‘সুনীচেন’ শব্দের ব্যাখ্যায় মহাপ্রভু বলেছিলেন—
‘‘তৃণ হইতে নীচু হইয়া সবে নিক নাম।
আপনি নিরভিমানী, অন্যে দিবে মান।’’
নিজে তৃণ হ’তেও অধিকতর সহিষ্ণু হয়ে পরমপুরুষের নামগান করো; নিজের অভিমান ত্যাগ করো, তখনই অন্যে তোমার প্রশংসা করবে, যশোগান গাইবে।
‘তরোরিব সহিষ্ণুনা’। যে গাছ খুব বড় কিন্তু ফল ধরে না, সংস্কৃত ভাষায় তাকে বলে বনস্পতি। আর যে গাছ আকারে বড় হয় ও ফলও দেয় তাকে বৃক্ষও বলে, তরুও বলে। কিন্তু আবার সেই গাছ যদি দেখতে খুব সুন্দর হয় তা’হলে ওগুলিকে কেবল ‘তরু’ বলা হয়। আর দেখতে সুন্দর না হলে বলা হয় বৃক্ষ। এমনিতে সব গাছকে (Plant) সংস্কৃতে মহীরূহ বলে অর্থাৎ যা মাটি ভেদ করে উপরে উঠেছে। ছোট চারাগাছকে মহীরূহ বলা যেতে পারে যদিও ওটা আকারে ছোট, তবে এক্ষেত্রে শিশু-মহীরূহ বলা যেতে পারে।
তরুর মত সহিষ্ণু হওয়া মানে, যেমন বৃক্ষ বা তরুলতাকে আঘাত হানলে বা নানান ভাবে আঘাত-প্রত্যাঘাত করলেও তারা যেমন তা বরদাস্ত করে নেয়, মানুষকেও তেমনি সহনশীল হতে হবে। অবশ্য একথার অর্থ এই নয় যে কোন দুষ্ট ব্যষ্টি তোমাকে আঘাত করতে এল বা তোমার প্রাণ সংহার করতে এল আর তুমি সেটা বিনা প্রতিবাদে সয়ে নিল। এর তাৎপর্য হ’ল এই যে তোমার মধ্যে কী পরিমাণ সহ্যশক্তি রয়েছে তুমি সেটা পরীক্ষা করো। তাতে তোমার গভীর আত্মবিশ্বাস জাগবে এই জেনে যে তুমি কত দূর পর্যন্ত সহ্য করতে পারবে। এখন দেখতে পাই যে তোমরা তোমাদের সহনশক্তির কোন পরীক্ষা কর না, কিছু ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তৎক্ষণাৎ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দাও। আমি বলব, তা না করে কখনো কখনো ওটা পরীক্ষা করে দেখো তোমার মধ্যে কতটা সহনশক্তি রয়েছে, তাতে তোমার আত্মবিশ্বাস আরো দৃঢ় হবে। যেমন গাছকে কাটলেও সে প্রতিবাদ করে না, গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহেও গাছ মানুষের কাছে জল চায় না, অথচ সেই গাছই পূজারীকে ফুল দেয়, পথিককে ফল দেয়, ছায়া দেয়। কিন্তু সে তো পূজারীকে, পথিককে বলে না— ‘আমাকে জল দাও।’
অপরের প্রতি তোমার কিছু করণীয় রয়েছে কিন্তু তোমার প্রতি অপরের কিছু করণীয় নেই। প্রত্যেকের আপন আপন কর্তব্য নির্দিষ্ট রয়েছে। কেবল এই ভাবনা নিয়ে যে এগিয়ে চলে সেই কেবল ঠিক ঠিক সেবা কাজ করতে পারে। নতুবা যে লোকটা সেবা করছে তার মনে যদি এই ভাবনা থাকে, আমি তো ওর জন্যে এই এই কাজটা করেছি তাহলে ওরও তো আমার জন্যে এই এই কাজটা করা উচিত। তাই সেবকের মনে এই ভাবটা থাকবে যে অপরের প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে কিন্তু আমার প্রতি কারো কর্তব্য নেই। বৃক্ষ যেমন ছায়া দিয়ে, ফুল-ফল তথা জ্বালানি দিয়ে সকলের সেবা করে, উপকার করে কিন্তু প্রতিদানে কিছুই চায় না, সাধকের জীবনও ওই একই ধরনের মহান নীতিবোধের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। কিন্তু সমাজে এমন বহু মানুষ আছেন যাঁদের বলতে শোনা যায়—‘আমরা বহু বৎসর থেকে সমাজ সেবা করছি।’ গোপন ইচ্ছাটা এই, ‘এখন আমাকে পেনশন দেওয়া হোক, মেডেল দেওয়া হোক। লোকে সরকারের কাছে সুপারিশ করুক এই বলে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলুম, তাই স্বাধীনোত্তর ভারতে আমাকে সরকারী পেনশন দেওয়া হোক।’’ তাদের মনের কোণে এই ধরনের গোপন ইচ্ছা লুকিয়ে থাকে। দোকানদার যেমন পয়সা নেয়, লবণ দেয়, তেমনি এই ধরনের লোকেরাও সমাজ সেবার বিনিময়ে কিছু সরকারী খেতাব, কিছু সরকারী অনুদান আশা করে, কামনা করে। বাস্তবে এ ধরনের সেবা সেবাই নয়। ‘আপনি নিরভিমানী, অন্যে দিবে মান।’ এখন যে লোকটা আগে থেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত, তাকে তো সম্মান মানুষ দিয়েই থাকে। কিন্তু এখানে মহাপ্রভুর বক্তব্য হ’ল, যার সমাজে কোন প্রতিষ্ঠা নেই, কোন মান-খাতির নেই, যাকে কেউ সম্মান দেয় না, যার কেউ খোঁজখবর নেয় না, এমন যে মানহারা মানুষ—‘অমানিনং’—তুমি তাকে সম্মান দেবে, তার খোঁজখবর নেবে, তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করবে।
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তির ‘ভক্তিরস ও কীর্ত্তনমহিমা’ থেকে