চমকের রাজনীতি
বিজেপির আস্থা চমকেই। নরেন্দ্র মোদি যে অনবদ্য রাজনীতির আমদানি করেছেন, বঙ্গ বিজেপি আত্মস্থ করেছে সেটাই। জাতীয় রাজনীতিতে মোদির আবির্ভাব, উত্থান থেকে সরকার পরিচালনা এবং বিদেশ নীতি—সব মিলিয়ে এক চমকের সিরিজ উপহার পেয়েছে ভারত। কিন্তু চমকে চমকে সাধারণ ভারতবাসীর শেষমেশ পিলে চমকে যাওয়ারই অবস্থা হয়েছে কেবল, সুরাহা জোটেনি কিছুই। এজন্য যে জবাব প্রত্যাশিত ছিল সেটাই দেশবাসী দিয়েছে চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে। লোকসভায় বিজেপি আর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, একচ্ছত্র আধিপত্য এবং দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রদর্শনে অভ্যস্ত মোদি এখন একটি দুর্বল জোট সরকারের নেতা মাত্র! তবু চমকের রাস্তা থেকে সরেনি বঙ্গ বিজেপি। রাজ্যে অনুষ্ঠেয় ৬ আসনের বিধানসভা উপ নির্বাচনেও তারা চমক দিয়েছে সবার আগে প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে। চমক বলতে অবশ্য ওইটুকুই। স্থানীয় প্রার্থীদের নাম, ধার-ভার ইত্যাদি যারপর নাই ম্যাড়মেড়ে।
এবারের লোকসভা ভোটে দিলীপ ঘোষকে মেদিনীপুর থেকে হটিয়ে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে ‘গ্যারাজ’ করা হয়েছিল। অন্যদিকে মেদিনীপুর আসনটি ‘উপহার’ দেওয়া হয়েছিল আসানসোলের বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পলকে। ফল যা হওয়ার হয়েছিল সেটাই—দুই আসনেই বিজেপি প্রার্থীদের গোহারা করেছে তৃণমূল। রাজনৈতিক মহলের বদ্ধমূল ধারণা, দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি ও এমপি গোষ্ঠী রাজনীতির শিকার। অথচ তাঁরই নেতৃত্বে বিজেপির আসল উত্থান হয়েছিল এ রাজ্যে। তাই মরা গাঙে ফের বান আনতে দলের অনেকেই দিলীপ ঘোষকে বঙ্গ বিজেপির সভাপতি এবং রাজ্য বিধানসভায় চান। কিন্তু এবারও হতাশ করা হয়েছে তাঁকে এবং বঙ্গ বিজেপির শুভানুধ্যায়ীদের। উপ নির্বাচনে তাঁর নাম বিবেচিত হয়নি। গেরুয়া চমকের এও একটি রকম বইকি!
বিজেপি প্রার্থী সিতাই কেন্দ্রে দীপককুমার রায়, মাদারিহাটে রাহুল লোহার, নৈহাটিতে রূপক মিত্র, হাড়োয়ায় বিমল দাস, মেদিনীপুরে শুভজিৎ রায় এবং তালড্যাংরায় অনন্যা রায় চক্রবর্তী। এই ৬ আসনের বিধায়করা গত লোকসভা ভোটে জিতেছেন। তবে তাঁদের মধ্যে বসিরহাটের সাংসদ হাজি নুরুল ইসলামের মৃত্যু হয়েছে সম্প্রতি। হাড়োয়ার বিধায়ক পদ ছেড়েই তিনি এমপি হন। যেসব আসনে উপ নির্বাচন হবে তার মধ্যে বিজেপি ২০২১ সালে জিতেছিল একটিতে। দলের আরও কয়েকজন বিধায়ক লোকসভার ভোটে লড়লেও জয় পান একমাত্র মনোজ টিগ্গা। মাদারিহাটের বিধায়ক মনোজ এমপি হওয়ায় ওই আসনে ভোট নেওয়া হবে। এছাড়া কোচবিহারে সিতাই আসন ছেড়ে তৃণমূলের এমপি এখন জগদীশচন্দ্র বর্মা বসুনিয়া। নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিক বিজেপির অর্জুন সিংকে হারিয়ে এখন বারাকপুরের এমপি। মেদিনীপুর এবং তালড্যাংড়ায় শূন্যতার কারণ যথাক্রমে জুন মালিয়া এবং অরূপ চক্রবর্তীর লোকসভায় প্রবেশাধিকার লাভ।
নিছক কৌশলের রাজনীতি
অধীর চৌধুরী মনে-প্রাণে চেয়েছিলেন বলে শোনা যায়। তবু তাঁর পুরনো মিত্র সিপিএমের সঙ্গে শেষমেশ নির্বাচনী জোট হল না। উপ নির্বাচনের ৬ আসনেই শেষমেশ প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস—কোচবিহার জেলার সিতাইয়ে হরিহর রায় সিংহ, আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাটে বিকাশ চম্প্রমারি, উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটিতে পরেশনাথ সরকার ও হাড়োয়ায় হাবিব রেজা চৌধুরী, মেদিনীপুরে শ্যামলকুমার ঘোষ এবং বাঁকুড়ার তালড্যাংরায় তুষারকান্তি সন্নিগ্রাহী। ২০১২ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে একাধিক নির্বাচনে সিপিএম-কংগ্রেস জোট করেই ভোটে লড়েছে। অনেকদিন বাদে কংগ্রেসকে পুরনো চেহারায় ফিরে পেলেন কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকরা।
প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার পর প্রথম সাংবাদিক বৈঠকে দলের ‘শক্তি-যাচাই ও শক্তি-বৃদ্ধি’র কথা বলেছিলেন শুভঙ্কর সরকার। সেইমতোই এবারের উপ নির্বাচনে জেলা নেতাদের সম্মতিতে একলা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিধানভবন। গত কয়েকটি নির্বাচনে কংগ্রেসই আগ বাড়িয়ে বামেদের (পড়ুন, সিপিএমের) সঙ্গে সমঝোতার বার্তা দিয়েছিল। কিন্তু এবার সিপিএমকে আদৌ পাত্তা দেয়নি তারা।
অন্যদিকে, রাজ্য বিধানসভায় এবং বাংলা থেকে লোকসভায় সিপিএম জাস্ট নোহোয়ার হয়ে গিয়ে এতটাই দিশেহারা যে, যার-তার-সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে মরিয়া ছিল। অথচ এই মারাত্মক মাতব্বর পার্টিই ক্ষমতায় থাকাকালে বামফ্রন্টকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পৈতৃক সম্পত্তি ভেবে এসেছে। তারা এটাই প্রমাণ করে ছেড়েছিল যে লেফট ফ্রন্ট ইজ ইকোয়াল টু সিপিএম। ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআইয়ের মতো একদা গুরুত্বপূর্ণ বাম দলের সঙ্গে জ্যোতি বসুরা মনিবের মতোই ব্যবহার করেছেন। এসইউসি, সিপিআই (এমএল) লিবারেশন প্রভৃতি আন্তরিক থেকেও বামফ্রন্টের বৃত্তে টিকতে কিংবা ঢুকতেই পারেনি। কিন্তু মাটির চরিত্র না বুঝে বেশি দাপাদাপি করলে যে হাতিকেও কাদায় পড়তে হয়! কাদাজলে হাবুডুবু খাওয়া হাতিরই দশা আলিমুদ্দিনের মাতব্বরদের। ফ্রন্ট শরিকরা আর সিপিএমের মন্দিরে পুজো চড়াতে যায় না। কংগ্রেসের কনুইয়ের গুঁতো খাওয়ার পরই সিপিআই (এমএল) লিবারেশনকে একটি আসনে লড়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। নৈহাটি থেকে সিপিএমের সমর্থনে লড়বেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের পার্টির প্রতিনিধি দেবজ্যোতি মজুমদার। আর নৌশাদ সিদ্দিকির আইএসএফ’কে ছাড়া হয়েছে হাড়োয়া আসনটি—লড়বেন পিয়ারুল ইসলাম। সব মিলিয়ে এই ভোটে ৬ কেন্দ্রেই চতুর্মুখী লড়াই অনিবার্য। লোকসভা ভোটে জিততে পারলে এবং প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ ধরে রাখতে পারলে এবারের লড়াইয়ে সিপিএমকে কোনোভাবেই হতাশ করত না রাহুল গান্ধীর দল।
মানুষের রাজনীতি
চমক এবং কৌশলের রাজনীতিতে, অন্তত বাংলার মানুষের কোনও আস্থা নেই। তবু চমকের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এখনও ব্যস্ত বিজেপি। জুমলা, কুৎসা, ঘৃণা, বিভাজন এবং উগ্র হিন্দুত্ব—পাবলিক এগুলির কতটা কখন খায়, শুধু তার আঁক কষে গিয়েছেন সঙ্ঘের সম্পদরা। লোকসভার ভোটই পরিষ্কার করে দিয়েছে, একদম ভোঁতা হয়ে গিয়েছে এই খেলার ধার। অথচ দু-দু’বার কেন্দ্রীয় ক্ষমতার জোরে শ্যামাপ্রসাদের বাংলার মানুষের জন্য বহুকিছু করে দেখানোর সুযোগ বিজেপির হাতে ছিলই। কিন্তু তারা সেই সহজ সুন্দর পথ পরিহার করেছে সযত্নে।
অন্যদিকে, অতিচালাকের গলায় দড়ি অবস্থা লালপার্টির। সাড়ে তিন দশক রাইটার্সে থেকে গরিব ও পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য বামেরা বহু ভালো কাজ করতে পারত। দলবাজি, ঘোঁটবাজিতে অগ্রাধিকার এতটাই দিয়েছিল যে, আশুকর্তব্য কোনোটাই তারা সময়ে করেনি। বিশেষ করে রাজনীতি এবং প্রশাসনে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে ভাবেইনি তারা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে বস্তুত প্ল্যান করে বামেদের সেই ঘাটতি পূরণ করে চলেছেন। কিন্তু কোন জ্বালা থেকে কী জানি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেইসমস্ত প্রশংসনীয় কাজের সবচেয়ে বড় বিরোধী ও সমালোচক হয়ে উঠল সিপিএম! ব্যাপারটা এরকমই দাঁড়ায় যে, রাম-বাম যেন গোপন শলা করেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে পড়ে আছে। ফলে মানুষের জন্য রাজনীতি থেকে ক্রমে দূরবর্তী হয়েছে তারা।
এমনই আবহে, দেরিতেই সুচিন্তিত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছে রাজ্যের শাসক শিবির। উপ নির্বাচনে তৃণমূলের তালিকা এইরকম—নৈহাটিতে সনৎ দে, হাড়োয়ায় শেখ রবিউল ইসলাম, মেদিনীপুরে সুজয় হাজরা, তালড্যাংরায় ফাল্গুনী সিংহবাবু, মাদারিহাটে জয়প্রকাশ টোপ্পো এবং সিতাইয়ে সঙ্গীতা রায়। আলোচ্যমান আসনগুলির মধ্যে একমাত্র মাদারিহাট বিজেপির দখলে। বাকি ৫ কেন্দ্রই তৃণমূলের গড়। এই ভোটে এগুলি পুনরুদ্ধারের সঙ্গে মাদারিহাট বিজেপির কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়াই তৃণমূলের লক্ষ্য। লোকসভা নির্বাচনের পর পরই, গত জুলাই মাসে রাজ্যে ৪ আসনের উপ নির্বাচনে (মানিকতলা, বাগদা, রানাঘাট দক্ষিণ এবং রায়গঞ্জ) সবক’টিতেই জয় হাসিল করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। লোকসভা ভোটেও বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএমকে একহাতে জব্দ করেছে তৃণমূল। বিজেপি ১৮ থেকে নেমে এসেছে মাত্র ডজনে। অন্যদিকে, ‘বিগ জিরো’ সিপিএম! সিপিএমের জিগরি দোস্ত অধীর চৌধুরীকে অর্ধচন্দ্রই দিয়েছেন বহরমপুরের গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণ। একটিমাত্র আসনে জিতে (মালদহ দক্ষিণে ইশা খান চৌধুরী) কোনোক্রমে শূন্যতার বিষাদ কাটিয়েছে কংগ্রেস।
তবে তারপর রাজ্য-রাজনীতি উত্তাল হয়েছে একাধিক ইস্যুতে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আর জি কর কাণ্ড। সন্দেশখালি থেকে আর জি কর—একের পর এক মর্মান্তিক ইস্যুতে মানুষ শুধু ন্যায়বিচার চেয়েছে, সংকীর্ণ রাজনীতি চায়নি। কিন্তু ‘নাগরিক আন্দোলনের’ আড়ালে রাম-বাম মানিক জোড়ের ক্ষমতার দাঁত-নখ কতটা সক্রিয়, তা ফাঁস হতে দেরি হয়নি। ফলে আর জি কর কাণ্ড থেকে ডিভিডেন্ড লাভ দূরে থাক, ইস্যুটা ব্যুমেরাং হওয়ার অবস্থা। দুই ধান্দাবাজই হাল ছেড়ে দিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তাই এই উপ নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাসি চওড়া না-হওয়ার কোনও কারণ গ্রাহ্য নয়। পঞ্চায়েত, বিধানসভা, লোকসভা প্রভৃতি পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলিতে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ স্থান দখলের যে প্রতিযোগিতা ছিল—এই ভোটে সেটাও বোধহয় থাকছে না। কারণ একের নীচে সবাই সম্ভবত ‘শূন্য’ হওয়ার জন্যই মানসিকভাবে তৈরি থাকছে।
ধর্ষণ ও লাশের রাজনীতি এই ধান্দাবাজদের বোঝা আর বইতে পারছে না। বহরে ছোট হলেও, এই উপ নির্বাচন আগামীর জন্য অনেক ইঙ্গিতই রেখে যাবে। এই ভোটের তাৎপর্য এটাই। স্বামী বিবেকানন্দ দাগ রেখে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। কথার মর্মার্থ বুঝতে পারেনি সিপিএম—তারা গুলিয়ে ফেলেছিল কলঙ্কের সঙ্গে। সাতদফায় ৩৪ বছর ধরে যেসব দাগ রেখেছে লালপার্টি, তার বেশিরভাগটাই কলঙ্কদাগ মাত্র। বাংলায় লাল জমানার কলঙ্কদাগ মুছতে হয়তো আরও একাধিক দশক মেহনত করতে হবে মেহনতি মানুষের পার্টিকে। আর বিজেপি? তারা যে বাংলা-বিরোধী নয়, এটাই প্রমাণ করতে গলদঘর্ম হবে। ততদিনে পেরিয়ে যাবে ২০২৬!