বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
সেদিনের আসরে এসেছেন নরেন্দ্রনাথ—সরস আলাপে দক্ষিণেশ্বর হয়ে উঠেছে মর্ম্মরিত। বলেন ঠাকুর,—দেখ একজন মরে ভূত হয়েছিল, অনেকদিন একা থেকে থেকে সঙ্গীর অভাবে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলে। কোন স্থানে কেউ মরছে শুনলে ছুটে যেত—ভাবত এইবার বুঝি সঙ্গী জুটবে। দেখত মৃত ব্যক্তির গঙ্গাস্পর্শে হয়েছে মুক্তি—এমনি করে তার সঙ্গীর অভাব মেটেনি। আমারও ঠিক সেই দশা—তোকে দেখে ভেবেছিলাম বুঝি একটা সঙ্গী জুটল—কিন্তু তুইত বল্লি তোর বাপ মা আছে। আমার সঙ্গী পাওয়া আর হোল না ...নরেন্দ্রনাথের চিরউন্নত শির সেদিন কুণ্ঠায় হয়ে পড়ে একান্ত নম্র। স্তিমিত স্মৃতির দুয়ার খুলে ভাবেন...
প্রথম দর্শনের দিন গেছে কেটে—শক্তিমান নরেন্দ্রনাথের প্রাণে জেগে থাকে অসীমের একটি আকুল ডাক-সাড়া দিতে গিয়ে যেন জাগে না সাড়া-সিংহ-শিশুর থমকিত শরীরে জাগে শক্তির পরীক্ষা...বাঁধনের গঙ্গাধারার মত কূলে কূলে জাগে মুক্তির আকুলতা...দিনে দিনে মাস যায় সরে...নরেন্দ্রনাথ হয়ে পড়েন অশান্ত...সেদিন এক পরমলগ্নে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ছুটে চলেন সপ্তর্ষির ঋষি, অসীমের টানে উধাও যেন গঙ্গা—নয়নে স্বাতী লোকের চিরতৃষা...আলো আর ছায়ার মিতালী তার পদক্ষেপে—
ভগবান সেদিন দক্ষিণেশ্বরে আছেন বসে ভাবে অর্ধনগ্ন আপনহারা—উন্মত্তের মত প্রবেশ করেন নরেন্দ্রনাথ—চোখে সারা যুগের প্রশ্ন ছাওয়া-হিউম, মিল্, বেন্, শঙ্করের তৃষ্ণা নিয়ে উপলভঙ্গ গতিতে এসেছেন সর্ব-তীর্থসার, দক্ষিণেশ্বরে— সর্বতৃষার গঙ্গাযমুনায়...
শ্রীঠাকুর এলেন এগিয়ে, তার প্রশ্নের উত্তরে চোখে জেগেছে শিব সম্মোহনের যাদু। দাক্ষায়ণীর মত দক্ষিণচরণটি দিলেন তাঁর বুকে ছুঁইয়ে—ত্রস্ত চকিত সচেষ্ট নরেন্দ্রনাথের বিশ্বে সহসা নেমে এল অবলুপ্তির ঘূর্ণি—উচকিত নরেন্দ্রনাথের কণ্ঠে জাগে ভয়ার্ত এক চীৎকার,—ওগো! আমার এ কি করলে-আমার যে বাবা আছে…অসীমের মমতা নিয়ে শ্রীঠাকুরের জাগে খলখল হাসি—এ হাসি যেন মহামায়ার নিজের খেয়াল খুসীরখেলায়, নিজের পরাজয়েরই হাসি—বলেন,—আচ্ছা থাক্, থাক্, পরে হবে।
এই পরের জন্যই প্রয়োজন ছিল দীর্ঘ পাঁচ বৎসরের পরম প্রতীক্ষা—এরজন্যই প্রয়োজন ছিল সিদ্ধার্থের সব হারানোর পথ বৈরাগ্য।
এর পরের কথা—সেদিন পুণ্যতীর্থে তীর্থযাত্রীদের লেগেছে ভীড়, মধুকরের মতো তারা ঘিরে আছেন দেবতাকে সহসা নরেন্দ্রনাথ এসে উপস্থিত, জলন্ত উল্কার জ্বালা নিয়ে।
শ্রীঠাকুরসত্যানন্দের ‘রচনাবলী’(১ম খণ্ড) থেকে