সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
ঔপনিষদিক ধারা বা বেদান্ত প্রতিপাদ্য ‘আত্মতত্ত্ব’—এই সংস্কৃতির ভাবধারা আজও বহন করে চলেছেন বাউল সন্ন্যাসীরা। বাউল সেই বেদান্ত-উপনিষদ প্রতিপাদ্য আত্মতত্ত্বের অনুসন্ধানে বের হয়ে পড়েন ঘর ছেড়ে। কোথায় তাঁর সেই ‘মনের মানুষ’ বা দেহাতীত আত্মতত্ত্ব? উন্মুখ হয়ে ঘুরতে থাকেন দেশ হতে দেশান্তরে। তাঁর বাউণ্ডুলে বিবাগী মন খুঁজতে থাকে সেই নিত্য শাশ্বত অবিনশ্বর বেদপুরুষ আত্মতত্ত্বকে। তাঁর বৈরাগ্যবিধুর বেদনা মূর্ত হয়ে ওঠে অনুরাগে— ‘কোথায় পাবো তাঁরে,আমার মনের মানুষ যেরে?’ অবশেষে তিনিই আবিষ্কার করেন তাঁর চির আকাঙ্ক্ষিত সেই ‘মনের মানুষ’কে।
এই বিরাট বিশ্বসংসাররূপে যাঁর স্বতঃপ্রকাশ,সেই তত্ত্বই তাঁর ভেতর প্রকাশ। সীমার ভেতর তিনি বোধেবোধ করেন সীমাহীনকে। অসীমের সীমাধারণ আর সীমার অভিব্যক্তি অসীমের প্রতি। সবই প্রেমময় পরমেশ্বরের লীলা—সবই তাঁর প্রকাশ।
বাউল জীবনের ভেতর সেই পরমতত্ত্বকে অপরোক্ষ অনুভব করেন। তিনি দেহভাণ্ডই ব্রহ্মাণ্ডের বোধেবোধ করেন।
জীবন পরমেশ্বরেরই প্রকাশ। তাঁরই জীবনরূপী লীলা চলছে। সেই এক তত্ত্বই বহু নাম-রূপ ধারণ করে লীলা করছেন। এই লীলার আধার আনন্দ আর আনন্দের আধার প্রেম। এই বিশ্বসংসার তাঁর প্রেমময় প্রকাশ। এই অনন্ত প্রেমতত্ত্বে তাঁর আনন্দময় লীলা চলছে। সমস্ত কিছুর ভেতরই তিনি বিরাজমান বা সমস্ত কিছুতেই ভাসমান। এককথায় তিনি সবেতে; সব তাঁতে—তিনি ছাড়া কিছু নেই। ওতঃপ্রোত অখণ্ড। তিনি নিত্য-শাশ্বত-সনাতন। তিনিই আত্মতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্ব। অজ্ঞানই শুধু অনিত্য। অবিদ্যা-আচ্ছন্ন জীব তা উপলব্ধি করতে পারছে না। কারণ সে অসহজ, অবিদ্যাগ্রস্ত-‘মনের মানুষ’কে ভুলছে। সেইজন্য তার এত দুঃখ-কষ্ট, শোক ও হাহাকার। ‘মনের মানুষ’কে না জেনে তার জীবন বিষময় হয়ে পড়েছে। অসহজ ও কপট ভাবের হেতু সে যে অমৃতস্বরূপ—এটা তার বোধ নেই। তাই শোকার্ত হয়ে বিষময় জীবন-যাপন করছে। আত্মবিস্মৃত, আত্মজ্ঞান-রহিত, অবিদ্যাগ্রস্ত, অজ্ঞান জীবই অসহজ। সেইজন্যই সে শোক করছে। আর আত্ম-সচেতন, অবিদ্যা-অজ্ঞানমুক্ত আত্মতত্ত্ববিদ ব্রহ্মজ্ঞই আত্মস্বরূপ, আত্মজ্ঞ বা সহজ।
উপনিষদের এই মর্মবাণীকে আপনার জীবনে বোধেবোধ করে—সেই বোধিকে সহজ ভাষায় গান রচনা করে গেয়ে বেড়ান বাউল গ্রামে-গঞ্জে, শহরে, নগরে-মানুষের দ্বারে দ্বারে। এঁরা সাক্ষাৎ জীবনের পূজারী—অভিনয়ের পূজারী নন।
‘বাউল’ কোন সম্প্রদায় নয় বা বাদগ্রস্ত দলও নয়। বাউল বোধির দ্বারা অভিভূত পরম আত্মতত্ত্বকে সহজ ভাষায় প্রচার করেন। বাউলের প্রচারিত জীবনবাদ-ধর্ম। জীবনকে বাদ দিয়ে বাদ ধর্ম নয়। জীবনের ভেতর দিয়েই তাঁকে অপরোক্ষ অনুভব করতে হবে, জীবনকে নষ্ট করে নয়। জীবন সেই তত্ত্বের প্রকাশ। জীবনের ভেতর দিয়ে সেই তত্ত্বের সাক্ষাতকার—এটাই জীবনের রহস্য। এই রহস্য উদঘাটন করে মানবকে সেই পরমতত্ত্ব বা অমৃতস্বরূপ আত্মতত্ত্বকে বোধেবোধ করতে হবে। জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ সেটাই। এইজন্যই বাউল উপনিষদের জীবন্তরূপ সনাতন-ধর্মের বাহক-জীবনের পূজারী বা উপাসক। বাউল উপনিষদের সৃজনমুখী আত্মতত্ত্বের সাধক ও প্রচারক।
বাউলের সম্প্রদায়গত কোন বিবাদ নেই। মতবাদ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ করেন না বাউল। এঁরা তত্ত্বমুখী বা জীবনমুখী। জীবনবিরোধী অনাত্ম বা অজ্ঞান-অবিদ্যাকে বাউলগণ আশ্রয় করেন না। নিত্য শাশ্বত আত্মতত্ত্বই বাউলের লক্ষ্য। সেই তত্ত্বই নিত্য শাশ্বত আত্মা-জীবন তার প্রকাশ। বাউল বাদ নিয়ে বিবাদ না করে পরমতত্ত্ব বোধের জন্য তৎপর বা উন্মুখ হন। আর সেইজন্যই অনিত্যের প্রতি তাঁর বৈরাগ্য এবং নিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ।
স্বামী পরমানন্দের ‘বাউলের মর্মকথা’ থেকে