‘কোনো সাম্রাজ্যই তো আজ পর্যন্ত টেঁকেনি... যে সাম্রাজ্য যতই বড় হ’ক। কিন্তু একবারের মতো যে সত্যকার রাজা হতে পেরেছে চিরকালের মতো সে বেঁচে রইল।’ —ঋণশোধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাম্রাজ্য সত্যিই এক ভয়ানক বস্তু। এতটুকু আঁচ পেলেই ক্ষমতাকে তাড়া করা শুরু হয়ে যায়। প্রথমে সাম্রাজ্য গঠন। তারপর তা ধরে রাখা। এই কাজটা আরও বেশি কঠিন। রাজার জনপ্রিয়তা লুকিয়ে থাকে বিশ্বাসে। মানুষের বিশ্বাস। প্রজা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারলেই রাজার জনপ্রিয়তা বাড়ে। দুটো মিটারই একসঙ্গে উঠবে। আর নামবেও একসঙ্গে। চব্বিশের মহারণের পর এই সারসত্যটা বোধহয় আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুঝেছেন। ভোটের ফল থেকেই তার আভাস মিলেছে। সেই ফর্মুলা কিন্তু ধরা পড়েছে সঙ্ঘের নজরেও। তাই সংগঠন এবং দলীয় প্রচারে ধীরে ধীরে বোঝা কমানো হচ্ছে মোদিজির। নিঃশব্দে। ভোটের মুখে প্রচারসভার সংখ্যা বিপুলভাবে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে, বিরোধীদের আক্রমণে বারবার তাঁর মুখ সামনে আসছে না, রণনীতি তৈরিতেও তিনি আর প্রকাশ্যে নেই। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচন মাত্রই মোদি—এই মিথ সুচারুভাবে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। এর সাম্প্রতিকতম প্রমাণ ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের ভোট। দুটো রাজ্যেই লক্ষ করার মতো বিষয় কী? সরকারে আসার লড়াইয়ে বিজেপি নেমেছে। মোদি নন। কোনও রাজ্যেই আর তিনি মুখ নন। অর্থাৎ, এতদিন বিজেপির হার-জিতের কৃতিত্ব বা ব্যর্থতার দায় যেভাবে নরেন্দ্র মোদির কাঁধে চাপত, তেমনটা আর হচ্ছে না। মহারাষ্ট্রে জিতলে যেমন ক্রেডিট নেবেন নীতিন গাদকারি এবং দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। আর ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী বিকাশ প্রকল্প। কেন্দ্রীয় হতে পারে, কিন্তু পাঁচ বছর আগে থেকে শুধুমাত্র আদিবাসী ভোটব্যাঙ্ক দখলের লক্ষ্যে এই সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প দিয়েই ঘুঁটি সাজিয়েছিল গেরুয়া শিবির। প্রথমে ছিল মোদির প্রকল্প। এখন বিজেপির। তখনের সঙ্গে এখনের দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক। এবং এই ফারাকটা তৈরি করা হচ্ছে। বিজেপির চালিকাশক্তিরাই করছে। সেইসঙ্গে হাওয়ায় বাতাসে ঘুরতে শুরু করছে মোক্ষম একটা প্রশ্ন—নরেন্দ্র মোদির অবসর কি আসন্ন?
