বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
আমরা অনেকেই শ্রীরামকৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতাররূপে পূজা করি। ‘অনেকেই’ বলছি এই কারণে যে, আমাদের মধ্যে এমন কেউ কেউ থাকতে পারেন, যাঁরা সেই দৃষ্টিতে তাঁকে দেখেন না। কাজেই তাঁকে অবতাররূপে না দেখলেও তাঁকে পূর্ণাঙ্গ মানবরূপে দেখার চেষ্টা সকলেই করতে পারেন। ঈশ্বর যখন অবতাররূপে মর্ত্যে আগমন করেন, তখন তাঁর সকল ঐশ্বর্য তাঁর মানবরূপের আড়ালে ঢেকে রাখেন। তিনি সাধারণ মানুষের মতো আচরণ করেন; কখনো কখনো মানুষের স্বাভাবিক অসুস্থতার লক্ষণও তাঁর মধ্যে প্রকাশিত হয়। জন্ম, মৃত্যু, জরা, ব্যাধি—এ-গুলি মানবজীবনের অপরিহার্য অবস্থা। অবতারকেও এসব কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তবু আমরা তাঁকে বলি ‘ঈশ্বর’। এই হলেন অবতার, যাঁর মধ্যে ঘটেছে মানব ও ঈশ্বরের একত্র সমাবেশ। মানুষের স্বাভাবিক গুণাগুণ তাঁর মধ্যে সহজাত; কিন্তু মানুষের মাপকাঠিতে যখন তাঁকে বিচার করতে যাই, তখন দেখি, ঐ মাপকাঠিতে তাঁকে কুলোচ্ছে না। তাই তাঁকে বলা হয় ‘অতিমানব’। তবে কি আখ্যায় তাঁকে ভূষিত করব, সেটা বড় কথা নয়; মনে রাখতে হবে, তাঁকে দৃষ্টান্ত থেকেই আমাদের জীবনের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। সেই লক্ষ্যে পৌঁছাবার প্রেরণা তাঁর কাছ থেকেই আমরা লাভ করব এবং সেই পথের নির্দেশ ও তাঁর জীবন থেকেই আমরা পেয়ে যাব। এই পথের সন্ধান দিতেই এই পৃথিবীতে মানবরূপে তাঁর অবতীর্ণ হওয়া।
ঈশ্বর যদি সর্বনিয়ন্তা, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপী এবং সর্বজ্ঞ ঈশ্বরই থাকতেন, তাতে আমাদের কি লাভ হতো? তিনি আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যেতেন। সাধারণ মানুষ আমরা। অত অসাধারণ যে-ব্যক্তিত্ব, তাঁকে আমরা ধারণা করতে পারি না। কাজেই ভগবান যখন দেখেন, মানুষ তাঁর কাছ থেকে একেবারে বিচ্যুত হয়ে পড়ছে, জগতের ত্রিতাপজ্বালায় জ্বলছে অথচ তাঁর যে প্রেরণাদায়ক অমৃতরস তার আস্বাদন থেকে বঞ্চিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ছে, তখন তিনি মর্ত্যে অবতীর্ণ হন যাতে মানুষ তাদের অভীষ্ট পথের সন্ধান পায়, তাদের লক্ষ্য সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করতে পারে এবং এই অনন্ত শক্তিকে তাদের ধরাছোঁয়ার মধ্যে অনুভব করতে পারে। সাধারণ মানুষ ভগবানকে সম্পূর্ণরূপে বুঝতে কখনই পারে না। ভাগবতে একটা বর্ণনা আছে—চাঁদ জলের ওপর প্রতিবিম্বিত হয়েছে। মাছেরা চাঁদের সেই প্রতিবিম্বকে মনে করেছে তাদের মতোই এক জলচর প্রাণী। তাকে নিয়েই তারা খেলা করছে। ঠিক সেই রকম ভগবান যখন আমাদের মধ্যে অবতীর্ণ হন তখন তিনি মানুষরূপেই আসেন, তাঁর ব্যবহার দেখে মনে হয় তিনি যেন আমাদের খেলার সাথী, আমাদের একান্ত আপনজন। তাঁর কাছে আমাদের কোন সঙ্কোচ নেই, ভয় নেই। তাঁর সঙ্গে আমরা আমাদের সমগ্র জীবনটা অতিবাহিত করতে পারি। ভগবানের কাছে এরূপ মানবদেহ ধারণের কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি না জানি না, কিন্তু আমাদের কাছে তাঁর অবতরণের অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা আছে।
স্বীমী ভূতেশানন্দজী’র ‘শ্রীরামকৃষ্ণ ও যুগধর্ম’ থেকে