বিশেষ নিবন্ধ

‘জাস্টিস’ আন্দোলন দিশা হারাল কেন?
সমৃদ্ধ দত্ত

কলকাতা পুলিস খারাপ। রাজ্য সরকার খারাপ। সিবিআই খারাপ। সুপ্রিম কোর্ট খারাপ। মিডিয়া খারাপ। শুধু আমরা ভালো। আমাদের যাঁরাই বিরোধিতা করে কিংবা যুক্তি দিয়ে প্রশ্ন করে, তাঁরাই যেন অশিক্ষিত এবং ধর্ষকের সমর্থক। আমাদের ভিন্ন মত যারা প্রকাশ করে, তারা অ্যাভারেজ বুদ্ধির। আমরা মেধাবী। আমরা নারী নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনে একজন নারী আইপিএস অফিসারকে যথেচ্ছভাবে অপমান করেছি দফায় দফায়। কারণ, আমরা নিশ্চিত যে. আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করতে মেধা দরকার হয় না। সর্বভারতীয় ইউপিএসসি পরীক্ষায় আইপিএস পদের সংখ্যা ২০০। অর্থাৎ গোটা ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেবে। উত্তীর্ণ হবে ২০০। আমরা কিন্তু ভাবছি মেধা একমাত্র আমাদের। যে নিম্নবর্গ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করে, তারা মেধাহীন। কতটা জমিতে কতটা সার দিলে সোনার ফসল স্বল্প ব্যয়ে উৎপাদিত হতে পারে, সেটা যাঁরা জানেন, তাঁরাও মেধাহীন। যাঁরা অসামান্য নৈপুণ্যে মোয়া, নাড়ু, নিমকি, চানাচুর এক চিলতে ঘরের বাইরের অংশে তৈরি করে প্লাস্টিকের প্যাকেটে মুড়ে স্বামীর হাতে তুলে দেন দোকানে সাপ্লাইয়ের জন্য অথবা বিক্রির জন্য, তাঁরা মেধাহীন। মফস্‌স঩লের যে মেয়েরা আমাদের ঘরের নারী সদস্যদের ৫ হাজার, ১০ হাজার টাকার শাড়ির ফলস, পিকো লাগিয়ে দেন নিখুঁতভাবে ঘরে বসে এবং শাড়িপিছু ৬০ থেকে ১০০ টাকা রোজগার করে সংসারের কাজে লাগান, তাঁরা মেধাহীন। 
আমি শহরে থাকি এবং বাবুসমাজের অঙ্গ, তাই আমি মনে করছি আমাদের সহমত ছাড়া সবাই বুদ্ধিহীন। সবাই অশিক্ষিত। সকলেই রাজ্য সরকার অথবা শাসক দলের অনুগত। অথচ আমরা তিন মাস ধরে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে প্রমাণ করে দিয়েছি বেশি বেশি কথা বলে যে, আমরা জুডিশিয়াল ব্যবস্থা কীভাবে চলে সেটা জানি না। ভারতের ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের প্রক্রিয়াটি ঠিক কী সেটা জানি না। যে কোনও ফৌজদারি মামলার তদন্ত কীভাবে অগ্রসর হয়, সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। কাকে বলে আইন? কাকে বলে রুলস? কাকে বলে নোটিফিকেশন? কাকে বলে চার্জশিট? আমরা জানি না। আমরা বলেছিলাম, জাস্টিস চাই। কিন্তু কীসের জাস্টিস? ১৪ আগস্ট প্রথম রাস্তায় নেমেছিল মহানগরের একাংশ। প্রথমে বলা হয়েছিল নির্যাতিতার বিচার। ঠিক ২ মাস পর জানা গেল,  কোথায় রেস্ট রুম হবে, কোন কমিটিতে কে থাকবে, কেন ইউনিয়নের নির্বাচন হয় না, কত দ্রুত সিসিটিভি লাগাতে হবে, মোট ওয়াশ রুমের সংখ্যা কত এটা নিয়ে সর্বোচ্চ প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে সন্তুষ্ট হওয়া গিয়েছে। নাগরিকরা জেনে গেলেন এটাই হল জাস্টিস! 
জুনিয়র ডাক্তার এবং নাগরিকদের একাংশের সবথেকে বড়  দুর্বলতা হল  এই ঔদ্ধত্য। এই যে 
উপরে যা যা লেখা হল, ঠিক এই মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে বিগত আড়াই মাসে। তাঁরা প্রথম থেকেই 
ধরে নিয়েছেন যে তাঁদের অভিমতের বিরুদ্ধপক্ষ 
হওয়া মানেই সে খারাপ, একমাত্র তাঁরা ভালো। 
সবাই অশিক্ষিত। একমাত্র তাঁরাই শিক্ষিত। কেউ কিছু জানে না। একমাত্র তাঁরাই সব কিছু জানেন। 
তাঁরাই ঠিক। সবাই ভুল। তাঁরা ভেবেছেন যে 
একমাত্র তাঁরাই নির্যাতিতার হয়ে বিচার ও 
দোষীর সাজা চান। অন্যরা চান না। এই বিস্ময়কর নির্বুদ্ধিতার কারণ জানা গেল না। 
আমি ঠিক এটা কে ঠিক করল? আপনি ঠিক এটাই বা কে ঠিক করল? আমি এবং আপনারা জীবনে তো বহু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি বা নিয়েছেন। অনুতাপ করি যে, অনেক ভুল হয়ে গিয়েছে। তাহলে সেই আমরা যখন কোনও একটি ইস্যুতে কোনও অবস্থান নিয়ে থাকি, তখন মনে রাখি না কেন যে, আমি কিন্তু আবার ভুলও করতে পারি? অতএব নিজেকে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের করব না! অর্থাৎ আমি যা বলি, যা ভাবি, যা বুঝি, সেটাই ঠিক। বাকিরা ভুল!— এরকম মনোভাবের মতো বৃহৎ অশিক্ষা তো আর হয় না। 
হাইকোর্ট চারদিনের মধ্যেই তদন্তভার সিবিআইকে দিয়েছে। সিবিআই দু মাস পর হুবহু কলকাতা পুলিসের মতোই মতপ্রকাশ করে চার্জশিট দিয়েছে। এখন মনে হতেই পারে যে সিবিআই এই চার্জশিটে প্রকৃত দোষীদের কথা বলেনি। যা আপনারা প্রবলভাবে বাইরে বলেছেন। ডেপুটেশন দিয়েছেন রাজ্যপালকে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! যেখানে বলার দরকার ছিল, সেখানে বলেননি। সুপ্রিম কোর্টে ডাক্তারদের আইনজীবী এই নিয়ে একটিও বাক্য উচ্চারণ করলেন না! কেন? তদন্ত মনিটর করছে তো সুপ্রিম কোর্ট। এটা তো বিরাট বড় এক সুবিধা সুবিচার পাওয়ার। সেখানে বিগত একটিও শুনানিতে কি দেখা গিয়েছে নির্যাতিতার জাস্টিস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? কতদিনের মধ্যে সব সিসিটিভি লাগানো হবে, কতদিনের মধ্যে রেস্ট রুম হয়ে যাবে, কতদিনের মধ্যে ঘোষিত ইনফ্রাস্ট্রাকচার নির্মাণ সমাপ্ত হবে, এসবই এসেছে সওয়াল জবাবে। 
অবস্থান মঞ্চে, মিছিলে এবং সেমিনারে চিৎকার করে বলছেন যে, একা সঞ্জয় রায় ওরকম নারকীয় ঘটনার দোষী হতেই পারে না। নিশ্চিত একাধিক কেউ ছিল। এই কথাটা আপনাদের আ‌ইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে বললেন না কেন? কারণ কী? 
এই আন্দোলনকারীদের এবার আত্মবিশ্লেষণ করতে হবে। এতদিন আপনারা ভেবে এসেছেন আপনারা শক্তিশালী। অবশ্যই শক্তিশালী। কিন্তু এবার ভাবুন যে সেইসব শক্তির মধ্যে আপনাদের দুর্বলতাগুলি কী কী ছিল! কেন এভাবে ক্রমেই একটি নাগরিক আন্দোলন নিছক জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে পরিণত হল? তারপর কেন স্পষ্ট হল, তথাকথিত অরাজনৈতিক আন্দোলন আসলে রাজনীতির মাথারাই পরিচালনা করছে? এটা আসলে রাজনৈতিক আন্দোলন, এই ধারণা জনমনে প্রতীয়মান হল কেন? 
আপনাদের খুঁজে দেখতে হবে কারা ১৪ আগস্ট আপনাদের সঙ্গে ছিল মিছিলে, পদযাত্রায়, রাত দখলে। এবং তিন মাসের মাথায় সেই নাগরিকদেরই কতজন কেন আর নেই? কারা সরে গেল? কেন সরে গেল? কী কারণে বিরক্ত হল তারা? কেন ক্ষুব্ধ হল? যে ভিড় ছিল সল্টলেকের স্বাস্থ্যভবনের সামনের ধর্নামঞ্চে, সেই একই ভিড়, একই আবেগ, একই দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসা আবেগ কেন দেখা গেল না ধর্মতলায়? কারণ কী? 
সরকার এবং শাসক দল ব্যাকফুটে হয়ে গিয়েছিল। আপনারা প্রতিটি বৈঠকের পর একটি করে সিদ্ধান্তকে আপনাদের সপক্ষে আসতে দেখে উল্লসিত হয়েছেন। জয়ের আনন্দে আরও চাপ বাড়িয়েছেন। এবার ঠান্ডা মাথায় ভাবুন একক গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসা, মাত্র দু মাস আগে ২৯ আসনে জেতা, মাত্র একমাস আগে চারটি উপ নির্বাচনে জেতা এবং দুর্বল বিরোধী দল থাকা সত্ত্বেও কেন সরকার এবং শাসক দল এরকম প্রায় সব কিছুই অনায়াসে মেনে নিয়েছে? নত হওয়ার একটা বার্তা দিচ্ছে! কারণ কী? স্নায়ুর লড়াইয়ে কেন সরকারপক্ষ লাগাতার সব মেনে নেওয়ার একটি বার্তা দিয়ে চলল? কেন ছিল সেই স্ট্র্যাটেজি? সেই কৌশলে অবশেষে লাভ হল? নাকি ক্ষতি হল? কার লাভ হল? কার ক্ষতি হল? 
অরাজনৈতিক অথবা রাজনৈতিক। কোনও যুদ্ধেই নিছক আবেগ, রাগ, টার্গেট ফিক্সড করা কিংবা অন্ধ যুক্তি নিয়ে অগ্রসর হলে পরাজয় অনিবার্য। তাই প্রতিপক্ষকে দুর্বল না ভেবে শক্তিশালী ভাবুন। নিজেদের অতিরিক্ত শক্তিশালী ভাবার বদলে দুর্বলতাকে চিহ্নিত করুন। আগাগোড়া থ্রেট কালচারের বিরুদ্ধে সরব হওয়া আন্দোলন লাগাতার ব্ল্যাকমেলের আন্দোলনে পরিণত হয়ে দিশাহীনতায় প্রবেশ করল কেন? ৪৮ ঘন্টা সময় দিলাম, নয়তো এই হবে। ঘড়ি টাঙানো হল। সর্বাঙ্গীণ স্বাস্থ্য ধর্মঘট করব। এই যে গণইস্তফা দিলাম কিন্তু! এসবে কী লাভ হয়েছে? আন্দোলনের সাফল্যের দিকেই নজর রাখা উচিত ছিল। হঠাৎ জাতির অভিভাবক হতে গেলেন কেন তাঁরা? 
এবার সময় এসেছে জুনিয়র ডাক্তারদের চিন্তা করার যে, তাঁদের বুদ্ধিদাতা কারা? কারা তাঁদের আন্দোলনের পরামর্শদাতা ছিলেন? সেই পরামর্শদাতাদের নিজেদের সাফল্য কতটা? যদি দেখা যায় কোনও বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ মদত রয়েছে (যা প্রমাণিত), তাহলে আপনাদের তাদের কথায় ভেসে যাওয়ার আগে ভাবা দরকার ছিল যে, এরা তো নিজেরাই বারংবার ব্যর্থ! এরা আজ পর্যন্ত একটিও গুরুত্বপূর্ণ জনস্বার্থবাহী ইস্যুতে নাগরিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। মানুষ প্রত্যাখ্যান করছে তাদের। তাহলে ব্যর্থদের থেকে পরামর্শ নেওয়া এবং তাদের ফাঁদে পা দিয়ে আন্দোলনের রূপরেখা নির্মাণ করা কতটা বুদ্ধিমত্তা? 
জুনিয়র ডাক্তারদের সম্পর্কে একটি কথা ভুল বলা হয়। সেটি হল, তাঁদের রাজনৈতিক দাবাখেলার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আদৌ কি কথাটি সত্যি? কারণ এই ডাক্তাররা বাচ্চা ছেলেমেয়ে নাকি? তাঁরা জানে না যে, কারা তাঁদের প্ররোচনা দিচ্ছে. কারা ব্যবহার করছে, কারা তাঁদের মাধ্যমে রাজনীতির খেলা খেলছে? এটা সম্ভব যে তাঁরা না জেনেশুনেই এই আন্দোলনে প্রবেশ করেছেন? সম্ভব নয়। তাঁরাও সমানভাবে যাবতীয় সিদ্ধান্ত ও অবস্থানে যুক্ত। কেউ কাউকে বাধ্য করতে পারে না। করেওনি। 
আন্দোলনের অন্যতম দুর্বলতাই হল বিরুদ্ধ মতকে তাচ্ছিল্য করা, অপমান করা, অসম্মান করা। এবং নিম্নবর্গকে সঙ্কটের মধ্যে ঠেলে দেওয়া। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়া। যে দাবিগুলি নিয়ে এত দড়ি টানাটানি সেখানে গ্রামের প্রাইমারি হেলথ সেন্টার কিংবা ব্লক প্রাইমারি হেলথ সেন্টারে নিয়মিত আউটডোর, পরিপূর্ণ চিকিৎসা থেকে অপারেশনের পরিকাঠামো গড়ে তোলার দাবি তোলা হল না কেন? কারণ এলিট বাবুসমাজের হাততালিতে ভেসে যাওয়া এই আন্দোলন নিম্নবর্গের কথা ভাবেইনি কখনও। কেন? কারণ তাদের তারা চেনেই না। তাই তাদের কখনও ভিক্ষুক বলা হয়। কখনও অশিক্ষিত বলা হয়। কখনও চাষা বলা হয়। কখনও বোকা ভাবা হয়। 
আন্দোলনকারীদের প্রধান ভুল কী? আরবান এলিট এবং আপার মিডল ক্লাসের একাংশের মরশুমি প্রতিবাদকে বিপ্লব ভাবা!  কৃষক, শ্রমিক, মজুর এবং দৈনিক শ্রম দৈনিক আয়ের মতো ওয়ার্কিং ক্লাস ছাড়া কোনও বিপ্লব অথবা পরিবর্তন সংঘটিত হয় না! সেদিন নবান্নে যে দাবিগুলি নিয়ে আলোচনা এবং একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হল, সেটা থেকে সাড়ে ১০ কোটি সাধারণ মানুষের কী কী উপকার হল? গ্রামীণ, প্রান্তিক, ওয়ার্কিং ক্লাসের কী লাভ হল? আড়াই মাসে মিছিলে হেঁটে নাগরিকরা কী পেলেন? এই কি জাস্টিস?
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

সপরিবারে তীর্থ ভ্রমণের সম্ভাবনা, ৪৫ ঊর্ধ্বে যাঁদের সুগার ও প্রেশার আছে তাঁরা একটু বেশি সতর্ক...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৪ টাকা৮৪.৯৮ টাকা
পাউন্ড১০৬.৮৫ টাকা১১০.৬১ টাকা
ইউরো৮৯.০৪ টাকা৯২.৪৪ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা