এই যে কয়েকশ বছর ধরে কোনও নারীকে বিশ্বের সবথেকে সম্পদশালী দেশ আমেরিকায় কিছুতেই রাষ্ট্রপ্রধান করা হল না, শুধু এটাই কি পুরুষতন্ত্রের উদাহরণ? অবশ্যই এর মধ্যে যতটা রাজনীতি আছে, ততটাই পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসন আছে। কিন্তু পুরুষতন্ত্র নিছক নারীর ক্ষমতায়নে বাধা দেওয়া নয়। পুরুষতন্ত্র সেটাও যেখানে ক্ষমতাসীন নারীকে অপমান করা হয় প্রতিনিয়ত। নারীকে সর্বদাই হেয় প্রতিপন্ন করতে আনন্দ হয়। কাকে বলে পুরুষতন্ত্র? ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সমর্থকরা যখন কমলা হ্যারিসের সন্তানহীনতা সম্পর্কে ব্যঙ্গ করেন, সেটাকে বলে পুরুষতন্ত্র। তাঁর বাবা ব্ল্যাক, মা ভারতীয়, অতএব কমলা হ্যারিস কোনওটাই নয়। এই শ্লেষ হল পুরুষতন্ত্র। ঠিক এভাবেই আমেরিকা থেকে বহু দূরে একজন নারীর উপর চরম নির্যাতনের বিচার চাওয়ার নাগরিক আন্দোলনে কোনও এক মহানগরীর মিছিলে যখন পোস্টারে লেখা হয়, ‘কালীঘাটের ময়না/সত্য কথা কয় না’ সেটা হল পুরুষতন্ত্র। রাজনীতির বিরোধিতা না করে যখন শিক্ষিত সমাজের মুখ থেকে উল্লসিত ঘৃণার স্লোগান বেরিয়ে আসে ‘জোট বেঁধেছে বাঙাল ঘটি/ভয় পেয়েছে হাওয়াই চটি’, সেটাই পুরুষতন্ত্র। যখন বলা হয় ‘এক হয়েছে হাজার গলা/ভয় পেয়েছে চোদ্দ তলা’, তখন সেটি পুরুষতন্ত্র। কেন? কারণ পুরুষতন্ত্র ভাবে নারীদের ভয় পাওয়াই তাদের জয়। সেই নারী প্রশাসক মোবাইলের স্পিকার ফোনে ধর্মতলায় অনশনকারীদের সঙ্গে কথা বলছেন। তখন তাঁর কণ্ঠ থামিয়ে অথবা স্তিমিত করে দিতে সামনে জমায়েত থেকে উচ্চকিতভাবে আচমকা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ চিৎকার করে হাসাহাসি করা হয় এবং সেই প্রশাসক যাঁদের সঙ্গে কথা বলছেন, সেই ‘মেধাবী’রা কোনও প্রতিবাদ করেন না, সেটাই পুরুষতন্ত্র। এসবের অর্থ কী? অর্থ হল, এই দেখো তোমাকে কেমন অপমান করলাম? এই দেখো, তোমায় অশিক্ষিত বলছি! ছোটলোক বলছি। এই যে নারী শাসকের প্রতি অবজ্ঞা এবং অপমান করে তৃপ্তি পাওয়া, এর নাম পুরুষতন্ত্র। বিধানবাবু, অজয়বাবু, সিদ্ধার্থবাবু, জ্যোতি বাবু, বুদ্ধবাবু বলা হয়েছে। কিন্তু একজন নারী সেই একই পদে বসলে তাঁকে নাম ধরে ডাকা হয়, ওটাই পুরুষতন্ত্র!
