বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
ব্রহ্মের এই ভয়ঙ্করী শক্তিই চণ্ডী। চড়ি ধাতুর অর্থে কোপ করা। চণ্ডী অর্থ কোপময়ী। শরণাগত ভক্তকে আসুরিক আঘাত হইতে রক্ষার জন্য ব্রহ্মশক্তি যখন ভয়ঙ্করী মূর্ত্তি ধরেন তখন তিনি চণ্ডিকা।
চণ্ডীর গুপ্তবতী টীকা অন্যরূপ বলিয়াছেন। ‘‘চণ্ডী নাম পরব্রহ্মণঃ পট্টমহিষী দেবতা।’’ চণ্ডী পরব্রহ্মের পট্টমহিষী দেবী। দেবী বলিতে পরমদেবের প্রধানা শক্তি উদ্দিষ্ট। ব্রহ্ম শক্তিমান্, চণ্ডী শক্তি। সৃষ্টির প্রারম্ভে এক অদ্বিতীয় ব্রহ্ম দুই রূপ হইয়াছে—ব্রহ্মধর্ম্মী ও চণ্ডীধর্ম্মী।
ব্রহ্মের শক্তি তিনটি। শ্বেতাশ্বতর শ্রুতি বলেন, ‘স্বাভাবিকী-জ্ঞান-বল-ক্রিয়া চ’’, জ্ঞানশক্তি, ইচ্ছাশক্তি ও ক্রিয়াশক্তি—এই প্রকাশ একই অখণ্ড শক্তির। সেই অখণ্ড শক্তির নাম চণ্ডী। আর ঐ ত্রিবিধ প্রকারময়ী মূর্ত্তির নাম মহাকালিকা, মহালক্ষ্মী ও মহাসরস্বতী। তন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ সাধকেরা বলেন, মহাসরস্বতী চিদ্রূপা, মহালক্ষ্মী সদ্রূপা ও মহাকালী আনন্দরূপা। এই ত্রিতয়ের সমষ্টি শক্তিভূতা সচ্চিদানন্দময়ী চণ্ডিকা।
চণ্ডী গ্রন্থের তিনটি ভাগ—প্রথম চরিত, মধ্যম চরিত ও উত্তর চরিত। প্রথম চরিতে অধিষ্ঠাত্রী দেবী মহাকালিকা, মধ্যম চরিতে মহালক্ষ্মী, আর মহাসরস্বতী হইলেন উত্তর চরিতের প্রতিপাদ্য দেবতা। শ্রীনারায়ণের নাভিপদ্মস্থিত ব্রহ্মা মধুকৈটভ-বধার্থ যাঁহার স্তব করিয়াছেন, তিনি হইলেন মহাকালী। তিনিই সৃষ্টির আদিতত্ত্ব। সংহিতা গ্রন্থে মনু বলিয়াছেন, সৃষ্টির আদিতে কিছু ছিল না, ছিল কেবল অন্ধকার ‘‘আসীদিদম্ তমোভূতম্’’। ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্ত প্রশ্ন তুলিয়াছেন—যখন কিছু ছিল না, তখন কি ছিল? যখন পৃথিবী ছিল না, আকাশ ছিল না, রাত্রি দিনের প্রভেদ ছিল না, যাহা আছে তাহাও ছিল না ‘‘নাসদাসীন্নো সদাসীৎ’’, তখন কি ছিল?
বৈদিকঋষির এই অনন্তজিজ্ঞাসার উত্তর দিয়াছেন বেদ নিজেই পুরুষসূক্তে। যখন কিছু ছিল না, তখন ‘‘পুরুষ’’ ছিলেন। ‘‘পুরুষ এবেদং সর্ব্বং। যাহা কিছু ছিল বা থাকিবে, সকলই সে পুরুষ হইতে—‘‘যদ্ভূতং যচ্চ ভাব্যং’’। তন্ত্রশাস্ত্র এই উত্তরে তৃপ্ত নয়। তান্ত্রিক আচার্য্য জিজ্ঞাসা করেন, যখন পুরুষ ছিল না, তখন কে ছিল? নিগমশাস্ত্র বেদ বলেন, পুরুষ ছিল না, এখন কখনও হয় না। আগমশাস্ত্র তন্ত্র তাহা মানিয়াও মানিতেছে না। বলেন, পুরুষ যখন থাকিয়াও নাই, তখন কে আছেন?
থাকিয়া নাই কথাটির তাৎপর্য বুঝিতে হইবে। বাড়ীর দরজায় ‘‘In’’ দেখিয়া, আপনি আছেন জানিয়া, প্রবেশ করিলাম। পরে নিদ্রিত আছেন দেখিয়া, আলাপ না করিয়া ফিরিয়া আসিলাম। আপনি বাড়ীতে থাকিয়াও নাই। পুরুষ যখন নিদ্রিত আছেন, তখন কে আছেন; আগম তাহা জানিতে চায়। নিগম উত্তর দিতে পারে না। আগমশাস্ত্রের নির্য্যাস চণ্ডী উত্তর দিতেছেন। কল্পান্তে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডও কারণসমুদ্রে পরিণত হইয়াছে, ‘‘জগত্যেকার্ণবীকৃতে।’’ অনন্তশয়নে ব্রহ্মপুরুষ মহাবিষ্ণু নিদ্রিত। পুরুষের সহিত অনন্ত জগৎ সুপ্ত। তখন জাগিয়া আছেন একমাত্র যোগনিদ্রা। ইনি মহানিদ্রা, মোহনিদ্রা, মহারাত্রি, মহাদেবী, মহাকালিকা। ইনিই শ্রীহরির নেত্রে অধিষ্ঠান করিয়া আছেন, ‘‘হরিনেত্রকৃতালয়াম্’’। নেত্র শব্দ সকল ইন্দ্রিয়ের উপলক্ষণ। হরির সর্ব্ব ইন্দ্রিয় অভিভূত করিয়া রাখিয়াছেন এই মহাতামসী মহাশক্তি দেবী।
তন্ত্রমতে ইনিই সৃষ্টির আদি। সৃষ্টিকর্ত্তা ব্রহ্মা ইঁহার দর্শন লাভ করিয়াছেন। দর্শনের কাহিনী বলিতেছি। নিদ্রিত পুরুষের নাভিকমলে, ব্রহ্মা সৃষ্টি-শক্তি, নূতন সৃষ্টির ধ্যানে মগ্ন। সৃষ্টি ক্রিয়াটি স্পন্দনময়ী। স্পন্দনের মূলে গতিবেগ। বাধা ছাড়া গতি নাই, frictionless motion হয় না। সৃষ্টির শক্তির বাধা উপস্থিত হইল। বিষ্ণুর কর্ণমলোদ্ভূত মধু ও কৈটভ দুই অসুর—বেদান্ত-দর্শনের আবরণ ও বিক্ষেপ, সাংখ্যের রজঃ ও তমঃ গুণ। তাহারাই তন্ত্রশাস্ত্রের মধু ও কৈটভ। তাহারা ব্রহ্মাকে বধ করিতে উদ্যত হইল, ‘‘হন্তুং ব্রহ্মাণমুদ্যতৌ।’’ ভীত ব্রহ্মা নিদ্রামগ্ন হরির জাগরণের নিমিত্ত তাঁহার নয়নাশ্রিতা মহানিদ্রাস্বরূপিণী মহাকালিকার স্তব করিলেন। ব্রহ্মা বলিলেন, ‘‘মাতঃ! তোমার শক্তিতে ভগবান্ হরিও যখন নিশেষ্টভাবে শয়ান, তখন ব্রহ্মাণ্ডে আর কে আছে তোমার স্তুতি করিতে সমর্থ?
মহানামব্রত ব্রহ্মচারী ‘চণ্ডী চিন্তা’ থেকে