সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
১৯৭৮ সনের মার্চ মাসে আমার স্বামী সরকারী কার্যোপলক্ষ্যে গৌহাটী(আসাম) গেলেন। কামাখ্যা পাহাড়ে একটি কুমারী পূজো করবো অভিপ্রায়ে আমিও সঙ্গে গেলাম। মাকে একখানি চিঠি দিয়ে গেলাম, “তুমি পূজো গ্রহণ করো, ফিরে এসে নববর্ষে তোমাকে প্রণাম করতে যেন যেতে পারি সে খেয়াল রেখো।” মা তখন কোথায় তাও জানি না। দু’সপ্তাহের পর আসাম থেকে ফিরে এসে দেখি বনখল থেকে মায়ের আবাহন এসেছে— “তুমি আসবে আনন্দের কথা।” তখন আর কোনো কিন্তু নেই। মাতৃকৃপায় টিকিটও অদ্ভুতভাবে মিলে গেল। আমার স্বামী ও আমি হরিদ্বার রওনা হব, শুনলাম তরুদির ভাগবত ১লা বৈশাখ থেকে। আমরা ১৪ই এপ্রিল দিদিমার সন্ন্যাস উৎসবের দিন হরিদ্বার পৌঁছালাম। ১৫ই এপ্রিল ভাগবত শুরু হলো। এর আগে কখনও দেখি নাই বা শুনি নাই যে, একজনের ভাগবতের সঙ্গে অন্যেরা ভাগবত দিতে পারে। এই ভাগবতের সঙ্গে পুষ্পাদি ও কান্তিদি ভাগবত দিচ্ছেন দেখে ভাগবতের ষষ্ঠ দিনে মাকে প্রণাম করতে গিয়ে আমার অন্তরের ইচ্ছা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। “মা, ছোটভাবে যে ভাগবত করা যায় তা তো জানতাম না। এসব দেখে আমার শ্বশুরমশায়, শাশুড়ী, বাবা, মা সকলেই মৃত, এঁদের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যতে আমার একটা ভাগবত দিতে ইচ্ছা হচ্ছে।” মা কথাটা শোনামাত্র বললেন, “খুব ভালো কথা,তুই এখনই স্বামীজীকে বল্।” মার যেন তর সয় না। আমি স্বামীজীকে বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, “অক্ষয় তৃতীয়ার উৎসবের পর ১১ই মে থেকে একটি ভাগবত হবে সেই সঙ্গে কর।” আমি বললাম, “এতো তাড়াতাড়ি কি করে হবে? আমরা কাল কলকাতা ফিরে যাচ্ছি, টিকিট করা আছে। আমার স্বামী এখনই আবার ছুটি নিয়ে আসতে পারবেন না। মাত্র ১৫ দিন সময় পাবো।”
স্বামীজী বললেন, “তাহলে আবার কবে হবে জানি না।” শঙ্কিতমনে মায়ের কাছে গেলাম ও স্বামীজীর কথা বললাম। মা বললেন, “ভালোই তো— ১১ই তারিখ থেকে ভাগবত শুরু হবে।” এ কথা শুনে আমি আবার স্বামীজীর কাছে ফিরে এসে বললাম, “একলা আসতে হবে। ১৫ দিন মাত্র সময়, টিকিট পাওয়াও যাবে না মনে হচ্ছে।” স্বামীজী মাথা চাপড়ে বললেন, “তুই একলা আসলেই হবে। মা যখন বলেছেন সব ঠিক হয়ে যাবে, তুই শুধু চেষ্টা কর। ১দিন আগে পৌঁছলেই হবে।” আবার মার কাছে ছুটলাম। মার কাছে ঢোকার কতো তো বাধা। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি কোনো বাধার সম্মুখীন হ’লাম না। মাকে সব বলাতে মা তো খুব খুশী। বললাম, “তোমার বাবা, ছেলে কেউই আসতে পারবে না, আমাকে একলা আসতে হবে। টিকিটও পাওয়া যাবে কিনা জানি না।” মা শোনেন, হাসেন, মাথায় হাত দেন, তবুও মানা করেন না। এতো কম সময় পাবো, আমি মনে মনে ভাবি, মা যদি বলেন এখন না করে পরে করতে, তবে বাঁচি। টাকার কথা স্বামীজীর সাথে যা হয়েছে, মাকে সব বললাম মা মনোযোগ দিয়ে সব শুনে বললেন, “আচ্ছা।”
আবার স্বামীজীর কাছে ফিরে গেলাম, বললাম “স্বামীজী আমি যাঁদের সাথে ভাগবত করবো, তাঁরা কোথাকার এবং কে ভাগবত ব্যাখ্যা করবেন?” তখন আমি বললাম, “আমার শ্বশুর, শাশুড়ী, বাবা, মা কেউই হিন্দী বোঝেন না। স্বামীও সঙ্গে আসতে পারছেন না।” স্বামীজী বললেন, “তাতে কি হবে? স্বামীর মত নিয়ে তুই আসলেই হবে।” আবার মার কাছে চললাম। কোনো বাধা পেলাম না। চট্ করে মায়ের ঘরে ঢুকে পড়ে বললাম, “মা হিন্দীতে ভাগবত ব্যাখ্যা হবে। ওঁরা কেউই তো হিন্দী জানেন না।” মা বললেন, “আত্মার কাছে ভাষার সমস্যা নাই।” মা যখন কেবল উৎসাহই দিয়ে গেলেন তখন আমি বললাম, “আমার শরীরটাও খুবই খারাপ। টিকিট পাবার সম্ভাবনাও খুব কম। এতো অল্প সময়— আর যদি আসি, অক্ষয় তৃতীয়াতে শ্রী শ্রী শঙ্করাচার্য্যের মূর্তি প্রতিষ্ঠা দেখবো না কেন? তুমি সব খেয়াল রেখো তবে হবে।” মা হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমার মাথায় ও পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন। মায়ের আশীর্বাদে মনে খুব বল ভরসা পেলাম। এ বিষয়ে তরুদির ভাগবতাচার্য্য শ্রীনারায়ণ গোস্বামী ও আমাদের আশ্রমের পূজ্যপাদ নারায়ণ স্বামীজী আমায় খুব উৎসাহিত করলেন। ওঁরা বললেন, “মা যখন খেয়াল কললেন, তখন করে ফেলাই ভালো, শুভকাজ ফেলে রাখতে নাই।” ওঁরাও দু’জনে বললেন, “স্বামীর অনুমতি থাকলে কাজ করা যায়। তাতে কোনো প্রত্যবায় হয় না।” আমার স্বামীও তখন উপস্থিত ছিলেন। শ্রীনারায়ণ স্বামীজী বললেন, “তোমার উপর মায়ের অশেষ কৃপা। তুমি ছেলেকে আনতে চেষ্টা করো।” তখন ছেলের ছুটি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। স্বরূপানন্দ স্বামীজী বললেন, “অসুস্থ শরীর, ফেরার টিকিটটা করে যাও নারায়ণ গোস্বামীজীর সাথে। উনি মায়ের জন্মোৎসবে আসবেন।” গোস্বামীজী বললেন, “আমি মায়ের আদেশ মতো অক্ষয় তৃতীয়ার উৎসবে উপস্থিত থাকবো। আপনার ভাগবত একদিন শুনতে পারবো। তারপর চলে যাবো। পরে আবার মায়ের জন্মোৎসবে স্বামীজীর নির্দেশানুসারে আসতে হবে। ২৯শে মে ফিরে যাব।” অন্য কোনো সঙ্গী না দেখে ওঁর সঙ্গে ফেরার টিকিট করার জন্য স্বামীজীকে টাকা দিলাম। এদিকে আসা হবে কিনা তারও তখনও নিশ্চয়তা নাই। নিজেও ভালো হিন্দী বুঝি না, ভাগবত হিন্দীতে ব্যাখ্যা হবে বলে মনটা খুঁতখুঁত করছিল। যাই হোক ২৩শে এপ্রিল কলকাতায় ফিরে এলাম। মা কয়েকজন ভক্তকে কিছু দিতে বলেছিলেন বলে ওদের জিনিষ নিয়ে রওনা হয়ে ঐদিন আমার ইচ্ছামতো ভাগবতের কিছু জিনিষ কেনা হয়ে গেল ও অর্ডার দেওয়া হয়ে গেল। ২৩/৪ তাং টিকিট কাটতে দেওয়া হলো। আমার শরীর ভালো ছিল না বলে বৌমা আমাকে একলা ছাড়তে রাজী হলো না। ওর পরীক্ষা ছিল বলে আমি ওকে যেতে মানা করেছিলাম। যাই হোক্ ২দিন পর খবর পেলাম ৭/৫ তাং একটা কূপে পাওয়া গিয়েছে। নিশ্চিন্ত হলাম। সবই মায়ের অদ্ভুত লীলা। এই পনেরো দিনের মধ্যে আমার যে ইচ্ছার উদয় হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তা পূরণ হয়েছে। লোডশেডিং- এর জন্য স্যাকরা অনেকেই গয়না দিতে পারছিলেন না। অথচ আমার সামান্য যা কিছু সব তৈরী হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত ছেলে বললো যে সেও ৪/৫দিন ভাগবতে যোগ দিতে পারবে।
৭ই মে রওনা হয়ে আমরা ৯ই মে কনখলে পৌঁছলাম। স্বামীজী ও নির্মলদা থাকার সুব্যবস্থা করলেন। রাত্রে মাকে শ্বশুর-শাশুড়ী ও বাবা-মার ফটো দেখালাম। বললাম, কাল থেকে তো ভাগবত। মা কেমন অন্যমনস্ক ও ব্যস্তভাবে বললেন, “কাল থেকে হবে?” এদিকে ভদ্রেশ্বর থেকে গাঙ্গুলী দম্পতি সদলবলে এলেন। তখন শুনলাম ঐ বাঙালী পরিবারের সাথেই আমার ভাগবত হবে। আমি তো শুনে অবাক্। তারপর শুনি বৃন্দাবন থেকে পাঠকও আসেন নাই। এদিকে মা ভাগবত শুরু হবার আগের দিন রাত্রে নারায়ণ গোস্বামীজীকে ডেকে ভাগবত ব্যাখ্যা করার জন্য বললেন। ওনার খুব কাশি, গলা ধরে আছে। পনেরো দিন আগে উনি তরুদির ভাগবত ব্যাখ্যা করেছেন। শরীরও ক্লান্ত। গলাও খারাপ। উনি কিছুতেই রাজী হচ্ছেন না- মাও বারবার তাঁকে পাঠ করার জন্য বলছেন। গোস্বামীজী তখন মাকে বলছেন, “আপনি আমার গলায় হাত বুলিয়ে দিন তবে আমি পারবো।” মা বললেন, বাবা তুমি আগেরবার তো এ কথা বলোনি।” গোস্বামীজী বললেন, “তখন আমি বাড়ী থেকে গৃহদেবতার সুপ্রসন্ন মুখ দেখে বেরিয়েছিলাম, আমার কোনো ভয় ভাবনা ছিল না। এখন সবে একটা শেষ হয়েছে, গলা ধরে রয়েছে। আমি পারবো না মা।” কিন্তু মা তাঁকে ছাড়েন না। শেষ পর্যন্ত উনি রাজী হয়ে গেলেন। আমি ফেরার সময় ট্রেনে ওনার মুখ থেকে এ কাহিনী শুনেছি। তারপর উনি বললেন, “মার কাছে রাজী হয়ে আমি চিন্তিত মনে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম। আমার ঘরের বারান্দায় ছবিদিদের কীর্তন সারা রাত ধরে হচ্ছিল। হঠাৎ শেষ রাত্রে শুনতে পেলাম কে জানি বলছে এই- ওষুধটা খাও। গলা ভালো হয়ে যাবে। তিনবার একথা শুনে আমি সকচিত হয়ে উঠে দরজা খুলে দেখলাম কোথায়ও কেউ নেই। বারান্দায় কীর্তন হচ্ছে। ওষুধটার নাম লিখে রেখে আমি আবার শুয়ে পড়লাম। তখন শেষ রাত। চোখবুজে শুয়ে আছি, দেখি একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলছে, “আমায় সোনার বাঁশী করে দাও।” তখন আমার সর্বদেহ কন্টকিত হয়ে উঠেছে। আমি শয্যাত্যাগ করে উঠে পড়লাম। সকালে উঠে পাটনকে ওষুধটা এনে দিতে বললাম। পাটন ডাক্তারের প্রেসক্রিপসন্ বিনা ওষুধ খেতে মানা করলো। কাজেই আমি বাধ্য হয়ে পাটনকে ঘটনাটা বললাম। পাটন অনেক দোকান খুঁজে ওষুধটা জোগাড় করে এনে দিল। ওষুধটার উপর লেখা ছিল যে সেটা কাশি ও গলাভাঙা সারার ওষুধ। মা পাটনের কাছে ব্যাপারটা জেনে আমাকে ডেকে সব কথা শুনলেন।” ওনার শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও মাতৃকৃপায় অতি সুন্দরভাবে ভাগবত ব্যাখ্যা করছিলেন। গলাভাঙার জন্য কোনো অসুবিধাই হয়নি। আমাদেরও বাংলায় শোনার বাসনা মা এভাবে পূর্ণ করেছিলেন।