সাতের দশকে ভারতের এক ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক বিরোধিতা করার জন্য যে রাজনৈতিক দলটি দেওয়াল লিখনে সেই নেত্রীকে ডাইনি হিসেবে অঙ্কন করত, ডাইনির হাত থেকে রক্ত পড়ছে দেখাতো, সেই কমিউনিস্ট পার্টির আড়ালে থাকা মনস্তত্ত্ব হল পুরুষতন্ত্র। পুরুষের হাতে যাতে ছোটখাটো শখ পূরণে হাত পাততে না হয়, সেটি নিশ্চিত করার জন্য যে প্রকল্পে নারীদের হাতে কিছু সরকারি অনুদান দেওয়া হয়, সেটিকে ভিক্ষা আখ্যা দেওয়াই হল পুরুষতন্ত্র।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল পদত্যাগ করে বাহবা নেওয়ার পর আতিশী মার্লেনা নামক আম আদমি পার্টির নেত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসানো হয় এই তো কয়েকমাস আগে। আতিশী যোগ্য, শিক্ষিত। কিন্তু তিনি নেতার প্রতি আনুগত্য দেখাতে কেজরিওয়ালের চেয়ারে বসেননি। কেজরিওয়ালের চেয়ারকে পাশে শূন্য অবস্থায় রেখে অন্য চেয়ারে বসে মুখ্যমন্ত্রিত্ব চালাচ্ছেন। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চাইছেন তিনি অনুগত এক শিষ্যা। আসলে গুরুই মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কেজরিওয়াল নিজে আতিশীর এই বিবৃতি কিংবা বক্তব্য অথবা অবস্থানের চরম বিরোধিতা করেননি। তিনি যেন এই ব্যবস্থাকে মেনে নিলেন। উপভোগ করলেন। তিনি না থেকেও যে প্রবলভাবে আছেন, এটাই প্রমাণ করার তাড়না। এটাই পুরুষতন্ত্র। আতিশীকে তাই তাঁর দলেরই কেউ মুখ্যমন্ত্রী মনে করে না। যেন তিনি স্টপগ্যাপ। সত্যিই তাই।
কমলা হ্যারিস ভুল ভেবেছিলেন? নাকি তিনি জানতেন? ২৩ অক্টোবর তিনি একটি সাক্ষাৎকারে জোর গলায় বলেছিলেন, আমার নিশ্চিত বিশ্বাস, আমেরিকা একজন মহিলাকে প্রেসিডেন্ট করতে এখন প্রস্তুত। তিনি বলেছিলেন, আ উওম্যান উইথ কালার। প্রসঙ্গত, আজকাল বর্ণবৈষম্যকে দূর করতে ব্ল্যাক বলা হয় না। বলা হয় কালারড। তারও একমাস আগে কমলা হ্যারিস একটি ডিবেটে অংশ নিয়ে বলেছিলেন, ট্রাম্প আর তাঁর জঙ্গি মনোভাবাপন্ন সঙ্গীরা আমেরিকাকে পিছনের দিকে অন্ধকার যুগে নিয়ে যেতে চান। তাঁরা নিয়ে আসতে চান সেই যুগ যেখানে নারীদের ভোটাধিকার নেই। তাঁরা চান সেই যুগ যেখানে নারীদের যেন সম্পত্তিতে অধিকার না থাকে। তাঁরা চান সেই যুগ, যেখানে নারীর নিজের শরীর মন এবং অস্তিত্বের উপর অধিকার না থাকে। নারীদাসত্বই ট্রাম্পের মতো মানুষদের মনোভাব। কিন্তু আমরা সেটা হতে দেব না।
কমলা হ্যারিসের ওই শপথকে আমেরিকা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। যে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ১৭ জন নারী যৌন হেনস্তার অভিযোগ করেছেন, তিনিই জয়ী হয়েছেন ভোটে। তবু কমলা হ্যারিস হননি। একে নারী। তার উপর শ্বেতাঙ্গ নয়। একে বলে পুরুষতন্ত্র।
পুরুষতন্ত্র নিছক পুরুষ সমাজের মধ্যেই রয়েছে এমন মোটেই নয়। এ হল একপ্রকার মনস্তত্ত্ব। স্টেট অফ মাইন্ড। বহু নারীর মধ্যেও গোপনে বাসা বেঁধে রয়েছে চিরন্তন পুরুষতন্ত্র। তাঁরা সেটা হয়তো বুঝতেই পারেন না। ভারতবর্ষ নামক একটি ৩৪টি রাজ্য এবং ১৪২ কোটির দেশের মধ্যে একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া, আর একটিও রাজনৈতিক দলের সুপ্রিমো নারী নয় কেন? কেন মায়াবতী ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ দলিত সম্রাজ্ঞীর আসন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেলেন পুরুষতান্ত্রিক প্রতিপক্ষদের সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে? শক্তিশালী নারী মুখ্যমন্ত্রী আর কেউ নেই কেন? কারণ প্রবল পুরুষতন্ত্রকে টক্কর দিয়ে উঠে আসার মতো সুযোগই দেওয়া হচ্ছে না কাউকে!
