বিশেষ নিবন্ধ

ইলিশের গল্প, ইলিশের রাজনীতি
মৃণালকান্তি দাস

দেশ ভাগ হয়েছে কবেই। সীমান্তে এখন কাঁটাতারের বেড়া। তবু আজও দশমীর সকালে বাংলাদেশের পাবনা থেকে জোড়া ইলিশ নিয়ে সান্যাল বাড়িতে হাজির হন মহম্মদ আব্দুল। জলপাইগুড়ি শহরের কামারপাড়ার সান্যাল বাড়ির দুর্গাপুজোয় সেই ইলিশ দেবী দুর্গার সামনে কুলোয় রেখে বরণ করেন পরিবারের বধূরা। সঙ্গে থাকে লাউয়ের ডগা ও বেগুন। বাড়ির বধূরা নতুন শাড়ি পরে, মুখে পান দিয়ে ইলিশ না ভেজেই রান্না করেন। তা দিয়েই হয় দেবীর ভোগ।
১৯৪১ সাল নাগাদ অবিভক্ত বাংলাদেশের পাবনা জেলার বখতারপুরে সান্যাল পরিবারের দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল। সান্যাল পরিবারের পুজোয় মহম্মদ আব্দুলদের পূর্বপুরুষেরা জোড়া ইলিশ পৌঁছে দিতেন। দেশের বাড়ির ঠাকুর দালানের মাটি মাথায় করে নিয়ে এসে জলপাইগুড়িতে ঠাকুর দালান গড়ে তুলেছিলেন পরিবারের তৎকালীন কর্তা জয়চন্দ্র সান্যাল। দেশ ভাগ হলেও বংশের পরম্পরা মেনেই আজও আব্দুল দশমীতে জোড়া ইলিশ জলপাইগুড়িতে পৌঁছে দেন। বাংলার দুর্গাপুজোকে ঘিরে ইলিশের এমন কাহিনি যে কত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তা কে জানে। আজও দুর্গাপুজোয় অনেক বাড়ির পুজোর ভোগে ইলিশ চাই-ই চাই।
ইতিহাস জানাচ্ছে, ইলিশ রান্নার কাহিনি রয়েছে ‘পদ্মপুরাণ’-এও। ‘রোহিতের মুণ্ড দিয়া রান্ধে মুলাশাক/ সরিষার শাক রান্ধে ইলিশার শিরে।’ পদ্মপুরাণে বরিশালের ভূমিপুত্র মনসামঙ্গল–এর রচয়িতা বিজয়গুপ্ত লিখছেন, ‘আনিআ ইলিশ মৎস্য করিল ফালা ফালা/ তাহা দিআ রান্ধে ব্যঞ্জন দক্ষিণ সাগর কলা।’ এপাড় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে এক সময় ইলিশ মাছ বাড়িতে প্রথম আনা হলে, ইলিশের এক খাবলা আঁশ তুলে নিয়ে বাড়ির উঠোনে পুঁতে দেওয়া হতো। বিশ্বাস ছিল, এর ফলে বাড়িতে ধনসম্পত্তি বাড়বে আর বড় ঘরে বাড়ির ছেলে-মেয়ের বিয়ে হবে। কলকাতার অনেক বনেদি বাড়িতে পরম্পরা ছিল, বাড়িতে প্রথম আসা ইলিশকে সিঁদুর মাখিয়ে বিয়ে দেওয়া হতো রান্নাঘরের সিঁদুর মাখানো নোড়াটির সঙ্গে। বিয়ের পর সেই মাছ কেটেকুটে পাঠানো হতো গুরু বা কুলপুরোহিতের বাড়ি। ভাগ পেত আশপাশের ঠাকুরের থানও।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে ‘পদ্মা’ নামাঙ্কিত বজরায় কাল অতিবাহিত করেও রবীন্দ্রনাথের মন কখনও কেন ‘ইলিশময়’ হয়ে ওঠেনি, তা অবশ্যই এক বিস্ময়! এমন নয় যে, মাছ নিয়ে কবিগুরুর ছুৎমার্গ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে গিয়েছেন, ‘জেনো বাসনার সেরা বাসা রসনায়’। আর তাই বোধহয় তাঁর ‘দামোদর শেঠ’ ‘অল্পেতে খুশি’ হয় না। তাঁর মুড়কির মোয়া চাই, চাই ভাজা ভেটকি। কবি তো ‘দামোদর শেঠ’র সঙ্গে ভেটকির অন্ত্যমিল খুঁজে পেয়েছিলেন। চিতল মাছকে বলেছেন ‘মিঠাই গজার ছোট ভাই’। নৌকাডুবিতে রমেশ কালিদাসকে দিয়ে আওড়েছেন, ‘স্বপ্ন নয়, মায়া নয়, মতিভ্রম নয়, এ যে রুই মাছের মুড়ো!’ স্মৃতিচারণা করেছেন পারিবারিক মাঝি আব্দুলকে নিয়েও, যিনি ‘হালের কাছে বসে থাকতেন, যাঁর দাড়ি ছিল ছুঁচলো, গোঁফ কামানো ও মাথা নেড়া’ এবং যিনি তাঁর দাদাকে এনে দিতেন ‘পদ্মার ইলিশ ও কচ্ছপের ডিম’। ব্যস ওইটুকুই! ইলিশ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মতো একই রকম আবেগহীন নজরুলও। ইলিশ যেন তাঁর কাছে কাব্যে উপেক্ষিতা ঊর্মিলা! অথচ তাঁদের উত্তরসূরি বুদ্ধদেব বসুর কলমে ইলিশ ‘রজতবর্ণ মনোহরদর্শন মৎস্যকুলরাজ মহান’ এবং বিস্ময়করভাবে ‘প্রতিভাধর’! ইলিশ নিয়ে বাঙালির এই বিহ্বলতা কত কালের, কে জানে। এত কাব্যও আর কোনও মাছ নিয়ে হয়েছে কি না, সন্দেহ।
এই ইলিশ ঘিরেই তো কত রাজনীতি। কত আকচা–আকছি। কত গবেষণা, ইলিশের বংশ ও কুল রক্ষার এমন প্রাণান্ত প্রচেষ্টাও পৃথিবীর কোনও প্রান্তে কোনও মাছের জন্য হয়তো হয়নি। যেন ইলিশের থাকা না থাকার উপর নির্ভর করে রয়েছে বাঙালিত্বের টিকে থাকার প্রশ্ন। যদিও সেখানেও ভাগাভাগি। কেউ বলেন ইলিশই এই দুনিয়ায় একমাত্র রাজনৈতিক মাছ। কেউ বলেন, কূটনৈতিক মাছ। ইলিশ নিয়ে বাঙালির বিহ্বলতা, কাব্য, আবেশ এবং ‘ভারত-বাংলাদেশ’ দু’দেশের অন্তহীন আকচা–আকচি আর কোথাও সম্ভবত নেই।
বাংলাদেশে ঢোকার পর গঙ্গার নাম হয়েছে পদ্মা। কেউ ভাবে না, নদীটা কিন্তু এক। এই নদীতে ‘ডায়াকম’ নামে এক শেওলা জন্মায়। সেই শেওলা ইলিশের অতি প্রিয় খাদ্য। আশ্চর্য, ডায়াকম কিন্তু মেঘনা বা অন্য নদীতে জন্মায় না। পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গার তুলনায় বাংলাদেশের পদ্মা আড়ে–বহরে, দৈর্ঘ্যে–প্রস্থে বেশি। ফলে ডায়াকমের পরিমাণও বেশি। পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি হওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণ সেটাই। নব্বই দশকের একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন ছিল: ‘বাতির রাজা ফিলিপস, মাছের রাজা ইলিশ।’ সময়ের পরিক্রমায় বাতির রাজা হারিয়ে গেলেও, ইলিশ কিন্তু আরও বেশি শক্তিশালী। সম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক ক্ষেত্রে সেই ইলিশ নিয়ে চলেছে ঠান্ডা যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আসে কলকাতার বাঙালির পাতে। তা নিয়েও সমস্যার কিছু ছিল না। তবে সমস্যা বাঁধে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েনে। গত পঞ্চাশ বছরে এই টানাপোড়েনে ঢুকে পড়েছে ইলিশ।