নিয়মটা অলিখিত। কিন্তু অজ্ঞাত নয়। বরং বারবার প্রচারিত। বিজেপিতে গত ১০ বছর নাকি একটা হাওয়া ছিল... মোদিজি বললে, সেটাই নিয়ম। ঠিক যে নিয়মে লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলী মনোহর যোশিদের মতো প্রথম সারির নেতাদের গ্যালারিতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। বছরে একবার মোদিজি বাড়িতে গিয়ে ফুল দিয়ে আসবেন। পোজ দেবেন। ছবিও উঠবে। সবাই দেখবে, এখনকার নেতৃত্ব বর্ষীয়ানদের কতটা সম্মান করে। কিন্তু লক্ষ্মণরেখাটা হল, দল ও সংগঠনে আপনারা আমন্ত্রিত। স্বাগত নন। সিলিংটা যে মোদিজি নিজেই ঠিক করেছিলেন—৭৫ বছর। আনন্দীবেন প্যাটেলকেও ৭৫ ছোঁয়া মাত্র মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়েছিল। তাহলে মনে হতেই পারে, এবার কি নরেন্দ্র মোদি? আপ সুপ্রিমো তো এই একটি ইস্যু নিয়েই প্রধানমন্ত্রীর পিছনে পড়ে আছেন। লোকসভা ভোটের প্রচারেও অরবিন্দ কেজরিওয়ালের লাগাতার দাবি ছিল, ‘আপনারা কার জন্য ভোট দিচ্ছেন? নরেন্দ্র মোদি? নাকি অমিত শাহ? মোদি তো আসলে অমিত শাহের জন্য ভোট চাইছেন। ১৭ সেপ্টেম্বর উনি রিটায়ার করে যাবেন। তারপর দেখবেন, হয় যোগী আদিত্যনাথ বা অমিত শাহ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন। আপনাদের কী মনে হয়, অমিত শাহ তখন মোদির গ্যারান্টি পূরণ করবেন?’ খুব ভুল জায়গায় কিন্তু তিনি আঘাত করেননি। কারণ, দেশজুড়ে মোদিজির যা বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, অমিত শাহের তা নেই। তিনি দলে চাণক্য হতে পারেন, মানুষের কাছে রবিনহুড নন। বিরোধীদের প্রচার ও মানুষের সংশয় যত বেড়েছে, ততই পাল্লা দিয়েছে বিজেপির ড্যামেজ কন্ট্রোল। যে অমিত শাহ ২০১৯ সালে প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘৭৫ বছরের বেশি কেউ টিকিট পাবে না। এটা পার্টির সিদ্ধান্ত।’ তিনিই আজ বলছেন, ‘বিজেপির সংবিধানে এমন কিছু লেখা নেই। ২০২৯ সাল পর্যন্ত মোদিজিই আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। আগামী যত নির্বাচন হবে, সেই সবক’টিতে।’ সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হল, নেতৃত্ব তো সামনে থেকে দেয়। গত ১০ বছরে মোদিজি তেমনটাই করে এসেছেন। এখন তাহলে তার অন্যথা হচ্ছে কেন? মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড বা অন্যান্য রাজ্যের উপ নির্বাচনগুলিতে কেন তাঁকে সামনের সারিতে পাওয়া যাচ্ছে না? কেন তিনি এই সময় বিদেশ সফরে গিয়ে সেইসব দেশের সম্মান নিতে ব্যস্ত? মহারাষ্ট্র জয় কি তাঁর দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়?
বরং উল্টোটা। মহারাষ্ট্র না জিততে পারলে বিজেপির আধিপত্যে আরও এক মুঠো চোনা পড়বে। সেটা মোদি-শাহও বিলক্ষণ জানেন। ভোটের সম্পূর্ণ বোঝা যদি মোদিজিকে বইতে হয়, তার ব্যর্থতার দায়ও শুধু তাঁকেই নিতে হবে। এমনিতে বাংলা এবং দক্ষিণ ভারতে বিজেপির একের পর এক ভরাডুবি নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের ধার নিয়ে দলের অন্দরেই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তার উপর মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্য হারাতে হলে সেই কালো দাগ প্রধানমন্ত্রীর লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজের জন্য খুব একটা সুবিধের হবে না। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটা অংশ তা একেবারেই চাইছে না। তারা জানে, মোদিজিকে যদি সঙ্ঘ সত্যিই ‘অবসর’ নিতে বাধ্য করে, তাহলে তাদের হালও ধীরে ধীরে লালকৃষ্ণ আদবানি বা যশোবন্ত সিনহাদের মতোই হবে। শুধুমাত্র মোদিজির সৌজন্যে যে ক্ষমতার অলিন্দে তারা অবাধ বিচরণ করে থাকে, সেখানে দফায় দফায় বসবে ব্যারিকেড। আর তা টপকে যাওয়ার ক্ষমতা তাদের কারও নেই। সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ একেবারে অন্য নেতৃত্ব সাইডলাইনে অপেক্ষায় আছে। একটা সুযোগ মানেই তারা ঢুকে পড়বে ময়দানে। রাশ হাতে তুলে নেবে রাজনীতি নামক নক আউট গেমের। এতটুকু রেয়াত করবে না ছেঁটে ফেলতে। তাই মোদি জনতা পার্টিকে টিকিয়ে রাখতে হলে মোদিজিকেই চাই। দল আরও একবার বিজেপিতে ফিরে গেলে সমীকরণ বেসামাল হবেই। সঙ্ঘ অবশ্য এসব বোঝে না। তাদের কাছে নেতার থেকে অনেক বড় হল এজেন্ডা। নরেন্দ্র মোদি তাই দ্বিতীয় ইনিংসের শেষ পর্বে এসে সেইসব এজেন্ডার সলতেতেই আগুন দিচ্ছেন। যেমন, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, এক দেশ এক ভোট, হিন্দুরাষ্ট্র... এই সবই গণতন্ত্রের মোড়কে একাধিপত্য কায়েমের ব্লু-প্রিন্ট। একাধিপত্য কার? এতদিন একটিই নাম সামনে ছিল—নরেন্দ্র মোদি। এখন কিন্তু তা আর নেই। ধীরে ধীরে রং বদলাচ্ছে আবহাওয়ার। একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই এজেন্ডা কোনও ব্যক্তির নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের। সাম্রাজ্য বিস্তার চলছে সেইমতো। এরপর সেন্সাস হবে, ডিলিমিটেশন, কিংবা রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন। সবেরই অভিমুখ যাবে একইদিকে—একাধিপত্যের ফর্মুলা। দেশের রাজনৈতিক ম্যাপ নিয়ে কাটাছেঁড়া হবে, ভোটব্যাঙ্ক ভাগ হবে, দুর্বল এলাকায় ব্যালান্স আনা হবে... এই সবই ফর্মুলার অঙ্গ। সেখানে নরেন্দ্র মোদি নিমিত্ত মাত্র। সঙ্ঘের আজ্ঞাবহ। তাঁর জনপ্রিয়তা এবং অথরিটি হালে পানি না পেলে সঙ্ঘ দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তিকে খুঁজে নেবে। কাজ না হলে তৃতীয়। এজেন্ডা পরিপূর্ণ করার পথে দৌড় কিন্তু থামবে না। কোনও ব্যক্তির জন্য নয়। এখানেও একটা প্রশ্ন উঠে আসছে—নরেন্দ্র মোদি ছাড়া অন্য কেউ বিজেপির মুখ হলে কি এভাবে ভোট-সাগরে বিজেপি ভাসতে পারবে? আমাদের দেশে এখনও নেতানেত্রীর মুখ দেখে ভোট হয়। কংগ্রেস তাই এত ভালো পরিস্থিতি তৈরি করা সত্ত্বেও লোকসভা ভোটে রাহুল গান্ধীর অ্যাভারেজ জনপ্রিয়তার জন্য বিপুল সংখ্যক আসন জিততে পারেনি। যেটা নরেন্দ্র মোদি বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একক ক্যারিশমায় করে থাকেন। সঙ্ঘ সেই মিথটাই ভাঙতে চাইছে। এই বদলের কর্মসূচিতে তাঁদের অস্ত্র একটাই—মেরুকরণ। মোদিকে সামনে রেখে ভারতে মেরুকরণ যদি ঠিকঠাক হয়ে যায়, তাহলে আর ব্যক্তির উপর নির্ভর না করলেও চলবে। প্লেন তখন অটো পাইলটে উড়বে। মানুষ ধর্ম নিয়ে মেতে থাকবে, আর ‘অশিক্ষার আলোয়’ দেদার চলবে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
কবি রাজশেখর সম্রাট বিজয়াদিত্যকে বলেছিলেন, ‘সিংহাসন থেকে একবার মাটিতে পা ফেলেন দিকি। ওই মাটির মধ্যে জীবন-যৌবনের জাদুমন্ত্র আছে।’ কারণ তিনি বুঝেছিলেন, এই মানুষটা সত্যিকারের রাজা হতে চায়। সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা কিংবা বাড়ানো এর লক্ষ্য নয়। তাহলেই যে সিংহাসনের অলঙ্কার ছাপিয়ে মানুষের মনে তার অধিষ্ঠান হয়। চিরকালের জন্য। শুধু মাটিতে পা রাখতে হবে। ক্ষমতা, অর্থ, অহঙ্কার বা ধর্ম-জাতপাতের জুতোয় পা গলালে সাম্রাজ্য মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে, কিন্তু তার ‘দি এন্ড’ আছে। অবসরও আছে। তারপর আর কেউ সেই রাজাকে মনে রাখবে না। বিজেপি কি এমন রাজা চায়? নরেন্দ্র মোদি কি এমন রাজা হতে চান? ফটোসেশন ছাড়া মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তাঁর কোনওদিনই নেই। অবসর এড়াতে হলে ওইটে এখন বড্ড প্রয়োজন। মন কি বাত বলা নয়, বরং শোনা। ‘ত্যাজিয়ে সোনার গদি...।’