১৯৮০ সালে তৈরি হওয়া ভারতীয় জনতা পার্টি ২০২৩ সালে মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে এসে নারী ক্ষমতায়নের প্রচার করেছে। কিন্তু তাঁদের দলের আজ পর্যন্ত একজনও নারী সভানেত্রী হলেন না কেন? গত শতকের আটের দশকে লালকৃষ্ণ আদবানি একটি দুর্দান্ত তরুণ নেতানেত্রীর টিম পেয়েছিলেন। অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, নরেন্দ্র মোদি, প্রমোদ মহাজন, বেঙ্কাইয়া নাইডু, গোবিন্দাচার্য। পরবর্তী কালে রাজনাথ সিং, নীতিন গাদকারি। এঁদের মধ্যে সিংহভাগ কোনও না কোনও সময় দলের সর্বভারতীয় সভাপতি হয়েছেন। সুষমা স্বরাজ হলেন না কেন? তিনিই তো ছিলেন যোগ্যতম! সুষমা স্বরাজ চলে গিয়েছেন। বিজেপির একমাত্র জনপ্রিয় শক্তিশালী নেত্রী ছিলেন বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। তাঁকে ২০২৩ সালের বিধানসভা ভোটে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হল দিল্লির নির্দেশে। রাজস্থানে আজ বিজেপিরই সরকার। অথচ কোথায় বসুন্ধরা? সম্পূর্ণ হারিয়ে গেলেন? কেন? এতগুলো রাজ্যে সরকার চলছে। একজনও কি নারী মুখ্যমন্ত্রী করতে পারতেন না নরেন্দ্র মোদি? করলেন না কেন? নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করার অধিকার রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে দেওয়া হল না। রামমন্দির উদ্বোধনের অধিকার দ্রৌপদী মুর্মু পাননি। এটাই পুরুষতন্ত্র।
করুণানিধি কন্যা কানিমোঝি কি ডিএমকে দলের নীতি নির্ধারক? না। করুণানিধির পুত্র এম কে স্ট্যালিন কিংবা তাঁর পুত্র উদয়াদিত্য। লালুপ্রসাদকন্যা মিসা ভারতী কি রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী? না। দলের চালিকাশক্তি লালুপুত্র তেজস্বী যাদব। মুলায়ম সিং যাদবের পুত্রবধূ ডিম্পল যাদব কি স্থির করেন সমাজবাদী পার্টির ভাগ্য? না। তাঁর স্বামী অখিলেশ যাদব সর্বোচ্চ নেতা। কেউ কখনও ভেবেছে যে, বৃন্দা কারাত সিপিএমের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন? না। প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরি নিতেন, প্রকাশ কারাতরা নিতেন। এখনও পুরুষপ্রধান কেন্দ্রীয় কমিটি অথবা পলিটব্যুরোই নির্ণায়ক শক্তি।
২০২৪ সালের ভারতে নতুন কোনও নারী রাজনৈতিক নেত্রীর উত্থান হচ্ছে না কেন? গান্ধী পরিবারের নতুন নেত্রী লড়াই করে, ভাবমূর্তি নির্মাণ করে, জননেত্রী হয়ে ক্ষমতা অর্জন করেননি। তিনি তো পদবি ও পরিবারের কারণে এসেছেন এবং ক্ষমতাসীন হচ্ছেন। কিন্তু বাকি ভারতের কী হল? এই যে নারীদের কোনও দলের সর্বোচ্চ স্তরে আসতে দেওয়া হচ্ছে না, এটাই পুরুষতন্ত্র।
পুরুষতন্ত্র আসলে চায় না যে, নারী তাদের শাসন করুক। পুরুষতন্ত্র ক্ষমতাসীন নারীকেও তাই যেনতেনপ্রকারে সর্বদাই হেনস্তা করতে চায়। তাচ্ছিল্য করতে চায়। অপমান করতে চায়। জয়ললিতা থেকে মায়াবতী। মেহবুবা মুফতি কিংবা সোনিয়া গান্ধী। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা কমলা হ্যারিস! সকলকেই তাই চরম অপমানিত হতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তাঁদের প্রত্যেকের ভুল ত্রুটি দোষ ব্যর্থতা অবশ্যই আছে। কিন্তু দেখা যায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই অপমান, অসম্মান এবং আক্রমণ করা হয় ব্যক্তিগত স্তরে। রাজনৈতিক আক্রমণ কম হয়। যেন নিরামিষ রাজনৈতিক আক্রমণ করা হলে পুরোদস্তুর তৃপ্তি পায় না পুরুষতন্ত্র। তাই প্রয়োজন হয় অপমানের। ঠাট্টা, বিদ্রুপ, ব্যঙ্গ, শ্লেষ, হাসাহাসি এবং তীব্র অসৌজন্যের তির। যে কোনও নারী প্রশাসক অথবা নেত্রী কিংবা ক্ষমতার লড়াইয়ে নামা কোনও সাহসিনীর জন্য এটাই হল পুরুষতন্ত্রের কাছে প্রাপ্য।
চরম মূল্যবৃদ্ধি। বেকারত্ব। প্রায় অথর্ব এবং মানসিকভাবেও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা এক আশি পেরনো নেতাকে নিয়ে ডেমোক্র্যাট পার্টি চরম সঙ্কটে ছিল। সেই আশি পেরনো নেতা জো বাইডেন কিছুতেই আবার প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরবেন না। প্রতিটি দিন শুধু তাঁর কাণ্ডকারধানা দেখেই ডেমোক্র্যাটদের ভোট কমছিল হু হু করে। অবশেষে শেষ লগ্নে জো বাইডেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি হলেন। কিন্তু ততদিনে বিপুল ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। চরম আগ্রাসী ডোনাল্ড ট্রাম্পের পকেটে প্রায় এসে গিয়েছে গরিষ্ঠতা। এমতাবস্থায় কমলা হ্যারিসকে আসরে নামায় ডেমোক্র্যাট পার্টি। গোহারা ম্যাচকে তিনি কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে প্রায় সমান সমান এক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন একক প্রয়াসে। সুতরাং কমলা হ্যারিসের লড়াই ইতিহাস মনে না রাখুক, বিশ্বের সব লড়াকুদের যেন মনে থাকে।
পুরুষতন্ত্রের আগ্রাসনের ভূগোল হয় না। বিশ্বজুড়ে একই চিত্র। পুরুষতন্ত্রের শুধুই নিত্যনতুন ইতিহাস হয়।