হাসিনা সরকার বাঙালির ধর্মীয় পার্বণের প্রতি সম্মান ও সহানুভূতি দেখিয়ে বছরে তিনবার ইলিশ রপ্তানির চুক্তি করেছিল। যদিও খাতায়-কলমে বাংলাদেশ সরকার সেটাকে পুজো, নববর্ষ ও জামাইষষ্ঠীর ‘উপহার’ হিসেবেই দেখাত। গত বছরও, পুজোর মুখে, হাসিনা সরকার ৪ হাজার টন পদ্মার ইলিশ পাঠিয়েছিল। সে-সময়ও হয়তো দেশীয় বাজারে জোগানে টান পড়ত, কিন্তু পড়শি রাজ্যের সর্ববৃহৎ অনুষ্ঠানে যাতে বাঙালির পাত পদ্মার ইলিশের সুবাস থেকে বঞ্চিত না-হয়, সেটা দরদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। হাসিনা পতনের পর সেই শিষ্টাচার ধরে রাখতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার কতটা সচেষ্ট হবে– তা নিয়ে ধন্দ ছিল।
শেষ পর্যন্ত বাঙালির রসনায় থাবা বসিয়েছিল ভারত বিরোধী আবেগ। ক্ষমতায় এসেই সে-দেশের মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছিলেন, দেশের মানুষকে বঞ্চিত করে এ-বছর ওপার বাংলায় পদ্মা-মেঘনার ইলিশ পাঠানোর সিদ্ধান্ত খারিজ করা হয়েছে। তাঁর মতে, রপ্তানির ফলে দেশীয় বাজারে জোগান কমে যাওয়ার কারণে দেশবাসীকে বেশি দাম দিয়ে ইলিশ খরিদ করতে হয়। তারপর বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়া থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়ে গিয়েছিল ইলিশ নিয়ে রাজনীতি। সেইসব মন্তব্য দেখলে মনে হবে, যেন ইলিশ না এলে ভারতীয়রা অনাহারে থাকবে। চোখের জলে ভাসবে বাঙালিরা! নয়াদিল্লি অবশ্য জানিয়ে দিয়েছিল, ইলিশের মতো ‘ক্ষুদ্র ইস্যু’ ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্কে কোনও প্রভাব ফেলবে না। শুধু তাই-ই নয়, ইলিশ রপ্তানি নিয়ে টানাপোড়েন চললেও, ভারত থেকে ডিমের আমদানি বন্ধ হয়নি। তার উপর বাংলাদেশের তরফে আলু ও পেঁয়াজের রপ্তানি অন্য বছরের মতোই স্বাভাবিক রাখার জন্য অনুরোধ এসেছে। ভারত রপ্তানি না-করলে বাংলাদেশে আলুর দাম দাঁড়াবে কেজি প্রতি ৭০ টাকা এবং পেঁয়াজ ১৪০ টাকা। ভারত থেকে স্বাভাবিক রপ্তানি পৌঁছলে কেজি পিছু আলুর দাম কমে হবে ৪০ টাকা এবং পেঁয়াজের কিলো প্রতি দাম ১০০ টাকার নীচে নামবে।
কয়েক সপ্তাহ পরেই বাংলাদেশের উপদেষ্টারা সেই অঙ্ক বুঝলেন, ৫ লাখ ৭১ হাজার টনের মতো ইলিশ উৎপাদিত হলে রপ্তানি না করে উপায় কই। ভারতে ইলিশ না গেলে মরবে তাঁদের দেশের মৎসজীবীরাই। কারণ, অত জোগানে বাংলাদেশে ইলিশের দাম কমে যাবে। কারবারিদের ক্ষতি হবে। বৈধপথে রপ্তানি বন্ধ থাকলে, অবৈধ পথে ইলিশ চোরাচালান বেড়ে যেতে বাধ্য। তাছাড়া বাঙালির অত্যধিক ইলিশপ্রেম অন্য প্রজাতির মাছও ক্রমে ধ্বংস করে দেবে। জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে পরিবেশের বারোটা বাজবে। ফলে ২১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের তরফে জানানো হয়, পুজোর আগে ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানি হবে। মোট উৎপাদনের ০.৫ শতাংশেরও কম। রিজার্ভ ও রেমিট্যান্সে টানাটানির সময়ে বছরে গড়ে এক কোটি ডলারের আয় কে ছাড়তে চায়? ভারত থেকে শুঁটকি ও তাজা মাছ আমদানিতে ব্যয় হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের প্রশ্নও রয়েছে। যদি ইলিশ না যায়, তাহলে আমদানি করা কাতলা থেকে কাঁচকির দাম গাঁটের বৈদেশিক মুদ্রা দিয়েই মেটাতে হবে। বাণিজ্য মন্ত্রকের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমদের বক্তব্য, ‘যারা ইমোশনালি কথাবার্তা বলে বলুক। তবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমি বিভিন্ন মহল থেকে বাহবা পাচ্ছি।’
বাংলাদেশের অনেকে মনে করেন, চুরাশি বছর আগে বুদ্ধদেব বসু ‘কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে–ঘরে ইলিশ ভাজার গন্ধ’ ও ‘সরস শর্ষের ঝাঁজে’ বর্ষার সঙ্গে ‘ইলিশ উৎসব’–এর যে অনবদ্য যুগলবন্দি সৃষ্টি করেছিলেন, আজ তা বাংলাদেশের কৃপার উপর নির্ভর করে জেগে রয়েছে। এই দৈন্যের মধ্যে গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের চুলচেরা বিশ্লেষণ ও কাজিয়া এখন কেমন যেন নিদারুণ ঠাট্টা ও অবিশ্বাস্য কৌতুক মনে হয়! ইলিশের আঁতুড়ঘর যে দেশ, বাজার ও ব্যাপারীদের বাড়াবাড়ির কারণেই সে দেশের অন্তত দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষ ইলিশের স্বাদ গ্রহণে অপারগ। বাংলাদেশের বাজার ক্রেতার প্রয়োজনমতো কেটে মাছ বিক্রি করে না। নিতে হবে গোটা। এ প্রশ্নে সব সরকারই উদাসীন। সবাই জানে, ব্যবসায়ীদের চটালে রাজনীতির ক্ষতি। সব শ্রেণির উপভোক্তার স্বার্থে কখনও বাংলাদেশে আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। হাজার টাকা কেজি দরে গোটা মাছ কেনার সামর্থ্য যাঁদের নেই, ইলিশ তাঁদের কাছে মরীচিকাই। ইলিশের হাত ধরে সে দেশের হেঁশেলে হেঁশেলে আজও শোনা যায়নি সাম্যবাদের গান।
আর এপারে? ভাদ্র মাসের গুমোট গরম আর মাঝেমধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে যাকে ভালোবাসার মতো পিঁড়ি পেতে দেয় আম বাঙালি, ‘ঝোলে ঝালে অম্বলে তোমাকে চাই’ বলে হাঁক পাড়লেও চালকুমড়ো বা কালো জিরে বাটা দিয়ে ইলিশের পদ রান্নার সাহস দেখাতে ক’জন পারেন— সেই প্রতিযোগিতা শুরু। পুজো মরশুমে বাঙালির হেঁশেল জানান দেয়, রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে। 
অন্তত একদিন...অতএব, জলের রুপোলি শস্য ঘরে তুলে আনতে বাজারের থলিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। শারদ উৎসবে ইলিশ-দুপুর সবার শুভ হোক।
9h 9m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাপড়ের ব্যবসায় অগ্রগতি। পেশাদার শিল্পীদের পক্ষে দিনটি শুভ। উচ্চ/উচ্চতর শিক্ষায় উন্নতি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৯৯ টাকা৮৪.৭৩ টাকা
পাউন্ড১১০.৩৮ টাকা১১০.৩৮ টাকা
ইউরো৯১.৮১ টাকা৯৫.০১ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
2nd     October,   2024
দিন পঞ্জিকা