ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতকে চুপ করিয়ে দিয়েছিল। কোম্পানির ব্যবসায়িক দক্ষতা-মাহাত্ম্যে কেউ নির্বাক হয়ে যায়নি, বরং তারা ভারতবাসীর টুঁটি চেপে ধরেছিল। আমাদের দেশীয় মহারাজা ও নবাবদের সঙ্গে ব্যবস্থাক্রমে—ঘুষ এবং হুমকির মাধ্যমে এক শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতি কায়েম করেছিল কোম্পানি। এটি আমাদের ব্যাঙ্কব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র এবং তথ্যাদি আদান-প্রদানের ক্ষেত্রগুলিকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল। এর ফলে আমাদের স্বাধীনতা আমরা অন্য একটি জাতির কাছে খোয়াইনি; আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম এমন একটি একচেটিয়া বাণিজ্যিক সংস্থার (মনোপলিস্টিক কর্পোরেশন) কাছে যেটি আমাদের সমগ্র ব্যবস্থাকে কব্জা করে নিয়েছিল।
কোম্পানি বাণিজ্যের শর্তাবলি এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করত যে তার ফলে প্রতিযোগিতার ব্যাপারটাই উধাও হয়ে গিয়েছিল। কে, কার কাছে এবং কী বেচবে—সেটা তারাই ঠিক করে দিত। তাদের এই নয়া ব্যবস্থার সরাসরি বলি হল আমাদের বস্ত্রবয়ন শিল্প এবং উৎপাদন ব্যবস্থা। এই কোম্পানি নিজস্ব কোনও পণ্য উদ্ভাবন করেছে কিংবা বাজার বা বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নে তার কোনও অবদান রেখেছে বলে আমি অন্তত শুনিনি। আমি যা জানি তা হল, তারা একটি অঞ্চলে আফিম চাষের একচেটিয়া অধিকার ফলাত এবং অন্য অঞ্চলে আফিম আসক্তদের সামনে হয়ে উঠেছিল একমাত্র সাপ্লায়ার। তবুও, ভারতকে লুট করার সময় কোম্পানিটি ইংরেজ মুলুকে (যুক্তরাজ্যে) একটি ‘মডেল কর্পোরেট সিটিজেন’ হিসেবে সমাদৃত ছিল। সেটাই ছিল কোম্পানির বিদেশি শেয়ার গ্রহীতাদের পছন্দ।
মূল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেড়শো বছরেরও আগে নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তারা তখন যে ভীতির নগ্নতা কায়েম করেছিল সেটি ফিরে এসেছে। তাদের শূন্যস্থান দখল করেছে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের একটি নতুন প্রজাতি। তারা প্রচুর সম্পদ কুক্ষিগত করেছে। তার ফলে ভারতজুড়ে অনেকখানি বেড়েছে অসাম্য এবং অন্যায়। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলি আর আমাদের জনগণের নেই, তারা কেবল একচেটিয়া কারবারিদের হুকুম তামিল করছে। তাদেরই উৎপাতে লক্ষ লক্ষ ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে গিয়েছে এবং এই চক্রে পড়ে ভারত তার যুবক-যুবতীদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে অপারগ। ভারতমাতা তার সকল সন্তানের মা। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের জন্য তার সম্পদ এবং ক্ষমতার এই যে খোলাখুলি ও নির্লজ্জ একচেটিয়াকরণ ঘটেছে, তাতে অনেকের অধিকার নস্যাৎ হয়েছে। এই ঘটনা আহত করেছে আমাদের ভারতমাতাকেই।
আমি জানি যে, ভারতের শত শত উজ্জ্বল এবং উদ্যমী নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী এই একচেটিয়া কারবারিদের নিয়ে ভীত। আপনি কি তাঁদেরই অন্যতম? আপনি কি ফোনে কথা বলতে ভয় পান? একচেটিয়া কারবারিরা রাষ্ট্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র সাপেক্ষে আপনার বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ করে আপনাকে পিষে ফেলতে পারে, আপনি কি এমন কোনও ভয় পাচ্ছেন? আয়কর, সিবিআই কিংবা ইডি হানার ভয়ে কি আপনার প্রিয় ব্যবসাপত্তর তাদের কাছে বেচে দিতে বাধ্য হওয়ার ভয় পাচ্ছেন আপনি? যখন আপনার মূলধনের ভীষণ প্রয়োজন তখন কি আপনি তাদেরই ভয়ে তীব্র অর্থসংকটে পড়েন? আপনাকে বাগে আনতে, খেলার নিয়ম মাঝপথে ওদের তরফে আচমকা পাল্টে ফেলার আতঙ্ক গ্রাস করে কি?
