বিশেষ নিবন্ধ

কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলির কাঠামো বদল দরকার
সমৃদ্ধ দত্ত 

 

অপরাধীদের কাছে একসময় আতঙ্কের নাম ছিল সিবিআই। শুনলেই ভয় ভয় লাগত তাদের। আর এখন সারাক্ষণ সিবিআই ভয়ে ভয়ে থাকে কোনও রাজ্যে অপরাধ ঘটেছে শুনলেই। ভয়ে ভয়ে থাকার কারণ হল, এখনই সিবিআই তদন্তের দাবি উঠবে। আর সেই দাবি মেনে নিয়ে যদি তদন্তভার সিবিআইয়ের ঘাড়ে চাপানো হয়, তাহলে আবার নতুন কেসের বোঝা আসবে। কর্মী, অফিসার, তদন্তকারীর সংখ্যা ক্রমশ কমছে। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কেসের সংখ্যা। নাজেহাল সিবিআই। অতীতে সিবিআই পোস্টিং হওয়া মানে আইপিএসদের কাছে বেশ প্রেস্টিজ ইস্যু। স্ট্যাটাস বেড়ে যেত। আর এখন আইপিএস অথবা অন্য পুলিস অফিসাররা মনেপ্রাণে চান, সিবিআইতে যেন পোস্টিং না হয়। কারণ, একবার ঢোকা মানে একের পর এক অপরাধমূলক ঘটনার তদন্ত কাঁধে চাপা। রাজনৈতিক চাপ। ভবিষ্যৎ সেরকম উজ্জ্বল নয়। সবথেকে বড় সঙ্কট হল, তদন্তে অপরাধের প্রমাণ পেলেই হল না। কোন অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হবে, আর কাকে করা হবে না, রাজনৈতিক এই দাবাখেলার গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভর করে তদন্ত। ঠিক যে কারণে মনমোহন সিং সরকারের আমলেও সুপ্রিম কোর্ট সিবিআইকে বলেছে খাঁচায় বন্দি তোতাপাখি। নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলেও সুপ্রিম কোর্ট একই কথা বলেছে কয়েকদিন আগে। 
বাংলায় বিরোধী দলগুলির একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়। যে কোনও অপরাধমূলক ঘটনা ঘটলে প্রথমেই তারা দাবি করে, সিবিআই তদন্ত হোক। সিবিআই তদন্ত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে প্রবল এক হর্ষ লক্ষ করা যায়। কারণ কী? কারণ, তারা ধরে নেয় এবার রাজ্য সরকার অথবা শাসক দল বিরাট কোনও সঙ্কটে পড়তে চলেছে। বিপদ আসন্ন। তারা যাদের বিরুদ্ধে, তাদের সবাইকে জেলে পোরা হবে। অপেক্ষা করে তারা। অতি উৎসাহে সেইসব তদন্তের প্রাথমিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে পর্যালোচনা হয়। মিডিয়ায় শোনা যায়, নানাবিধ সিবিআই সূত্রের কথা। আজ সিবিআই ওখানে রেইড করেছে। কাল সিবিআই সেখানে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছে। পরশু সিবিআই সাংঘাতিক অপকর্মের সন্ধান পেয়েছে। একটি দুটি করে গ্রেপ্তার হয়। জেলে পাঠানো হয় তাদের। প্রবল উল্লসিত হয় বিরোধীরা। কিন্তু একটা সময় পর দেখা যায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা একে একে জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার মূলস্রোতে ফিরে আসে। 
তদন্তের কয়েকমাস অথবা বছর গড়িয়ে গেলে কিংবা অভিযুক্তরা জামিন পেলে, বিরোধীরা বলতে শুরু করে, সেটিং আছে। কেন্দ্র এবং রাজ্যের মধ্যে সেটিং না থাকলে কেনই বা এরকম ঢিলেঢালা তদন্ত হবে? সেই কারণেই সিবিআই তদন্ত ঠিকভাবে করছে না। এরকম অভিযোগ করা হয়।  এর আগেও সিবিআই তদন্তে দাবি করা হয়েছে। তদন্ত হয়েছে। একটি নয়। অসংখ্য। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তদন্ত চলার পর আবার বলা হয়েছে, সেটিং আছে। প্রশ্ন হল, প্রথমে দাবি করা হবে সিবিআই চাই। তারপর বলা হবে সেটিং আছে। এই প্রবণতায় অভিযোগের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়।  
আজ তদন্ত শুরু হল, আগামী কাল গ্রেপ্তার হল, পরশুদিন চার্জশিট হবে, তারপর দিন সাজার ঘোষণা। এরকম হয় না।  আর জি করেও হবে না। কিন্তু প্রশ্ন তুলতে হবে যে, সিবিআইয়ের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণ কী? তারা অথবা ইডি মহাবিক্রমে প্রথমে হইহই করে অতি সক্রিয়তা দেখিয়ে তদন্তের হেডলাইন ম্যানেজমেন্ট করায় কেন? আর তারপর ধীরে ধীরে আবার সব স্তিমিতই বা হয়ে যায় কেন? কোন কেসে মেটেরিয়াল আছে, আর কোনটায় নেই, এটা তো তারা কিছুদিন পরই বুঝতে পারে। তাহলে সেইমতো অগ্রসর হওয়াই তো উচিত। নচেৎ অরবিন্দ কেজরিওয়াল থেকে অনুব্রত মণ্ডল। সকলেই মুক্তি পাবেন জামিনে এভাবেই। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় এজেন্সির প্রমাণ দাখিলে ব্যর্থতা। 
সিবিআই শব্দটির যতটা ব্র্যান্ড নেম আছে, ততটাই বদনাম তৈরি হয়েছে। কারণ স্বাভাবিক। সিবিআইয়ের হাতে পাহাড় প্রমাণ তদন্তভার। আর অপরাধের কিনারা না হওয়া মামলার সংখ্যা অসংখ্য। পাশাপাশি তদন্ত হয়েছে অথচ শুনানিপর্ব অন্তহীনভাবে হয়ে চলেছে এরকম সংখ্যাও বিপুল। ভারতের বিভিন্ন আদালতে প্রায় সাত হাজারের বেশি সিবিআইয়ের তদন্ত করা দুর্নীতির মামলা এখনও নিষ্পত্তিহীন। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে সিবিআইয়ের রুজু করা এরকম দুর্নীতির মামলার সংখ্যা ৩৬১। সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশন এই রিপোর্ট দিয়েছে। ৬৫৮টি  দুর্নীতির তদন্তের কিনারা এখনও হয়নি। তদন্ত চলছেই। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬৯০৩। তিন বছরের সময় ধরে চলছে এরকম দুর্নীতির মামলা চলছে ৮৭৫। পাঁচ বছর ধরে মামলা চলছে এরকম সিবিআই কেসের সংখ্যা ২১৮৮। এই পরিসংখ্যান ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অর্থাৎ বিগত ৮ মাসে দেশজুড়ে আরও বেড়েছে সিবিআই তদন্ত ও মামলার সংখ্যা। ২০২৩ সাল পর্যন্ত এক হাজারের বেশি তদন্ত পেন্ডিং। আর ৮৭৩ তদন্ত সমাপ্ত 
করেছে সিবিআই। অর্থাৎ প্রিলিমিনারি ইনভেস্টিগেশন অথবা চার্জশিট। 
সিবিআই বোফর্স মামলার তদন্ত ১৯৮৭ সাল থেকে করে এসেছে। না ধরতে পেরেছে কাত্রোচ্চিকে। না হয়েছে কোনও রহস্য উদ্ধার। সিবিআই রবীন্দ্রনাথের নোবেল মেডেল উদ্ধার করতে পারেনি। সিবিআই আরুষী থেকে নিঠারি। সারদা থেকে নারদা। অসংখ্য গ্রেপ্তার করেছে। জেলে পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রমাণ করতে পারেনি অপরাধ। 
কেন এই ব্যর্থতা? কারণ সিবিআইয়ের মতো একটি প্রিমিয়ার ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিকে তুখোড় একটি তদন্তকারী সংস্থায় পরিণত করার জন্য যতটা পরিকাঠামো নির্মাণ এবং প্রশিক্ষণের সুযোগ প্রদানের দরকার ছিল, সেটি করা হয়নি। কর্মী অফিসারের সংখ্যা অনেক কম। উল্টে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হল, বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে এই এজেন্সিকে ব্যবহার করা। সিবিআইয়ের প্রধান কাজ তাই রাজনৈতিক। তার ফলে ভারতের যে ক্ষতি হয়েছে, সেটি হল, একটিও আন্তর্জাতিক মানের তদন্তকারী সংস্থা, গোয়েন্দা বিভাগ নেই। ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির কাজ হল, শুধুই সন্ত্রাস সংক্রান্ত তদন্ত। ইডির কাজ অর্থনৈতিক অনিয়মের তদন্ত। কিন্তু এফবিআই ধাঁচের তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে সিবিআইয়ের উত্তরণ ঘটল না। 
সিবিআইতে মোট অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৭২৯৫। অথচ শূন্যপদ ১৬১০। নিয়োগ হচ্ছে না। পোস্টিং হচ্ছে না এই পদগুলিতে। অনুমোদিত পদের সংখ্যা অন্তত ১০ হাজার হওয়া উচিত বলে দাবি করেন সিবিআই অফিসাররা। কারণ এখন যে কোনও রাজ্যে দুর্নীতি, অনিয়ম, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি যে কোনও অপরাধের ঘটনা সামনে এলেই সর্বাগ্রে সিবিআই তদন্তের দাবি ওঠে। এর ফলে এমনও উদাহরণ রয়েছে যে, একজন তদন্তকারী অফিসারের কাঁধে হয়তো ২০টির বেশি অপরাধের তদন্তভার চাপানো হয়েছে। তিনি দিশাহারা হয়ে যাচ্ছেন। যে টিমের অফিসাররা অসমে কাজ করছেন, তাঁদেরই হঠাৎ বাংলায় পাঠানো হচ্ছে। আবার মধ্যপ্রদেশে যেতে হচ্ছে। 
সিবিআই অথবা যে কোনও তদন্তকারী সংস্থার কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল, অভিযোগ প্রমাণ করা। গ্রেপ্তার করলেই হল না। চার্জশিট দিলেই তদন্ত সমাধা হয় না। আদালতে শুনানির সময় প্রতিটি অভিযোগের প্রামাণ্য নথি দিতে হয়। এভিডেন্স দিতে হয়। আদালতে যদি অভিযুক্তপক্ষের আইনজীবীর পাল্টা প্রমাণ, যুক্তি, অ্যালিবাই এবং সাক্ষ্যের সামনে সিবিআইয়ের প্রদান করা নথিপত্র দুর্বল হয়ে যায়, তাহলে মামলাও হবে দুর্বল। অতঃপর আবার ব্যর্থতা। 
২০১৪ সালের পর থেকে বাংলায় একের পর এক ঘটনার তদন্ত করছে সিবিআই। প্রতিটি ঘটনা সামনে আসে। প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নানাবিধ গ্রেপ্তার হয়। সিবিআই ‘সূত্র’ মারফত অনেক তথ্য প্রচারিত হয়। যার একটাও পরবর্তীকালে এস্টাবলিশ করতে পারে না সিবিআই। সেই তদন্তগুলির স্ট্যাটাস কী? কিছুই জানা যায় না। সিবিআই সূত্র দ্বারা প্রচারিত আগের ঘটনাগুলির কোনও প্রচার প্রমাণিত হয়নি। তাহলে এখন গালগল্প বিশ্বাস করবে কেন আম জনতা? আগে প্রমাণ পেশ করা হোক আদালতে। 
একটি দেশের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো হল সুরক্ষা। ভারত বারংবার সুরক্ষা ব্যর্থতার শিকার হয়েছে। আইএসআই দাউদ ইব্রাহিমের নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে মুম্বইয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল অনায়াসে।  কাঠমান্ডু থেকে দিল্লি আসার ফ্লাইট নির্বিঘ্নে হাইজ্যাক করে নেওয়া হল এবং মাসুদ আজহারসহ একঝাঁক সন্ত্রাসবাদীকে মুক্তি দিতে হল ভারতকে অসহায়ের মতো। ভারতের পার্লামেন্টে প্রবেশ করে সন্ত্রাসবাদীরা হামলা করে বুঝিয়ে দিল ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা ঠুনকো। একের পর এক লোকাল ট্রেনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় মুম্বইয়ে। সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ হয়। মুম্বইয়ে ১০ টি যুবক করাচি থেকে  লঞ্চ এবং বোটে করে অবাধে প্রবেশ করে গণহত্যা চালাতে পারে। পাঠানকোটের এয়ারফোর্স বেস স্টেশনে জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে তিনদিন ধরে চালায় যুদ্ধ। এই সেদিন পার্লামেন্টে পাউডার স্প্রে নিয়ে কীভাবে ঢুকতে পারল কয়েকটি যুবক যুবতী? এই প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রধান প্রশ্ন ইনটেলিজেন্স কেন ব্যর্থ হল? কেন আগাম জানা এবং প্রতিরোধ করা গেল না? 
অপরাধের অন্যতম প্রধান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা দুটি। সিবিআই এবং এনআইএ। গুপ্তচর সংস্থা একাধিক। আইবি, র (raw), এমআই ইত্যাদি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই উৎকর্ষের শীর্ষে থাকা সংস্থাগুলি ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। বিগত ৪০ বছরে তাদের সাকসেস রেট হতাশজনক। পার্লামেন্ট বদল করলেন। নোট বদল করলেন। যোজনা কমিশন বদল করলেন। কাশ্মীরকে বদল করলেন। সংবিধান বদল করে নির্বাচন ব্যবস্থা বদলে ফেলতে চাইছেন। এবার সময় এসেছে। ভারতের গোয়েন্দা ও গুপ্তচর কাঠামো আমূল বদলে ফেলুন প্রধানমন্ত্রী। ভারত আধুনিক হচ্ছে। সুতরাং সেইমতোই আধুনিক, স্মার্ট এবং তুখোড় পেশাদার হয়ে উঠুক ভারতের স্পাই এবং ডিটেকটিভ কাঠামো!
16h 16m ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

শেয়ার মেয়াদি সঞ্চয়সহ একাধিক ক্ষেত্র থেকে অর্থাগম যোগ। ব্যবসায় কেনাবেচা বাড়বে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৮৩ টাকা৮৪.৫৭ টাকা
পাউন্ড১০৯.৮৬ টাকা১১৩.৪৫ টাকা
ইউরো৯১.৬৭ টাকা৯৪.৮৭ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা