ভারত নামক একটি রাষ্ট্র যার স্বাধীনতার বয়স ৭৭ বছর হয়ে গিয়েছে এবং সভ্যতার বয়স ৫ হাজার বছর। সে এখন কী নিয়ে চর্চা করছে? উত্তরপ্রদেশের সম্ভাল নামক একটি জনপদে জামা মসজিদের নীচে আসলে মন্দির ছিল কি না সেই সমীক্ষা করার উদ্যোগ নিয়েছে, সংঘর্ষ হয়েছে। চারজনের মৃত্যু। ভারতের পার্লামেন্টে এটি এখন অন্যতম ইস্যু।
অসমের রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছে হোটেল, রেস্তরাঁয় তো বটেই, কোনও সামাজিক সমাবেশেও গোমাংস খাওয়া কিংবা পরিবেশন করা চলবে না।
আজমির শরিফ দরগা আসলে মহাদেবের মন্দিরের উপর নির্মিত। এই মর্মে রাজস্থানের আদালতে জমা পড়েছে আবেদন। সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি এই আবেদনের পক্ষে ও বিপক্ষে তর্ক করছে।
ভারত সরকারের অন্যতম চালিকাশক্তি যে সংগঠন, সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রধান আহ্বান করেছেন মহিলাদের অন্তত তিনটি করে সন্তান থাকা উচিত। কারণ হিসেবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ভারতের গড় ফার্টিলিটি হার যেভাবে কমছে, সেটা উদ্বেগজনক এবং ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হারও কমতে শুরু করেছে। তাই এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
ঠিক এই সময়ই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? আমেরিকার যে কোনও সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখলে লক্ষ্য করা যাবে প্রধানতম চর্চা নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইমপোর্ট ট্যারিফ রেট কতটা বাড়াবেন? অন্য দেশ থেকে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করতে হলে ওই চড়া ট্যাক্স দিতে হবে। চীনকে সবথেকে বেশি টার্গেট করেছেন তিনি। কেন? কারণ আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র মাঝারি বা বৃহৎ সব শিল্প সংস্থার উৎপাদন ও বিক্রি যাতে বাড়ে।
ইতালির অন্যতম বৃহৎ ব্যাঙ্ক ইউনিক্রেডিট স্থির করেছে তারা জার্মানির বৃহত্তম আর্থিক সংস্থা কমার্জব্যাঙ্ককে কিনে নেবে। জার্মান সরকার সেটা ঠেকাতে মরিয়া। জার্মানির নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ। কারণ এটা রাষ্ট্রীয় সম্মানের ব্যাপার।
অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে আইন এনেছে যে, ১৬ বছরের কম বয়সিদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। গুগল, মেটা, এক্স ইত্যাদি সংস্থা প্রবল চিন্তিত। কারণ তাদের ব্যবসা প্রবলভাবে ধাক্কা খাবে। ওই বয়সটাই অ্যাসপিরেশনাল বয়স। স্বপ্ন দেখার বয়স। তাই ওই বয়স হাতছাড়া করা চলবে না। এইসব সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থা অস্ট্রেলিয়ান সরকারের কাছে সময় চেয়েছে। বলেছে, আমরা এই বয়সের ব্যাপারটা কীভাবে ম্যানেজ করা যায় সেই টেকনোলজি আনছি, সময় দিন। অস্ট্রেলিয়া রাজি নয়।
আফ্রিকার সুদানের একটি উদ্বাস্তু ক্যাম্প রয়েছে এল ফাশহর নামক জনপদে। সেই উদ্বাস্তু ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া গৃহযুদ্ধে গৃহহীন ৫ লক্ষ মানুষের জন্য এই সপ্তাহ কিছুটা খুশির খবর এনেছে। কারণ এই ৫ লক্ষ মানুষ দীর্ঘ দিন ধরে প্রায় অনাহারে কাটাচ্ছে। যুদ্ধের কারণে রাষ্ট্রসঙ্ঘকে খাবার সাপ্লাই পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি। অবশেষে সেই সাপ্লাই আসছে এই সপ্তাহে। বিগত ছয় মাস ধরে লাগাতার পশ্চিমী দেশগুলি এই নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘে আলোচনা করেছে। চাপ দিয়েছে।
এই যে তথ্যগুলি আলোচিত হল, এখানে কী দেখা যাচ্ছে? দেখা যাচ্ছে, ভারতকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে এখনও পর্যন্ত কতটা অপরিণতমনস্ক এবং নির্বোধ করে রেখে দেওয়া হচ্ছে। ভারত পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ বলে গর্ব করছে। অথচ বাকি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশগুলির অন্যতম চর্চার ইস্যু কী? আর আমরা প্রতিদিন কী নিয়ে আলোচনা করি। আমাদের রাজনীতিকরা কী নিয়ে বাগবিতণ্ডা করেন?
আজও ভারতের বৃহৎ ব্যর্থতা হল এখনও বিশ্বকে কোনও ভোগ্যপণ্যের এক নম্বর ব্র্যান্ড উপহার দিতে পারেনি ভারত তথা ভারতের কর্পোরেট মহল। ভারতের নাগরিক যুবসমাজ জারার জ্যাকেট কিংবা পোশাক পরলে নিজেকে স্মার্ট ও স্টেটাসসংবলিত মনে করে। জারা স্প্যানিশ ব্র্যান্ড। সেই যুবসমাজ আজও লি, লিভাইস জিন্স পরতে পছন্দ করে। আজও সবথেকে বেশি বিক্রি হয় ব্র্যান্ড হিসেবে রিবক, নাইকি, পুমা, অ্যাডিডাস এবং এয়ার জর্ডন। দেখা যায় যে, আমরা যখন যে বয়সে যে কোনও পণ্য কেনার স্বপ্ন পোষণ করি, সেটি অবধারিতভাবে বিদেশি কোনও ব্র্যান্ড।
আজও ১৪০ কোটি দেশের স্বপ্ন পকেটে একটি অ্যাপল ফোন থাকা। ভারত আজও একটি মোবাইল ব্র্যান্ড বিশ্বকে দিতে পারল না। কোনও টেলিভিশন, কোনও প্যাড, কোনও লেদার প্রোডাক্ট, কোনও শীতের পোশাক, কোনও গরমের পোশাক কিছুই নেই। অর্থাৎ আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, বেজিং, স্কটল্যান্ড, মেলবোর্ন, প্যারিস, ব্রাজিলের নাগরিকরা ভারতের কোনও একটি ব্র্যান্ড ব্যবহার করার জন্য উদগ্রীব এবং সেই ব্র্যান্ড বিশ্বকে শাসন করছে, এরকম উদাহরণ নেই।
তাহলে ভারত কীসের জন্য গর্ব করে? ভারত তো ক্রেতার দেশ? ১৪০ কোটির বাজার। ভারতকে সবাই শুধু বিক্রি করে চলেছে নিজেদের প্রোডাক্ট আর ব্র্যান্ড। যে কোনও দেশের তুলনায় বেশি ইংলিশ স্পিকিং। লেবার ফোর্স বেশি। কিন্তু মজুরি কম। অতএব আরও সুবিধা। এদের থেকে কাজ করিয়ে নাও প্রসেস থেকে সফটওয়্যার যে কোনও সংস্থায় অফশোর এমপ্লয়ি হিসেবে। এই দেশের কোম্পানিগুলিকে প্রজেক্ট দিয়ে দাও। এরা নিজেদের সস্তার কর্মীদের দিয়ে উচ্চ মানের কাজ করে দেবে। লাভ করব আমরা অর্থাৎ বহুজাতিক বিখ্যাত সংস্থা। আবার সেইসব কর্মীর কাছেই বিদেশের বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলি নিজেদের প্রোডাক্ট বিক্রি করে সেই কন্ট্রাক্টের জন্য খরচ হওয়া টাকা আবার নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে।
অন্যদিকে এইসব কোম্পানি যে দেশের, সেই দেশের সরকারগুলি এই ভারতকেই বিক্রি করে অস্ত্র, সোলার এনার্জির টেকনোলজি, মহাকাশ গবেষণা প্রক্রিয়া, যুদ্ধ সরঞ্জাম, টেলিকম প্রযুক্তি। সুতরাং, ভারত প্রত্যেকের কাছে সবথেকে বেশি সোনার ডিম দেওয়া হাঁস। লক্ষ করা যায় যে, কেউ ভারতের সঙ্গে কোনও শত্রুতা চায় না। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনে। তেল কেনে। আমেরিকা ক্ষুব্ধ হয়। কিন্তু ভারতকে ধমক দিতে পারে না। সম্পর্ক ছিন্ন করতেও পারবে না। কারণ সরকার ও কর্পোরেট উভয় পক্ষের কাছে ভারত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ক্রেতা।
ভারত কিংবা গোটা দুনিয়া কোনও কোনও কোম্পানি ছাড়া ২৪ ঘণ্টা থাকতে পারবে না। শুধু শখের কারণে নয়, পেশাগতভাবেও এই সংস্থাগুলির উপর ভারত নির্ভরশীল। গুগল, আমাজন, মেটা, এক্স, ইউটিউব, এনভিডিয়া, মাইক্রোসফট। এর একটারও কোনও বিকল্প ভারত তৈরি করতে পারল না কেন? ভারত তো সফটওয়্যার কর্মীদের রাজধানী।
ভারতের বৃহত্তম কর্পোরেট সংস্থাগুলির দৃষ্টিভঙ্গির প্রসারতা দেখা যায় না কেন? বিদেশি সংস্থার মতোই দেশি সংস্থা হয়েও তারা ভারতীয় জনতাকে স্রেফ ক্রেতাই ভাবে। তাই যখন তখন টেলিকমের ট্যারিফ বাড়ায়। সুযোগ খোঁজে জনতার ট্যাক্সের টাকায় সরকার তাদের কর্পোরেট ট্যাক্স কখন মকুব করবে।
জমি আদায় করা রাজ্য সরকারকে শিল্পায়নের টোপ দিয়ে কর্পোরেট কোম্পানির নবতম উদ্যোগ হল সুযোগ পেলেই রিয়াল এস্টেটে ঢুকে পড়া। সস্তায় জমি নিয়ে সেখানে স্যাটেলাইট টাউনশিপ কিংবা হাউজিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করা।
আমেরিকার জিডিপি কত? ২৮ লক্ষ কোটি ডলার। চীনের জিডিপি কত? ১৮ লক্ষ কোটি ডলার। ভারতের জিডিপি কত? সাড়ে ৩ লক্ষ কোটি ডলার। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গালভরা সংলাপ এবং তাঁর শরীরী ভঙ্গি দেখলে বোঝা যায় যে, ভারত এদের থেকে কত পিছিয়ে আছে? তাঁর সরকার ও দলের আচার আচরণ এবং মনোভাব কিংবা চিন্তাভাবনার অগ্রাধিকার লক্ষ করলে একবারও মনে হয় না, আদৌ তাদের মনে একটা গভীর শপথবাক্য আছে যে, এই পর্যায়ে একদিন আমরাও পৌঁছবো? তারা ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন, মসজিদ, মন্দির, গোমাংস, ইডি, সিবিআই এসব নিয়েই বেশ আছেন!
আমেরিকা এবং চীন সবথেকে বেশি জোর দিচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উপর। অভ্যন্তরীণ সেই শিল্পকেই এই দুই দেশ রাষ্ট্রীয় সহায়তা দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রমোট করে। ভারত কী করে? অথচ ভারতের অভ্যন্তরীণ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শক্তি সববৃহৎ।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা, ভারতীয় জনসঙ্ঘ, ভারতীয় জনতা পার্টি। এদের সকলেরই প্রধান একটি স্বপ্ন এবং লক্ষ্য হল ভারত ও হিন্দুত্বের প্রাচীন ও অতীত গৌরবজনক অধ্যায়কে আবার ফিরিয়ে আনা। খুবই ভালো পরিকল্পনা। তবে শুধুই ধর্মীয় কেন? ভারতীয় বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ ফেরাতে সচেষ্ট হচ্ছেন না কেন? নিশ্চয়ই মনে আছে,
প্রাচীন পৃথিবীতে কোন দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল সর্বোত্তম ও সর্ববৃহৎ? রোম এবং ভারত। এই দুই রাষ্ট্র ছিল বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। ট্রেডিং পার্টনার। এমনকী সিল্ক, যা নাকি চীনের সর্বশ্রেষ্ঠ রপ্তানিপণ্য ছিল ইওরোপে, সেটাও ভারতে আগে পাঠানো হতো নৌকায়। গোলমরিচ, মশলা, হাতির দাঁত, বস্ত্র রপ্তানি করত ভারত। কতটা মূল্যবান ছিল ভারতের পণ্য? ভিসগোথ রাজা আলারিক যখন রোম দখল করে মুক্তিপণ চেয়েছিলেন ৪০৮ খ্রিস্টাব্দে, সেইসময় সেই মুক্তিপণের প্রধান দাবি ছিল দুটি, ৫ হাজার কেজি সোনা এবং ৩ হাজার কেজি ভারতীয় গোলমরিচ। সিন্ধু সভ্যতার আমল থেকেই ভারত উৎপাদন ও বাণিজ্যে উৎকর্ষ লাভ করতে শুরু করে। ২০২০ সালের বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেছিলেন, সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার উচ্চতা স্পর্শ করা আমাদের লক্ষ্য।
আর আজ ভারতের রপ্তানি তলানিতে পৌঁছেছে। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ঘাটতি চরম আকার নিয়েছে। কারণ কী? কারণ দেশীয় উৎপাদনকে সবরকমভাবে সাহায্য করাকে সরকার মিশন হিসেবে নেয়নি। কোথায় কারা সর্বোৎকৃষ্ট কারিগর সেটা দেখা হয় না। দেখা হয়, কোথায় কোন দল ক্ষমতায় এবং কারা আমাদের ভোটার। আর তাই যে ভারত ছিল অতীত গৌরবকালে বিক্রেতা, আজ তারা নিছক ক্রেতা। রপ্তানির দেশ আজ আমদানির দেশ। দাতার দেশ আজ গ্রহীতার দেশ। আধুনিক চিন্তা, শিল্প, বাণিজ্য, গৌরব, সবদিকেই ভারতকে পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন?