সহজে মন নিবিষ্ট হয় এরকমটি দেখেই জপের স্থান নির্ধারণ প্রয়োজন। সাধারণত মন্দিরাদিতে বা গৃহাদির পূজার স্থানে জপাদি প্রশস্ত। যেখানে যে-ভাবের ক্রিয়া সচরাচর অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে সে ধরনের প্রয়াস সহজে ফল লাভ করে। যেখানে বসে অনেক সাধক জপতপ করে গেছেন, যেখানে সর্ব্বদাই ঈশ্বরীয় স্মরণ-মনন হয়, সেখানে জপ-ক্রিয়া সহজে বীর্য্যবতী হয়। তীর্থাদিতে জপসাধনা করা তাই আরও প্রশস্ত। কারণ সেখানকার আকাশ-বাতাস বহু অজানা অচেনা সাধুসন্তের নিয়ত ঈশ্বরীয় স্মরণ-মনন দ্বারা পূত-পবিত্র এবং শক্তিসম্পুটিত। তীর্থাদিতে অনেক অপকর্ম্ম অনুষ্ঠিত হয় সত্য, তবুও সৎলোকের আনাগোনা সেখানে চিরকালই থেকে যায়—নানা প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও। নিজের পূজার আসনে বসে সাধারণ মানুষ জপ করতে সুবিধা বা প্রেরণা বোধ করেন। জপের স্থান শান্ত সমাহিত ও সুন্দর হওয়া প্রয়োজন। মন এরকম জায়গায় সহজেই একমুখী হতে চায়।
‘কোণে-বনে-মনে’—জপাদি ক্রিয়া করণীয় বলা হয়। ‘কোণে’ মানে লোকচক্ষুর অন্তরালে, ‘বনে’ মানে যেখানে হট্টগোল বা অধিক জনসমাগম নেই, আর ‘মন’ মানে জপক্রিয়া যতটা সম্ভব লোকে যেন টের না পায়। সাধনা যতবেশী গুপ্ত থাকে ততই বেশী শক্তিপুটিত হয়। বনের নির্জ্জনতা জপাদির পক্ষে ভাল, তবে সর্ব্বক্ষেত্রে তা নয়। ভাল এই কারণে, সেখানে কোলাহল, লোকের আনাগোনা, কর্ম্মচাঞ্চল্য ইত্যাদি থাকে না। মন্দ এজন্যে—এখানে জীবন-নির্ব্বাহ অতি কঠিন হয়। দস্যু, পশুর ভয় যদি থাকে, নির্জ্জনতা যদি কামাদির প্রাবল্য ঘটায়, অন্যবিধ বিঘ্ন-বিপাক যদি প্রবল হয়, তবে বনে গেলেই জপ খুব ভাল এগোবে এরকম মনে করা ভুল। ঘর থেকে মন্দিরে, তারপর নদী তীরে বা প্রান্তরে—এভাবে নিজেকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখতে হয়। তাতেও যদি ইষ্ট-ব্যাকুলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে, তবে তখন বনে গিয়ে সাধনা সুরু করা যেতে পারে।
আসল কথা, মনকে ঈশ্বরীয় নামে ডুবিয়ে দেওয়া। অনেক গুপ্তযোগী আছেন, যাঁদের কাছে শুনেছি, তাঁদের দিনরাতের কর্ম্মব্যস্ত জীবনে তাঁদের ‌঩জপের উৎকৃষ্ট স্থান হচ্ছে, ভীড় বাস বা ট্রেনের ঠেলাঠেলির মধ্যে অথবা রাতে মশারির ভিতরে। চারিদিকে হৈ-হট্টগোল, তবু তাঁরা যদি একটু ভাল ক’রে দাঁড়াতে বা বসে থাকতে পারেন, তবে চোখ বুঁজে কান বন্ধ ক’রে তাঁরা ইষ্টনামের জপে প্রেম্‌঩সে ঐ বিরুদ্ধ পরিবেশেই লেগে যান। বাইরের কোলাহল চঞ্চলতা অসারতা তাঁকে সারবস্তু অন্বেষণে সেখানে যেন অধিক প্রেরণা যোগায়। সারাদিনে অবসর হয় না, তাই রাতে শয়নের কালে কিছুটা সময় নিজের ঘুম থেকে কমিয়ে দিয়ে তাঁরা লোকচক্ষুর অন্তরালে সাধনা চালিয়ে যান। অবশ্য এসব হল ব্যতিক্রম।
পূর্বে আলোচিত হয়েছে, জপের স্থানে নিজ ইষ্টমূর্ত্তি বা গুরুমূর্ত্তি রাখা ভাল কারণ এঁরা সাক্ষাৎ প্রেরণা সঞ্চার করেন। পূজার আসনে সাধারণত এসব থাকে। অন্যত্র যেখানে এ-সবের সুবিধা নেই, সেখানে মনে মনে সেই ইষ্টমূর্ত্তি ও নিজ গুরুমূর্ত্তি স্মরণ ক’রে নেওয়া যেতে পারে। জপের স্থানে বহু মূর্ত্তি, বহু ছবি ইত্যাদি রাখা মনের একমুখীতা বিনষ্ট করে। ‌঩জপের স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, শান্ত, নিরিবিলি এবং বাহুল্য-বর্জ্জিত হওয়া প্রয়োজন। পূজার আসনে বা গৃহে বা স্থানে বাহুল্য এলেই ঈশ্বরে মনোনিবেশ ঘাটতি ঘটে। জপের স্থানে বা আসনে কোনও ইন্দ্রিয়পরায়ণ বা বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন ব্যক্তিকে বসতে বা ঘেঁসতে দিতে নেই। রোগাদি যেমন সংক্রামক, ভাবও তেমনি সংক্রামক। যাঁরা অগ্রবর্ত্তী সাধক তাঁরা যে-কোন পরিস্থিতিতে ঈশ্বরীয় নামজপে সমর্থ। কিন্তু প্রবর্ত্তকদের ক্ষেত্রে জপের স্থাননির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জপ পায়খানায়, স্নানাগারে, রাস্তাঘাটে সর্ব্বত্রই সব সময়ই করা যেতে পারে। ঈশ্বরীয় নাম-গ্রহণের কোন নির্দ্দিষ্ট স্থান থাকতে পারে না; কারণ ঈশ্বর জগতের কোন স্থানেই অনুপস্থিত নন। তবু সাধক প্রধানত জপকর্ম্মের সুবিধার দিকে তাকিয়েই স্থানাদি নির্ব্বাচনে প্রবৃত্ত হন।
অযাচকের ‘জপ’ থেকে