বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
বিবিধ ঘাত-সংঘাত, জ্বালা-যন্ত্রণায় যখন হৃদয়-তন্ত্রী ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়, বিভিন্ন রকম বিপদাপদ বিষাদ-অবসাদে প্রাণমন যখন ভাঙ্গিয়া পড়ে, প্রাণপাতী পরিশ্রম, চেষ্টা-যত্ন, উদ্যোগ উৎসাহ সমস্তই যখন নিদারুণ ব্যর্থতায় পর্য্যবসিত হয়, হতাশা-নিরাশার নিষ্ঠুর কশাঘাতে জর্জ্জরিত হইয়া যখন নিতান্ত অসহায়ভাবে শুধু মরণের প্রতীক্ষায় দিন গণিতে ইচ্ছা হয়, তখন—জীবন-মরণ সমস্যার সেই নিদারুণ দুঃসময়ে একটিবার কেবল হৃদয়ের দ্বার খুলিয়া দাও, সমস্ত প্রাণমন ঢালিয়া শ্রীভগবানের রাতুল চরণে আকুল প্রার্থনা নিবেদন কর, আগ্রহ-ব্যাকুল হৃদয়ে সমস্ত অন্তর দিয়া তাঁহার শরণ গ্রহণ, আশ্রয় ভিক্ষা কর, দেখিবে, মুহূর্ত্তের ভিতর যেন কাহার স্নেহশীতল হস্তের স্নিগ্ধ মধুর স্পর্শে অশান্তির দাবানল নিভিয়া গিয়াছে, সমস্ত জ্বালামালা বিষাদ অবসাদ দূর হইয়া অন্তরের গভীরতম প্রদেশে নির্ম্মল শান্তির অনাবিল ধারা ঝির-ঝির করিয়া বহিয়া চলিয়াছে, কে যেন তোমার আঁধার পথ আলো করিয়া পর্ব্বত-প্রমাণ বাধাবিপদ পায়ে দলিয়া আগে আগে পথ দেখাইয়া চলিয়াছে।
দাও, আপনাকে সম্পূর্ণ রিক্ত করিয়া, মুক্ত করিয়া, উজাড় করিয়া নিঃশেষে তাঁহার শ্রীচরণে ঢালিয়া দাও, প্রার্থনা ও উপাসনার ভিতর দিয়া তাঁহার সহিত নিরবচ্ছিন্নভাবে যুক্ত হও, অন্তরকে সর্ব্বদা পূর্ণরূপে তাঁহার প্রতি উন্মুখ করিয়া রাখ, তবেই নিমেষের মধ্যে তাঁহার কৃপার বৈদ্যুতিক স্পর্শে তোমার হতাশা বিপর্য্যস্ত প্রাণমন সরল সতেজ হইয়া উঠিবে, তাঁহার অহৈতুক করুণাধারায় অভিসিঞ্চিত হইয়া সমগ্র জীবন-জনম ধন্য ও কৃতার্থ হইয়া যাইবে।
আদর্শ ও নীতিই মানুষের জীবনীশক্তি, প্রাণপ্রস্রবণ। প্রত্যেক মানুষ, সমাজ ও জাতি খাঁটি শক্তিমান হয়, সত্যিকার বাঁচা বাঁচিয়া থাকে তাহার শিক্ষা-সংস্কৃতি, আদর্শ ও নীতির অনুসরণে ভিতর দিয়া। যে মানুষ ও যে জাতি যতদিন পর্যন্ত তাহার মহান্ আদর্শ ও নীতিকে প্রাণপণে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকে ততদিনই সে থাকে জগতের বুকে দুর্জ্জয়, দুর্দ্ধর্ষ, দুরতিক্রম্য, অপরাজেয়। রাষ্ট্রিয় অধিকার স্খলিত হইলেও সতেজ প্রাণশক্তি তাহার দুর্ব্বল হয় না, কঠোর নির্য্যাতন নিপীড়নেও প্রবল জীবনীশক্তি কখনও লোপ পায় না। অটুট প্রাণ-শক্তির প্রাচুর্য্যে, মহান্ শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আদর্শের জীবন্ত প্রভাবে সে মরণজয়ী হইয়া মহাকালের বুকে নির্ভয়ে বীরের মত বিচরণ করে, স্বীয় বিজেতাকে পর্য্যন্ত আদর্শ-সমৃদ্ধ মহাজীবনের মন্ত্রে দীক্ষা দান করিয়া শিষ্যরূপে বরণ করিয়া লয়; জগতের ইতিহাস ইহার প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
প্রকৃত মানুষ যে, মহান্ আদর্শ ও নীতিকেই সে জীবনের ধ্রুবতারা বলিয়া গ্রহণ করে। মৎস্য যেমন জলশূন্য হইয়া বাঁচিতে পারে না, প্রকৃত মানুষও তেমনি মহান্ আদর্শ ও নীতি ব্যতীত জীবন ধারণ করিতে সক্ষম হয় না। আদর্শনিষ্ঠ, নীতিপরায়ণ ব্যক্তি এই জন্য যে-কোন বিপদ বরণ করিয়া লইতে প্রস্তুত হয়; কোন অত্যাচার উৎপীড়নকে সে ভয় করে না, লাঞ্ছনা নির্য্যাতনকে গ্রাহ্য করে না, মৃত্যু আসিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত হাসিমুখে সাদরে তাহাকে আলিঙ্গন করে; কিন্তু
জীবনের আদর্শকে কখনও সে পরিত্যাগ করে না। বিদ্যুদ্ঝলসিত, অশনিমন্দ্রিত কাল বৈশাখীর প্রলয়ঝঞ্ঝা মস্তকে ধারণ করিয়া, আততায়ীর গুপ্ত ছুরিকা পশ্চাতে রাখিয়া, শত্রুর শাণিত কৃপাণের মুখে নির্ভয়ে সে আগাইয়া চলে কৃপণের ধনের মত স্বীয় আদর্শ ও নীতিকে বুকে জড়াইয়া ধরিয়া। নিষ্ঠুর নির্য্যাতনের কণ্ঠক-মুকুট সে সানন্দে মাথায় তুলিয়া লয়, ‘সারকে’ অন্তরের গোপন অন্তরালে সযত্নে আগলাইয়া রাখিয়া অত্যাচারীর কোষমুক্ত উদ্যত তরবারি নিম্নে শির আগাইয়া দেয়।