বিশেষ নিবন্ধ

মোদিবিহীন জয়! স্ট্র্যাটেজি বদলাচ্ছে সঙ্ঘ
শান্তনু দত্তগুপ্ত

‘রাজীব গান্ধী যখন প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, রাজনীতির কোন অভিজ্ঞতাটা তাঁর ছিল? আমার ছেলে বা ভাইপো যদি রাজনীতিতে আসে, আমি আটকানোর কে? আর আটকাবই বা কেন? কিন্তু এখানে আমার একটাই শর্ত থাকবে—আমার সেনাপতিদের অসম্মান তারা করতে পারবে না।’ সালটা ১৯৯৫। বক্তা বালাসাহেব থ্যাকারে। ছেলে উদ্ধব এবং ভাইপো রাজ থ্যাকারেকে উদ্দেশ করেই যে তিনি এই কথা বলেছিলেন, তাতে কোনও সংশয় নেই। কিন্তু এই মন্তব্যের মধ্যে নজর করার মতো একটা অংশ আছে—সেনাপতি। শিবসেনা যে শুধু রাজার দল নয়, সেনাপতিরাও তাতে সমান গুরুত্ব পেয়ে থাকেন, সেটা বালাসাহেব স্পষ্ট করেছিলেন। কেমন সেই সেনাপতি? নামটা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে একনাথ সিন্ধে হতেই পারে। গরিব ঘর থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ মানুষ। পরিবারের সঙ্কটে পড়াশোনা ছেড়ে অটোরিকশ চালানো শুরু করেছিলেন। এমন একটা প্রেক্ষাপটে প্রবেশ তাঁর রাজনীতিতে। আর এখন? ‘আসল শিবসেনা’ তাঁরই। উদ্ধব থ্যাকারের নয়। কেন এমন হল? কীভাবে? গত লোকসভা ভোটেও তো সমীকরণ তাঁর পক্ষে ছিল না! এমনকী বিজেপিরও নয়। ৪৮টা আসনের মধ্যে মাত্র ১৭টা দখল করতে পেরেছিল এনডিএ। আর বিপুল সম্ভাবনা জাগিয়ে ৩০টি কেন্দ্রে জয় পেয়েছিল ইন্ডিয়া। রাজনীতির কারবারিরা ভেবেছিলেন, বালাসাহেব আবেগ ছেলে উদ্ধবের পক্ষে গিয়েছে। বিজেপির ‘অপারেশন লোটাস’ রাজনীতিকে ছুড়ে ফেলেছে মানুষ। তাহলে বিধানসভা ভোটে উল্টো ফল কেন? এই কয়েক মাসে কী ফারাক হয়েছে মহারাষ্ট্রে? তলিয়ে দেখলে একটিমাত্র পার্থক্য চোখে পড়বে—নরেন্দ্র মোদি। গত লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদি ছিলেন নির্বাচনী মুখ। বিজেপি বা এনডিএ জিতলে প্রধানমন্ত্রী হবেন তিনিই, এটা জানার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার দরকার ছিল না। আর বিধানসভা নির্বাচনে? নরেন্দ্র মোদিকে সুকৌশলে সরিয়ে রেখেছিল সঙ্ঘ পরিবার। সামনে ছিলেন কারা? দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, নীতিন গাদকারি, একনাথ সিন্ধে। আর ইস্যু? সম্পূর্ণ স্থানীয়। উগ্র হিন্দুত্ব ছিল, কিন্তু স্থানীয় মানুষের উন্নয়নের স্বার্থে প্রচারকে পিছনে ঠেলে দিয়ে নয়। ফল হাতেনাতে পেয়েছে বিজেপি। মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’ ধোপে টিকতে পারেনি। সংখ্যাতত্ত্ব তাদের এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যে, মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিরোধী দলনেতার আসনে বসার মতো নম্বর কোনও দলের কাছে নেই। কংগ্রেস তো নয়ই, উদ্ধবের শিবিসেনা বা শারদ পাওয়ারের এনসিপিও এই অঙ্কে ফেল করেছে। আর সেইসঙ্গে মোদিবিহীন বিজেপির খড়কুটোর আগুনে হাওয়া লেগেছে জোরদার। নীতিন গাদকারি এমনিতেই মোদি বিরোধী শিবিরের বলে বাজারে তাঁর বদনাম আছে। তিনি প্রচার করলে মোদিপন্থীরা যে খুব উল্লসিত হয়ে থাকেন, এমনটা নয়। কিন্তু তাঁর প্রচারে যদি ফল ইতিবাচক হয়, তাহলে একটা বিষয়ই স্পষ্ট—মোদিপন্থী বলে প্রজাতিটি অবলুপ্ত হতে চলেছে। আরএসএস যে এই সারসত্যটা সবার আগে বুঝেছে, সেটাই বিজেপির সৌভাগ্য। ঠিক যে যে রাজ্যে মোদি ফর্মুলায় গেরুয়া শিবির অঙ্ক কষেছে, সেখানেই কিন্তু ভরাডুবি। এটা ঝাড়খণ্ড এবং সাম্প্রতিক উপ নির্বাচনগুলির ফলেও স্পষ্ট। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির সাফল্যের নেপথ্যে যোগী আদিত্যনাথের আগ্রাসন ছিল। কিন্তু হিমন্ত বিশ্বশর্মার হিন্দুত্ববাদী প্রচার ঝাড়খণ্ডে কাজে আসেনি। বরং বিজেপির বিরুদ্ধে গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে জেলে পাঠানোর ঔদ্ধত্য। বিরসা মুন্ডার রাজ্যের মানুষ বলেছে, মোদি জেলে পাঠিয়েছেন তাদের ভূমিপুত্রকে। আর তাই মোদির দল বা সৈনিক যে সেখানে হালে পানি পাবে না, সেটাও স্পষ্ট ছিল ভোটের হাওয়ায়। বিজেপি একটা রব তুলে ভোটের অভিমুখ ঘোরানোর চেষ্টা করেছিল ঠিকই, কিন্তু তা খুব একটা কাজে দেয়নি। এমনকী আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক দখলের চেষ্টাও বিফলে গিয়েছে। অথচ নরেন্দ্র মোদি নিজে এই রাজ্যের আদিবাসীদের উন্নয়নে কেন্দ্রীয় প্রকল্প তদারক করেছিলেন। পাঁচ বছরের প্রজেক্ট নিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালে হারার পর। এক্ষেত্রেও তাহলে কী ধরে নেওয়া যেতে পারে? হারের ফ্যাক্টর নরেন্দ্র মোদি? 
হাওয়া বদলাচ্ছে। একের পর এক ভোট তার প্রমাণ। ২০২১ সালে বাংলা থেকে মোদি নামক সূর্যের অস্তাচলে যাওয়ার যে সূচনা হয়েছিল, তা এখন পূর্ণ মাত্রায় গোধূলির পথে। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী তিনি হয়েছেন। কিন্তু তাতে গরিমা নেই। বরং জোটের কাছে আত্মসমর্পণ রয়েছে। তিনি নিজেও সেটা জানেন। আর জানে সঙ্ঘ। তাই মোহন ভাগবত আবার অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন। প্রতিটা পদক্ষেপ বুঝে ফেলাটাই এখন তাঁর লক্ষ্য। তাই মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি পদ থেকে সরে যাননি জে পি নাড্ডা। সরানো হয়নি রাজ্য সভাপতিদেরও। প্রকাশ্যে একের পর এক ভোটের কথা বলা হলেও, অপেক্ষা চলছে সঠিক মুখের। আরএসএস জানে, এই কয়েকটি ভোট থেকেই আসল চিত্রটা সামনে আসবে। তারপর ঠিক হবে, বিজেপির সংগঠনের ব্যাটন যাবে কার হাতে। সংগঠন নিয়ে এখন যে মোদিজিকে খুব একটা মাথা গলাতে দেওয়া হচ্ছে না, এই খবর বিজেপির অন্দরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তা না হলে এমন গুরুত্বপূর্ণ ভোটের সময় তিনি বিদেশ সফরে চলে যেতেন না। বিজেপি সম্পূর্ণভাবে ক্যাডার নির্ভর পার্টি। প্রশাসনের থেকে অনেক বেশি গুরুত্ব তাদের কাছে রাজনীতির। তাহলে মরণ-বাঁচন লড়াইয়ে দলের মুখ নিজেই কীভাবে বিদেশি হাওয়া খেতে যেতে পারেন? হাওয়া বদল কি এখনও বোঝা যাচ্ছে না? প্রশাসন তিনি চালান, অসুবিধা নেই। কারণ, তাঁর একাগ্রতা এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন সঙ্ঘের অন্দরেও নেই। ৫৫ ঘণ্টার বিদেশ সফরে গিয়ে ৪০টা বৈঠক করতে পারেন মোদিজি। এই অমানুষিক ক্ষমতা খুব বেশি রাজনীতিকের নেই। কিন্তু সংগঠন? এখানে সব স্ট্র্যাটেজিই সঙ্ঘের। আগ্রাসনই এই সমীকরণের শেষ কথা। কোথাও সফল হবে। কোথাও হবে না। ঠিক যেমন ‘কাটেঙ্গে ইয়া বাঁটেঙ্গে’ উত্তরপ্রদেশে সুফল এনেছে, ঝাড়খণ্ডে আনেনি। তাতে সঙ্ঘের কিছু আসে  যায় না। তারা জানে, শতবর্ষে পৌঁছে এজেন্ডার পূরণের আগে কিছু নেই। হিন্দুরাষ্ট্র, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, এক দেশ এক ভোট। তিনটি প্রায় অবাস্তব ভাবনাকেই তারা বাস্তব রূপ দিতে উঠেপড়ে লেগেছে। তার জন্য যদি প্রয়োজন হয়, সরকার এবং সংগঠনকে স্রেফ আলাদা করে দেওয়া হবে। এতে লাভ দু’টি। ১) নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা ধাক্কা খেয়ে থাকলেও খুব একটা প্রভাব ভোটে পড়বে না। কারণ, তাঁকে মুখ হিসেবে খাড়া করে এগলেই সেই সম্ভাবনা প্রবল। কিন্তু তিনি যদি ভোট প্রচারের আলোতেই না থাকেন? মানুষ স্থানীয় নেতা এবং স্থানীয় ইস্যুর উপর ভিত্তি করে ভোট দেবে। মহারাষ্ট্রেও কিন্তু এবার বিজেপি কার্যত আঞ্চলিক পার্টির মতোই লড়েছে। জাতীয় ইস্যু বা নেতাদের সামনে আনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু খুব বুঝেশুনে। জোটের মুখ হিসেবে থেকে গিয়েছেন একনাথ সিন্ধে ও দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। জয়ের পর কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, সেটা দেখে নেওয়া যাবে। আগে তো জয়! ২) বিরোধীদের বেসামাল হবে। কেন? কংগ্রেসের মতো জাতীয় স্তরের বিরোধী দলগুলির যাবতীয় আক্রমণ এবং প্রচারই নরেন্দ্র মোদিকে ঘিরে। গত ১০ বছরে তিনি আধিপত্যের যে মিথ তৈরি করেছেন, তাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে কংগ্রেসের প্রচার। লোকসভা ভোট ছিল মোদির। তাই সেখানে কংগ্রেস দাঁত ফোটাতে পেরেছে। রাহুল গান্ধীরা ভেবেছেন, বিজেপির জমানা শেষ। মানুষ আবার কংগ্রেসকেই ভরসা করতে শুরু করেছে। বাস্তবে কি তাই? মহারাষ্ট্র বা ঝাড়খণ্ড কিন্তু সে কথা বলল না। এই ভোটপর্ব দেখাল, মানুষ আঞ্চলিক শক্তির উপরই বেশি ভরসা করছে। কংগ্রেসের উপর নয়। আরএসএস সেটা বুঝতে শুরু করেছে। কিন্তু কংগ্রেস নয়। বিধানসভা ভোটে যে গেরুয়া বাহিনীর স্ট্র্যাটেজি বদলে গিয়েছে, সেটা কংগ্রেস বুঝতেই পারেনি। কারণ, ওভার কনফিডেন্স। লোকসভার ফল তাদের মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাই কংগ্রেসের আক্রমণ সবটাই ছিল মোদিজির বিরুদ্ধে। কিন্তু আসরে না থাকা একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কথা এবং প্রচারের টাকা খরচ পুরোটাই জলে গিয়েছে। এই ভোটের ফল আরও একবার দেখিয়ে দিয়েছে, সোনিয়া গান্ধী জমানার পরবর্তী কংগ্রেস সাবালক হওয়া তো দূর, এখনও হামাগুড়ি দেওয়ার পর্যায়েই রয়েছে। পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দিতে হয়, অবস্থা বুঝে কীভাবে প্ল্যান বি ব্যবহার করতে হয়, সেটাই শেখেনি তারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আমরা আগ্রাসী নেত্রী হিসেবে জানি। আর জি কর আন্দোলন কিন্তু একেবারে অচেনা মমতা হয়েই সামলেছেন তিনি। পাশে দাঁড়িয়েছেন আন্দোলনকারীদের। তাঁদের ন্যায্য দাবিকে সমর্থন জুগিয়েছেন। এটাই শাসকের এবং রাজনৈতিক দলের বিকল্প রণনীতি। আন্দোলনের নামে যারা রাজনীতির চাষ শুরু করেছিল, তারা উধাও হয়ে গিয়েছে। কংগ্রেস কিন্তু আটকে আছে সেই মোদি বিরোধিতায়। হাওয়া যে বদলাচ্ছে, সেটা তারা বুঝছে না। বা বোঝার মতো রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের নেই। 
ঝাড়খণ্ডের ফলাফলের ময়নাতদন্তের পর বিজেপির এক শীর্ষ নেতা বলছিলেন, ‘এখানে হারতে হয়েছে দুর্বল ইলেকশন ম্যানেজমেন্টের জন্য। এমন সব লোককে টিকিট দেওয়া হয়েছে, তারা একেবারেই জনপ্রিয় নয়। শুধু পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। ফল তো এমন হবেই!’ কার দিকে ইঙ্গিত করেছেন তিনি? নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠরা নয় তো? হরিয়ানা ভোটের কথাও কিন্তু তিনি বলছিলেন। সেখানে প্রচারে মোদিজিকে খুব একটা দেখাই যায়নি। স্থানীয় ইস্যু সামনে রেখেই অপ্রত্যাশিত জয় পেয়েছিল বিজেপি। মহারাষ্ট্রের ফলের পর একটা বিষয় নিশ্চিত, ধীরে ধীরে এই ফর্মুলাতেই শিফ্ট করে যাবে তারা। আর কর্তৃত্বের দখল পুরোটাই তুলে নেবে সঙ্ঘ। সংগঠনের রাশ তো বটেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যতদিন আছেন... থাকুন। মেয়াদ না হোক, অবসর পর্যন্ত। 
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্ম, বিদ্যা ক্ষেত্রে উন্নতির যোগ। আয় ব্যয় ক্ষেত্রে সমতার অভাব। স্বাস্থ্য ভালো থাকলেও আঘাতযোগ থাকায়...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.৫৩ টাকা৮৫.২৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.৪৮ টাকা১০৮.২০ টাকা
ইউরো৮৬.৮২ টাকা৯০.১৭ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা