বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
সে ছিল এক অন্য কলকাতা— সেখানে কলুপাড়া, ডোমপাড়া, হাঁড়িপাড়া, গয়লাপাড়া, হাতিবাগান, বাদুড়বাগান, চালতাবাগান, হালসীর বাগান— ছিল অঞ্চলের নাম। সেই সাবেক কলকাতাতেও ছিল দুর্গাপুজো। সমাজের ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে না শামিল করলে সেকালের দুর্গাপুজো পূর্ণতা পেত না।
তখন দুর্গাপুজো মূলত জমিদারবাড়ি কিংবা উচ্চবিত্ত মানুষদের বাড়িতেই হতো। তখনকার দিনে এই পুজো উপলক্ষে ভট্টাচার্য ব্রাহ্মণ আর ‘টুলো’ অধ্যাপকরা ‘বার্ষিকী’ বা পার্বণী পেতেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্সায়’ এই পার্বণী পাওয়ার চমৎকার বর্ণনা আছে। দুর্গাপুজোর বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই এই ‘পার্বণী’ দেওয়া শুরু হয়ে যেত। যে জমিদার বাড়িগুলিতে পুজো হতো, সে সব বাড়ি গিজগিজ করত ব্রাহ্মণ- পণ্ডিতদের ভিড়ে! বাড়ির ‘বাবু’টি তসরের কাপড় পরে তাঁর সেরেস্তায় বসে থাকতেন একটা গদির উপর। তাঁর ডানদিকে বসত তাঁর দেওয়ান টাকা আর সিকি-আধুলির তোড়া নিয়ে, দেওয়ানের সামনে খোলা থাকত একটা খাতা। ‘বাবু’র বাঁ দিকে বসতেন সভাপণ্ডিত। এই সভা-পণ্ডিতের কাজ ছিল বিচার করে স্থির করা কোন ব্রাহ্মণ প্রকৃতই এই ‘পার্বণী’ নেবার অধিকারী আর কে তা নন। যদি কেউ গত একবছর বিধবা-বিবাহের সভায় যেতেন, সেখানকার ‘প্রণামী’ গ্রহণ করতেন, কিংবা কোনও ‘অখাদ্য’ খেয়ে ফেলতেন, তাহলে ‘পার্বণী’ পাওয়ার অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত হতেন। অনেকে ‘পার্বণী’ পাবার লোভে ‘দিব্যি’ গেলে বলতেন যে তাঁরা তেমন কোনও ‘অসিদ্ধ’ কাজ গত একবছরে করেননি! কিন্তু সেকথা বিশ্বাস না হলে সভা-পণ্ডিত খাতা থেকে তাঁর নাম কেটে দেবার হুকুম দিতেন। বঞ্চিত ব্রাহ্মণরা তখন রেগে পৈতে ছিঁড়ে ‘অভিশাপ’ দিতে দিতে চলে যেতেন!
মুদি সারাবছর গৃহস্থকে সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগান দেয়। তাই বছরে দু’বার তাকে ‘উটনো’ মেটানো হতো। একবার চড়কের সময়, আর একবার দুর্গাপুজোর সময়। পুজোর সময় ‘উটনো’ মেটানোকে বলা হতো ‘ঢাকে-ঢোলে চুকানো।’ মুদিও যেন ফাঁকিতে না পড়ে এবং তারও যেন পাওনাগন্ডা সব মিটে যায় পুজোর আগে, সেইজন্যই সেকালের সমাজে ছিল এমন ব্যবস্থা।
কৃষ্ণপক্ষের নবমীতে অনেকের বাড়ি ‘কল্পারম্ভ’ হতো। তারপর থেকে রোজই চলত সংক্ষিপ্ত পুজো এবং চণ্ডীপাঠ। যাঁদের বাড়িতে প্রতিমাপুজো হতো না, তাঁদেরও কিন্তু এই ক’দিন রোজ বাড়িতে চণ্ডীপাঠ করাতে হতো— এমনি ছিল সেকালের নিয়ম।
মা দুর্গার সিংহের মুখ নিয়েও সেকালের কলকাতার নানারকম চল ছিল। শাক্তবাড়ির সিংহের মুখ হতো সাধারণ। কিন্তু গোঁসাইবাড়ির সিংহের মুখ হতো ‘ঘোটক-মুখী’। সেকালে মা দুর্গার সাজ হতো মাটির গয়নায়। অনেক পরে ‘ডাকের সাজ’ এবং ‘শোলার সাজ’-এর প্রচলন হয়েছিল। শুধু কি সাজ? মা দুর্গার দুপাশে কার্তিক গণেশের দিকনির্ণয় নিয়েও ছিল দুই বাংলার দু’রকমের প্রথা। পশ্চিমবাংলায় দেবীর ডানদিকে গণেশ, বাঁদিকে কার্তিক, আবার পূর্ববঙ্গে-এর ঠিক উল্টো। কোথাও আবার লক্ষ্মী-সরস্বতীর জায়গা নিতেন জয়া-বিজয়া কিংবা রাধাকৃষ্ণ।
দুর্গাপুজোর একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হল দেবীর ‘মহাস্নান’। শঙ্খজল, গঙ্গাজল, উষ্ণজল, গন্ধজল, রজতজল, স্বর্ণজল, মুক্তাজল, বৃষ্টিজল, নির্ঝরজল ইত্যাদি এই নানান জলে ‘দেবী’র মহাস্নানের সময় সেকালে বিভিন্ন রাগ বাজানোর চল ছিল— যেমন ‘বৃষ্টিজল’-এ মহাস্নানের সময় ললিত রাগ ও বিজয়বাদ্য, ‘নির্ঝরজল’-এ মহাস্নানের সময় বরাড়ী রাগ ও শঙ্খবাদ্য প্রভৃতি। কলাবউ স্নান করাতে নিয়ে যাবার সময় পুরোহিত, তন্ত্রধারক, বাড়ির আচার্য, ব্রাহ্মণ, গুরু, সভা-পণ্ডিতের পেছনে বাড়ির ‘বাবু’টিকে সপারিষদ যেতেই হতো। সেই যাত্রায় ‘বাবু’র মাথার ওপর লাল সার্টিনে মোড়া রুপোর ‘রামছাতা’ ধরা হতো।
মহাষ্টমীর সন্ধিপুজোয় একশো আটটি ঘিয়ের প্রদীপ এখনও অবশ্য জ্বালানো হয়, কিন্তু এর পাশাপাশি আরও দু’রকম প্রথা ছিল যা আর আজকাল সচরাচর দেখা যায় না— ‘মানসপূর্তি’তে বাড়ির মহিলারা মাথায় করে সরা নিয়ে তাতে ধুনো পোড়াতেন, আর বাড়ির পুরুষরা ‘মানসপূর্তিতে’ বুক চিরে রক্ত দিতেন।
সেকালে বাড়ির পুজো থেকে বারোয়ারি পুজো সবেতেই মূল নৈবেদ্য ছিল ‘আগা-তোলা মন্ডা’ বা ‘দুর্গামন্ডা’। কাঠের বারকোশের ওপর সাজানো এই মন্ডার ওজন হতো প্রায় দেড় মন। নবমীতে হতো বলি। ছাগল, মোষ, ঘোড়া, মাগুরমাছ, সুপুরি, আখ, কুমড়োর পাশাপাশি পিটুলি দিয়ে শত্রুর প্রতিকৃতি তৈরি করে ‘বলি’ দেওয়ারও রেওয়াজ ছিল সেকালে। ‘বলি’র পর সেই বাড়ির লোক পাঁঠা, মোষ বা ঘোড়ার কাটা মুণ্ডু মাথায় নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরত! এটাই ছিল রীতি। বাড়ির বয়স্ক ঠাকুরদা তাঁর সমবয়সি বন্ধু এবং নাতিপুতিদের সঙ্গে নিয়ে সেই বলির ‘মুণ্ডু’ যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে যেতেন গান করতে করতে। এই গানকে চলিত কথায় বলা হতো ‘কাদা মাটি’র গান। বৃদ্ধ ঠাকুরদার হাতে থাকত একটি খাতা। তাতে লেখা থাকত গান, পাছে গাইতে গাইতে কথা ভুলে যান, তাই এই ব্যবস্থা। এই গানকে ‘খেউড়’ গানও বলা হতো। সেকালে বড় মানুষের বাড়ির পুজোর নিমন্ত্রণে গেলে নিমন্ত্রিতকে প্রণামীর টাকা দিতে হতো সেই বাড়ির পুরোহিতের হাতে। শুধু হাতে ঠাকুর দর্শন করে চলে আসার প্রথা ছিল না। কিছু কিছু জায়গায় বাড়ির ‘বাবু’টি স্বয়ং জরির মছলন্দ পেতে সামনে আতরদান, গোলাপ-বাস সাজিয়ে বসে থাকতেন দোকানের পোদ্দারদের মতো ‘ওঁৎ’ পেতে। এই প্রণামীর টাকাকে সেই জন্য বলা হতো ‘ওঁৎ করা টাকা।’ অনেকে নিজেরা না গিয়ে এই টাকাটা ছেলেপুলেদের হাতে দিয়েও পাঠিয়ে দিতেন। সন্ধে বেলা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছোট ছেলেমেয়েদের বাড়ির ঝি বা চাকর ঠাকুর দেখাতে নিয়ে গেলে তাদের এক সরা ‘জলপান’ দেওয়ার চল ছিল।
প্রতিমা দর্শন করতে মুসলমানরাও আসতেন। এই তথ্য আমরা পাই স্বামী বিবেকানন্দের মেজ ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’ গ্রন্থে। স্থানীয় মুসলমানরা এসে তিনবার মা দুর্গাকে ‘সেলাম-সেলাম-সেলাম’ বলে চলে যেতেন।
প্রত্যেক বাড়িতে লোক খাওয়ানো হতো। ভাত, পাঁচরকম তরকারি, দই আর পায়েস। শাক্ত ব্রাহ্মণ বাড়ি হলে মাছও দেওয়া হতো, কায়স্থ বাড়ি হলে ছিল লুচির চল। দুই বাংলায় আরও দুটি বিপরীত প্রথা ছিল। পশ্চিমবঙ্গে দশমীপুজোয় দেবীকে দেওয়া হতো ‘দধিকর্মা’। পূর্ববঙ্গে দেওয়া হতো পান্তাভাত আর কচুর শাক।
আমরা হয়তো মনে করি নাচগান করতে করতে প্রতিমা বিসর্জনে নিয়ে যাওয়া হয়তো একালেই হয়েছে, কিন্তু না, এই প্রথা বহু পুরনো। যার উল্লেখ আছে জীমূতবাহনের ‘কালবিবেক’ গ্রন্থে। শবরজাতির মতো সারা দেহকে লতাপাতা দিয়ে সাজিয়ে, সারা গায়ে কাদা মেখে নাচ-গান করা হতো বলেই বিজয়া দশমীর এই উৎসবকে বলা হতো ‘শবরোৎসব’। শুধু নাচ-গানই নয়, গ্রাম্যভাষায় একে অন্যকে গালমন্দ করাও এই শবরোৎসবের অঙ্গ। শোভাযাত্রায় অনেক সময় ‘খাস-গেলাস’-এর ঝাড় হতো। মাটির ছোট ছোট মোমবাতি রাখার একরকম বাতিদান হতো, তার মাঝখান থেকে উপর-নীচে দুটো এক ইঞ্চি করে চোঙা থাকত। অভ্রর গেলাস তৈরি করে লাল কাগজের পাড় দিয়ে গেলাসটার উপর দিক ও নীচের দিক জুড়তে হতো। দেখতেও বাহারি হতো, আবার অভ্রটাও পড়ে যেত না। সেই অভ্রর গেলাসটা খুরির উপর আঠা দিয়ে বসান হতো। আর তার ভেতর একটি মোমবাতি থাকত এবং এই মাটির খুরিটা একটা বাখারির, ডাল বা ডান্ডার উপর আটকানো হতো। এইভাবে আট বা দশটা ডাল দিয়ে একটা ‘ঝাড়’ হতো। প্রতিমা নিয়ে গঙ্গায় বাইচ খেলানোরও চল ছিল ‘বাবু’দের মধ্যে। বজরার ছাতে শৌখিনবাবুরা খ্যাম্টাউলি ও বাঈজি সঙ্গে নিয়েও প্রতিমা নিরঞ্জনে যেতেন।
বিজয়ার দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের পর চণ্ডীমণ্ডপে ফিরে পূর্ণ ঘটকে প্রণাম করে ‘শান্তিজল’ নেওয়াই শুধু নয়, সেই সঙ্গে ‘ঘটজল’ ও ‘কাঁচাহলুদও’ খেতে হতো। তারপর হতো শুভ বিজয়ার কোলাকুলি। ছোটরা বিজয়ার দিন পাড়ার বয়স্ক ব্রাহ্মণদের খালি হাতে কিন্তু প্রণাম করতে পারত না, প্রণামী দিতেই হতো। বড়রা সে প্রণামী যেমন নিতেন, তেমনি ছোটদের হাতে তুলে দিতেন নারকোল-ছাবা ও অন্যান্য নারকোলের মিষ্টি। বিজয়ার কোলাকুলিতে এবং প্রণামে ছানার মিষ্টি খাওয়ার নিয়ম ছিল না। কলাপাতায় ‘দুর্গানাম’ লিখতে হতো তারপর, এবং সিদ্ধি মুখে দিতেই হতো সবাইকে। তবেই ঘটত শুভ বিজয়ার পরিসমাপ্তি।