায়ুদূষণ খুব জটিল এবং দেশ বা রাজ্যের সীমানা মানে না। বায়ুপ্রবাহের গতিমুখের জন্য সমগ্র সিন্ধু-গঙ্গা উপত্যকার দূষিত বায়ু পশ্চিমবঙ্গকেও দূষিত করে। মুশকিল হল, আমাদের কাছে এত তথ্য নেই, যাতে আমরা বলতে পারি ঠিক কতটা বায়ুদূষণকারী পদার্থ স্থানীয়ভাবে তৈরি হচ্ছে আর কতটা দূর থেকে উড়ে আসছে। দ্বিতীয়ত, কলকাতা ছাড়া আমাদের বাকি শহরগুলিতে নিয়মিত বায়ুদূষণের মাত্রা পরিমাপের যন্ত্রের বড়ই অভাব। কোনও অঞ্চলে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য সেই অঞ্চলে ধুলোকণা ২.৫ কোথা থেকে কতটা আসছে, তা নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। মানে গাড়ি থেকে, কারখানা থেকে বা জ্বালানি পুড়িয়ে কত শতাংশ আসছে তা জানা জরুরি। সেই ধরনের পরীক্ষা আমাদের দেশে খুবই কম হয়। ফলে আমাদের বায়ুদূষণ কমানোর জন্য অন্ধকারে ঢিল ছুড়তে হয়। তৃতীয়ত, যেখানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের এতটা অভাব রয়েছে, সেখানে বায়ুদূষণের সমাধানে প্রচুর খরচ করাও অসম্ভব। চতুর্থত, বায়ুদূষণ একটা অসম্ভব জটিল পদ্ধতি। শহরে বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশের শহরগুলিতে শুধুমাত্র গাছ লাগিয়ে বা হোর্স পাইপে করে জল ছিটিয়ে বায়ুদূষণের সমাধান করা সম্ভব নয়।
সবই তো বুঝলাম কিন্তু...
বায়ুদূষণ নিয়ে কর্মশালার শেষে প্রশ্নটা থাকে— ‘সবই তো বুঝলাম, কিন্তু করবটা কী?’ প্রথমত আমাদের বাঁচতে হবে এবং পরিবারকে বাঁচাতে হবে। শীতকালে সাধারণত বায়ুদূষণের মাত্রা গ্রীষ্মকালের তুলনায় বেশি থাকে। তাই শীতকালে প্রাতর্ভ্রমণ নাই বা করলেন। ঠিক একইভাবে দিনের কর্মব্যস্ত সময় মানে সকাল ৯-১১টা আর বিকেল ৬-৮ টায় একটু সাবধানে চলাফেরা করলে ভালো। করোনার পরেও যদি মুখে মাস্কটা থাকে তাহলে ভালো। বাচ্চা ও বয়স্ক— এই দুই প্রজন্ম বায়ুদূষণের ফলে সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়, তাই রান্না করার সময় এদের একটু দূরে রাখুন। এসি নয়, বাড়িতে হাওয়া বাতাস খেললে ঘরের ভেতরের দূষণ কমতে বাধ্য। ধূপকাঠি বা মশা মারার কয়েল কিন্তু সিগারেটের মতোই ক্ষতিকর, তাই মশারির বিকল্প নেই। অটোতে যাতায়াতের সময় বাসের টেল পাইপ একেবারে অটোযাত্রীর মুখের উচ্চতায় থাকে। সেই সময় মুখে মাস্কটা থাকলে ভালো। বাড়ি ঘর বা রাস্তাঘাট তৈরির ধুলো বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। একইভাবে শীতের সময় জঞ্জাল পোড়ানো বা বিকট কালো ধোঁয়া ছাড়া গাড়ি— এগুলি সবই কিন্তু বেআইনি। ছবি তুলে সটান পুলিসের কাছে অভিযোগ করুন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে প্রতিবাদ করুন। শুধু শহর নয়, আইআইটি বম্বের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, গ্রামের মানুষও একই হারে বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন। যদিও আমাদের বায়ুদূষণের মাত্রা নির্ধারণকারী যন্ত্র বা প্ল্যানিং ভীষণ ভাবে শহরকেন্দ্রিক। ফলে, যদি কাঠ বা কয়লার উনুনে রান্না হয়, তাহলে খোলা জায়গায় করুন। বদ্ধ জায়গা বায়ুদূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
পরিশেষে আমাদের দেশে বলে নয়, যে সমস্ত দেশে ভাত কাপড়ের অভাব আছে, সেখানে বায়ুদূষণের প্রতিরোধ খানিকটা বিলাসিতাই বটে। যে ট্রাফিক পুলিস বছরের পর বছর ধরে রাস্তায় ধোঁয়া খেয়ে যাচ্ছেন বা যে মায়েরা এক চিলতে রান্না ঘরে হেঁশেল সামলাচ্ছেন, বা যে শ্রমিক বাড়ি তৈরির সময় ধুলোয় ধুলোময় হচ্ছেন, তাদের জন্য সত্যি আজও কোনও সমাধান নেই আমাদের কাছে।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়