আপনি জানবেন, এই স্বৈরতান্ত্রিক নীতিহীন গোষ্ঠীগুলিকে বণিক-ব্যবসায়ীর সঙ্গে এক করে দেখাটা সমীচীন নয়। আপনি যখন তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বলে ভাবছেন, আসলে তখন আপনি কোনও একটি কোম্পানির সঙ্গে লড়ছেন না, আপনার লড়াইটা চলছে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে। তাদের মূল যোগ্যতা—পণ্য, উপভোক্তা বা আইডিয়া নয়, বরং যেসমস্ত প্রতিষ্ঠান তামাম ভারতকে শাসন ও নিয়ন্ত্রণ করে তাদেরকেই নিয়ন্ত্রণ করার এবং তাদের উপর নজরদারি চালাবার ক্ষমতা ধরে এরা। এই বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলিই ঠিক করে দেয় আপনার মতো ভারতীয়রা কী পড়বেন এবং দেখবেন। ভারতীয়রা কীভাবে চিন্তা করবেন এবং কথা বলবেন, সেখানেও প্রভাব বিস্তার করে তারা। বাজারের শক্তিতে সাফল্য আসে না আজ, সেটি মেলে শক্তিমানের সঙ্গে সম্পর্কের খাতিরে।
আপনাদের অন্তরে ভয় আছে, একইসঙ্গে আছে আশাও। ‘ম্যাচ-ফিক্সিং’ করার মতো ক্ষমতাধর একচেটিয়া গোষ্ঠীগুলির বিপরীতে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ দারুণ ভালো ও সৎ অসংখ্য ভারতীয় বাণিজ্যিক সংস্থা রয়েছে। সব জেনেও কিন্তু আপনি নীরব! একটি অত্যাচারী ব্যবস্থায় মধ্যেই আপনি মাথা তুলে থাকতে চাইছেন। পীযূষ বনসালের কথাই ধরুন। তাঁর কোনও রাজনৈতিক যোগাযোগ নেই। প্রথম প্রজন্মের এই উদ্যোগী একটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন মাত্র ২২ বছর বয়সে। চশমার জগতে নতুন মাত্রা এনেছে লেন্সকার্ট নামক যে সংস্থাটি, ২০১০ সালে তার সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাঁর চলার শুরু। সংস্থাটি আজ ভারতজুড়ে হাজার হাজার মানুষের চাকরি বা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে। তারপরে আসা যাক ফকিরচাঁদ কোহলির কথায়। ১৯৭০-এর দশকে একজন ম্যানেজার হিসেবে তিনি টাটা কনসালটেন্সি তৈরি করেন। এটি ছিল ভয়কে পিছনে ফলে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষার জয়—আইবিএম এবং একসেঞ্চারের মতো জায়ান্টদের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার হিম্মত। আইটি বা তথ্য-প্রযুক্তি পরিষেবা প্রদান সংস্থাগুলি সামান্য বুটিক প্রক্রিয়া থেকে একটি আস্ত শিল্পে উন্নীত হয়েছে—সেখানেই টিসিএস এবং অন্য অগ্রণী সংস্থাগুলি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। পীযূষ বনসাল বা প্রয়াত এফ সি কোহলিকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। তাঁদের রাজনৈতিক পছন্দ আমার থেকে ভিন্ন হতেই পারে, তাতে কী? মনে হয় যে নবীন প্রজন্মের মধ্যে টাইনর, ইন-মোবি, মান্যবর, জোম্যাটো, ফ্র্যাকটাল অ্যানালিটিকস, আরাকু কফি, ট্রেডেন্স, আমাগি, আইডি ফুডস, ফোন-পে, মগলিক্স, সুলা ওয়াইনস, জাসপে, জিরোধা, ভেরিটাস, অক্সিজো, অ্যাভেনডাস এবং পুরনোদের মধ্যে এলঅ্যান্ডটি, হলদিরাম, অরবিন্দ আই হসপিটাল, ইন্ডিগো, এশিয়ান পেইন্টস, এইচডিএফসি গ্রুপ, বাজাজ অটো এবং বাজাজ ফিনান্স, সিপ্লা, মাহিন্দ্রা অটো, টাইটানের মতো কোম্পানিগুলি সম্পর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে তেমন কিছুই জানি না। যেসব দেশীয় কোম্পানি নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও দক্ষতার জোরে এবং নিয়ম মেনে ব্যবসা ও উন্নতি করেছে—এগুলি তারই ছোট নমুনা মাত্র। আমি নিশ্চিত যে এই সংক্রান্ত আরও ভালো সংস্থার অসংখ্য নাম বাদ পড়ে গিয়েছে। তবে সেটা ইচ্ছাকৃত নয়, কোন প্রসঙ্গে এই নমুনাগুলির উল্লেখ, পাঠক আশা করি তা বুঝেছেন।
দুর্বল ও রুদ্ধকণ্ঠ মানুষকে রক্ষা করাই আমার রাজনীতির সবসময়ের লক্ষ্য। লাইন বা পংক্তির অন্তিম প্রান্তে যে রুদ্ধকণ্ঠ মানুষটি অপেক্ষা করে আছেন, তাঁকে রক্ষা করার প্রেরণা আমি গান্ধীজির কথা থেকে পাই। এই প্রত্যয়ই—এমএনআরইজিএ (১০০ দিনের কাজের গ্যারান্টি প্রকল্প), খাদ্যের অধিকার এবং জমি অধিগ্রহণ বিল সমর্থনে আমাকে এগিয়ে দেয়। নিয়ামগিরির মারাত্মক সংঘর্ষে আদিবাসীদেরই পাশে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। তিনটি কালা কৃষি আইনের বিরুদ্ধে কৃষকদের সংগ্রামেও আমি সমর্থন দিয়েছি। মণিপুরের মানুষের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার কথাও শুনেছি আমি।
আজ, এই লেখা লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছি যে, গান্ধীজির কথার সম্পূর্ণ গভীরতা আমি ছুঁতে পারিনি। ‘লাইন’ বা ‘পংক্তি’ যে রূপক অর্থে ব্যবহৃত একটি শব্দ, তা অনুধাবনে আমি ব্যর্থ হয়েছি—আসলে এখানে অনেকগুলি ভিন্ন লাইন রয়েছে। ব্যবসা ক্ষেত্রে আপনি যে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, সেখানে আপনিই শোষিত এবং সুবিধা-বঞ্চিত। আর তাই, আমার রাজনীতির লক্ষ্য থাকবে—আপনাকে ন্যায্য প্রাপ্য ফেরানো এবং সবার জন্য সমান নিয়ম চালু করা।
অন্যদের পয়সায় বা যাবতীয় খরচে একটিমাত্র ব্যবসাকে সহায়তা-সমর্থন জোগানোর অনুমতি সরকারকে দেওয়া যায় না, এটা আসলে ব্যবসা জগতে বেনামি ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। সরকারি সংস্থাগুলি ব্যবসাকে আক্রমণ করা এবং সন্ত্রস্ত রাখার অস্ত্র নয়। তবে এও বলব না যে, ভয়টা আপনার থেকে বড় একচেটিয়াদের কাছে চালান করা উচিত। তারা কোনও দুষ্ট ব্যক্তি নয়, এসব কেবল আমাদেরই সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে লালিত গলদের ফলাফল। ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য আপনার মতো তাদেরও ন্যায্য স্পেস বা জায়গা পাওয়া উচিত।
এই দেশ আমাদের সবার। আমাদের ব্যাঙ্কগুলির উচিত, যাঁদের ‘দারুণ কানেকশন’ আছে এরকম শীর্ষ শ’খানেক খেলাপি ঋণগ্রহীতার প্রতি তাদের একপেশে মোহমুগ্ধতা কাটিয়ে ওঠা এবং যাঁরা নিয়মনীতি মেনে ব্যবসাপত্তর করেন ঋণপ্রদানের হাত তাঁদের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া। তবেই ব্যাঙ্কগুলি ন্যায্য মুনাফা অর্জনের রাস্তা ফিরে পাবে। পরিশেষে এটাই বলব যে, রাজনৈতিক আচরণ বদলে দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক চাপ ও প্রতিরোধের শক্তিকে খাটো করে দেখা উচিত নয়। কোনও ‘মসিহা’র প্রয়োজন নেই। আপনার পরিবর্তনই সকলের জন্য সম্পদ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।
আমি বিশ্বাস করি, প্রগতিশীল ভারতীয় ব্যবসার জন্য ‘নিউ ডিল’ আসলে একটি ‘আইডিয়া’—তারই সময় আজ উপস্থিত হয়েছে।
লেখক সাংসদ ও প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি। মতামত ব্যক্তিগত