আজ ৭ ডিসেম্বর। ‘বর্তমান’-এর জন্মদিন। আজ গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজোর দিন। প্রয়াত সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্তর হাত ধরে যে ‘বর্তমান’ পথচলা শুরু করেছিল, তার বয়স চল্লিশ পূর্ণ হল। এখনও আমরা শুধু ঘটনার কথাই বলি না, খবরের ভিতরের খবরকেও মানুষের সামনে নিয়ে আসি। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কৃত্রিম ঝড়ে দিগভ্রান্ত না হয়ে সঠিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও আমরা আগের মতোই নির্ভুল। একের পর এক নির্বাচনে মিলেছে তার প্রমাণ। হাজারো বাধাবিপত্তির মধ্যেও সত্যের প্রতি অবিচল থাকার শিক্ষাটা বরুণবাবুরই। তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ মেনে আমরা সাধারণ মানুষের কথা বলি। অত্যাচারীর চোখে চোখ রেখে সত্যিটা বলার সাহস রাখি। তারজন্য অনেকে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের তুবড়ি ছোটায়, কিন্তু তাতে সত্যিটা বদলে যায় না। তাই আজও আমাদের স্লোগান, ‘বর্তমান ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায় না।’
প্রতিবাদ যাঁর রক্তে তাঁকে ভয় দেখিয়ে চুপ করাতে যাওয়াটা চরম মূর্খামি। অথচ ক্ষমতার দম্ভে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সেটাই করেছিলেন। জরুরি অবস্থা জারির সুযোগ নিয়ে বরুণবাবুকে জেলে ভরেছিলেন। উদ্দেশ্য, তাঁর প্রতিবাদী কলমকে স্তব্ধ করা। সেটা করতে গিয়ে সিদ্ধার্থবাবু নিজের সরকারেরই পতন ডেকে এনেছিলেন। এই কথাটা তাঁরই সরকারের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। তিনি বলেছিলেন, ‘বরুণদার জ্বালাময়ী লেখা পড়েই বাংলার মানুষ কংগ্রেসকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। যার পরিণাম ‘৭৭ সালের পালাবদল।’ সিপিএমের মন্ত্রী প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তীর কথায়, ‘সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় সম্পর্কে বরুণবাবুর লেখা পড়ে মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে বাংলার মানুষের তীব্র ঘৃণা তৈরি হয়েছিল। ’৭৭ সালের রাজনৈতিক পালাবদলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর লেখার।’
রাজনৈতিক নেতৃত্ব যাই বলুক না কেন, বরুণবাবু তা বিশ্বাস করতেন না। একটা কথা অনেকেই বলতেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নেত্রী বানিয়েছেন বরুণবাবু। কিন্তু তিনি মনে করতেন, কোনও সংবাদপত্র কাউকে নেতা বা নেত্রী বানাতে পারে না। সংবাদপত্রের কাজ সাধারণ মানুষের কথা বলা। সাধারণ মানুষের হয়ে যাঁরা লড়াই করেন, তাঁদের কথা বলে বর্তমান। ১৯৮৪ সালের ৭ ডিসেম্বরের ‘বর্তমান’-এর প্রথম সংখ্যাতেই তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন তাঁর উদ্দেশ্য। লিখেছিলেন, ‘এখন আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান সাধারণ মানুষের স্বার্থে, সাধারণ মানুষের হয়ে কথা বলার মতো একখানা কাগজ বের করা।’ এখনও আমরা তাঁর সেই নীতি ও আদর্শ মেনেই চলি। সেইজন্যই আমরা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্পের কথা লিখি। সোচ্চার হই ১০০দিনের কাজ বন্ধের বিরুদ্ধে। গরিব, খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের স্বার্থে কথা বলতে বরুণবাবুই আমাদের শিখিয়েছেন।
হাতেগরম উদাহরণ আর জি কর। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম যখন আর জি কর ইস্যুতে খবর তৈরি করেছে ‘বর্তমান’ তখন অবিচল ছিল বিভ্রান্তি নিরসনে। বাংলার চিকিৎসক-কন্যার মর্মান্তিক খুনে দোষীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেমন দাবি করেছে, তেমনই সাধারণ গরিব মানুষের দুর্ভোগের কথা প্রতিদিন তুলে ধরেছে। তাতে আন্দোলনকারীরা রুষ্ট হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু সাধারণ মানুষ ‘খবর তৈরি’ ও ‘প্রকৃত খবরে’র ফারাকটা বুঝতে পেরেছেন।
বরুণবাবু আমাদের মাটিতে পা রেখে চলতে শিখিয়েছেন। সেই শিক্ষার জোরেই বাংলার মানুষের মন পড়তে পারে ‘বর্তমান’। তাই প্রতিটি নির্বাচনে দিতে পেরেছে প্রায় নিখুঁত পূর্বাভাস। ২০১৬ সালে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেই সিপিএম মনে করেছিল, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতায় ফেরা আটকে দিয়েছে তারা। জোট সরকারের মন্ত্রিসভার খসড়াও নাকি তৈরি হয়ে গিয়েছিল! কিন্তু আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে জানিয়ে দিয়েছিলাম, দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরছেন মমতা। একুশের নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি অনুমান করা ছিল একটু কঠিনই। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দৌলতে বাংলার আকাশে তখন মেকি গেরুয়া ঝড়। তাকে ভেদ করে নিশানা নির্দিষ্ট করা ছিল সত্যিই কঠিন। কিন্তু মাটিতে পা রেখে চলে বলেই ‘বর্তমান’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের হ্যাটট্রিকের নিশ্চিত পূর্বাভাস দিতে পেরেছিল। চব্বিশেও অধিকাংশ মিডিয়া বাংলায় বিজেপিকে ২২ থেকে ৩০টি পর্যন্ত আসন দিয়ে বসেছিল। কিন্তু বর্তমান বলেছিল, বিজেপির আসন অনেকটাই কমবে। আর তা অক্ষরে অক্ষরে মিলেছেও।
বাংলায় সিপিএমের ভরা যৌবনে শুরু হয়েছিল ‘বর্তমান’এর পথচলা। তখন রাজ্যে বিরোধী বলে কিছুই ছিল না। কিন্তু বরুণবাবু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, সরকার ভুল করলে তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পিছপা হবেন না। সেটা করায় সিপিএমের লোকজন গ্রামে ‘বর্তমান’ ঢোকা বন্ধের জন্য হুলিয়া জারি করেছিল। কিন্তু মানুষকে আটকাতে পারেনি। বাজারের থলির নীচে ‘বর্তমান’ নিয়ে মানুষ বাড়ি ফিরেছে। হার্মাদ বাহিনীর আতঙ্কে দরজা বন্ধ করে বর্তমান পড়েছে। তাতে বর্তমানকে শায়েস্তা করার সব চেষ্টা জলে গিয়েছে। উল্টে বাংলা থেকে সিপিএম দলটাই উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
বরুণবাবু ছিলেন আমাদের ক্যাপ্টেন। কিন্তু কাপ্তেনিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। সাধারণ মানুষের কাছে হাত পেতে তৈরি করেছিলেন বর্তমান। তাই প্রতিটি টাকার মূল্য বুঝতেন তিনি। অপচয়ে ছিল তাঁর ঘোর আপত্তি। কর্মজীবনের গোড়ায় জোড়াগির্জার বর্তমান অফিসের রেস্টরুমে থাকার সুবাদে বরুণবাবুকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। কাকভোরে অফিসে চলে আসতেন। ব্রেকফাস্ট করতেন অফিসেই। মেনুতে থাকত হলুদবিহীন আলু গোলমরিচ ভাজা, দু’টো রুটি, আর কয়েক টুকরো পাকা পেঁপে। অত্যন্ত সাদামাটা জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন। সকলের আগে অফিসে ঢুকতেন, আর বেরতেন একেবারে শেষে। যাওয়ার সময় করিডোরের আলোগুলো নেভাতে নেভাতে বেরিয়ে যেতেন। তাঁর উত্তরসূরিরাও ঘর থেকে বেরনোর সময় এখনও আলো, পাখা বন্ধ করেই বের হন।
বর্তমান কাগজের মালিক ছিলেন বরুণবাবু। কিন্তু তাঁর কথাবার্তায়, ব্যবহারে কখনও মালিক সুলভ আচরণ ফুটে ওঠেনি। বর্তমানের সকলেই ছিলেন তাঁর সহকর্মী। সাংবাদিকরা তাঁকে ‘বরুণদা’ বলে ডাকতেন। কিন্তু তিনি আমার কাছে ছিলেন ‘স্যার’। সাংবাদিকতার অআকখ যেটুকু শিখেছি, সবটাই তাঁর কাছে। তিনি প্রায়ই বলতেন, আমরা নীতির সমালোচনা করি, ব্যক্তির নয়। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ঠিক রাখার শিক্ষা দিতেন। তিনি সেটা নিজেও মানতেন। বর্তমানের জন্মলগ্ন থেকে তাঁর চলে যাওয়া পর্যন্ত এমন একটাও দিন পাওয়া মুশকিল, যেদিন বর্তমান কাগজে সিপিএমের সমালোচনা হয়নি। তবুও সিপিএমের অনেক দাপুটে নেতার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল দাদা-ভাইয়ের। সেই কারণেই সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুতে বরুণবাবু শিশুর মতো হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন।
অসম্ভব আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল বরুণবাবুর। তার জোরে অনায়াসেই ক্ষমতার অলিন্দে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। কিন্তু রাজনৈতিক খবরদারিতে ছিল তাঁর প্রবল অনীহা। দিল্লিতে সাংবাদিকতা না করলেও তিনি ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী এবং সঞ্জয় গান্ধীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। স্বামীর বন্ধু হিসেবে মানেকা গান্ধীও তাঁকে ভালোই চিনতেন। সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর পর বরুণবাবু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ততদিনে রাজীব গান্ধীকে রাজনীতিতে আনবেন বলে ইন্দিরাজি মনস্থ করে ফেলেছেন। এদিকে মানেকা গান্ধী চাইছিলেন, তাঁকেই দেওয়া হোক গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। কিন্তু ইন্দিরাজি নারাজ। শাশুড়িকে বোঝানোর জন্য বরুণবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন মানেকা গান্ধী। বরুণবাবু তাঁকে হাতজোড় করে বলেছিলেন, মিসেস গান্ধী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ওঁকে বলে কোনও লাভ নেই। আর এটা আমার উচিতও হবে না। বরুণবাবু এই ঘটনার কথা শুনিয়ে বলেছিলেন, সাংবাদিক রাজনীতির হাঁড়ির খবর নেবে, লিখবেও। কিন্তু রাজনীতিতে প্রভাব খাটানো সাংবাদিকের কাজ নয়। সেটা করতে গেলেই চিড় ধরবে সম্পর্কে।
একটা কথা আগে প্রায়ই শুনতে হতো, বরুণবাবুর পর বর্তমানের কী হবে? এই প্রশ্নটা হয়তো তাঁকেও ভাবাত। তাই তিনি ঘনিষ্ঠজনদের বলতেন, বর্তমানকে পরিচিত হতে হবে ‘বর্তমান’ নামে। বরুণ সেনগুপ্তের কাগজ বলে পরিচিত হলে চলবে না।
বরুণবাবু আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ১৬টা বছর কেটে গিয়েছে। তাঁর বসানো ‘বর্তমান’ নামক বটবৃক্ষের চারাটা মহীরুহ হতে পেরেছে কি না, সেটা পাঠকই বিচার করবেন। তবে ‘বর্তমান’ তার শাখাপ্রশাখা বিস্তার করে চলেছে। একদিন যাঁরা বরুণবাবুর পর বর্তমানের কী হবে, প্রশ্ন তুলে কাঁপুনি ধরাতে চেয়েছিলেন এতদিনে তাঁরা জবাবটা নিশ্চয়ই পেয়ে গিয়েছেন। বরুণবাবু চলে গিয়েছেন, কিন্তু তাঁর শিক্ষা ছড়িয়ে রয়েছে বর্তমানের শিরায়-উপশিরায়, প্রতিটি কোণায়। হ্যাঁ, আমরা বরুণ সেনগুপ্তের কাগজে কাজ করি। এটাই আমাদের অহঙ্কার।