বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

বাংলাদেশে মৌলবাদের ভয়ঙ্কর বিস্তার
মৃণালকান্তি দাস

হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে মৌলবাদের ভয়ঙ্কর বিস্তার টের পেয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ফখরুল সাহেব বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে কোনও মৌলবাদী শক্তির ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা নেই। বাংলাদেশের মানুষের শক্তির উপর আস্থা রাখি।’ আর সেই বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে হুঙ্কার ছেড়েছিলেন ‘ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করিম। শাহবাগে ছাত্র সমাবেশ ডেকে বলেছিলেন, ‘ফখরুল সাহেব, আপনি মৌলবাদী বলতে কাকে মিন করতে চান? কে মৌলবাদী? হিন্দু মৌলবাদী, খ্রিস্টান মৌলবাদী, বৌদ্ধ মৌলবাদী? না মুসলিম মৌলবাদী?’ তারপরই ফয়জুল করিম ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলে বলেছিলেন, ‘ইসলামি মৌলবাদ জিন্দাবাদ। আমরা ইসলামি মৌলবাদে বিশ্বাসী। ইসলামি মৌলবাদকে বাদ দিয়ে কেউ কোনও দিন রাজনীতি করতে পারেনি, পারবে না ইনশাআল্লা।’
সেদিন জামাতে ইসলামিকে উদ্দেশ্য করে ফয়জুল করিম প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘আজ আমি জামাতকে বলব, আপনাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ আসছে। হক্কানি ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে আপনাদের যে মতানৈক্য আছে, বসে সমাধান করুন। বিএনপির সঙ্গে আপনাদের চরম দোস্তি ছিল। একইসঙ্গে আন্দোলন, সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু আদর্শের মিল না থাকার কারণে উভয়ের প্ল্যাটফর্ম ভিন্ন হয়ে গিয়েছে। লোক দেখানো কোনও ঐক্য আমরা চাই না। ইনশাআল্লা আগামী রাষ্ট্র হবে ইসলামি রাষ্ট্র।’ ইউনুস সরকারের জমানায় এটাই বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা। দিকে দিকে মৌলবাদের ভয়ঙ্কর বিস্তার। মৌলবাদীদের সমাবেশগুলিতে নেতাদের ভাষণ শুনলে মনে হতেই পারে— তালিবানি শাসন বুঝি এসেই গিয়েছে! উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদ বাংলাদেশকে এখন গিলে খেতে চাইছে...।
প্রশ্ন হল, কীভাবে বাড়ছে মৌলবাদী চিন্তাভাবনা?
ওয়াজ মাহফিলের কথাই ধরুন। বাংলাদেশে ইসলামি সম্মেলন বা ইসলামি জনসভার রমরমা আগেও ছিল। এখন তো পোয়াবারো! বৃহস্পতিবার, শুক্রবার রাত নামলেই ছোট ছোট জেলা সদরের চারদিকে শুরু হয় ওয়াজ মাহফিল। শুরু হয় ‘আল্লার নামে শুরু করিলাম’ দিয়ে। এরপরে ধীরে ধীরে আল্লা বিদায় নেয়, ঢুকে পড়ে টাকা পয়সার আলোচনা। একটা কমিটি তৈরি করা হয়। একটা খাতায় ‘আল্লার নামে শুরু করিলাম’ লিখে শুরু হয় আয়োজন। বাজেট কত, কত টাকা আছে, মানুষের কাছ থেকে কত টাকা তুলতে হবে তা নিয়েই আলোচনা। কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়। কেউ চাঁদা তোলার দায়িত্ব নেয়। সেই চাঁদা তুলতে নামানো হয় মাদ্রাসার পড়ুয়াদের। আর কর্তা ব্যক্তিরা ছোটে বক্তা ধরতে! কনসার্টের শিল্পীদের মতো বক্তাকে ধরতে হয়। হুজুর অমুক দিন সময় দিতে হবে! হুজুরের সেদিন সময় নেই। টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব, যাতায়াতে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা ইত্যাদির পরেও যদি না আসে, তখন অন্য বক্তার পিছনে ছোটা শুরু। মাহফিলে দুই একজন সুপার স্টার মানের বক্তা লাগবেই। সুপার স্টার বক্তা কারা? যাদের ইউটিউবে ভিউ বেশি! কাদের ভিউ বেশি? যে বেশি প্রলাপ বকতে পারে! সার্চ করে দেখুন, ধর্মের নামে তাদের মিথ্যাচার শুনে তাজ্জব হয়ে যাবেন। অথচ, মানুষ হা করে শোনে। কোনও প্রতিবাদ নেই। কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই। সবাই মুগ্ধ হয়ে শোনে কাঁচা মিথ্যে কথাগুলি। আর এক পেট মোটা বক্তা, যিনি ইচ্ছে মতো মিথ্যে কথা বলবেন, বিধর্মীদের গালিগালাজ করবেন, চরম অসম্মান করে যাবেন দেশকে, ইতিহাসকে! এটাই দস্তুর...।
ইসলামি বক্তার পাশাপশি রাজনৈতিক নেতাদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়। বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা আসেন, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেন। সব মিলিয়ে যা হয় তা হল, মিথ্যার এক ধারাবাহিক বিবরণী! মাইক লাগিয়ে রাতের বেলা উচ্চস্বরে মিথ্যাচার করা! এসব নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই তথাকথিত ‘বিপ্লবী’ ছাত্রনেতাদের। ধর্মীয় মৌলবাদ বিস্তারের এমন সুযোগ মৌলবাদীরা হাতছাড়া করতে চাইবে কেন? ওয়াজ মাহফিলে বক্তা মানেই বিরাট গরম বক্তা! দফায় দফায় ভারতকে হুঁশিয়ারি। আমেরিকা, ট্রাম্প সবাইকে চোখ রাঙানো। বারবার বলেন, ‘কারো দরকার নাই, আল্লা সাথে থাকলেই চলবে!’ হুমকির সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে ইতিহাসও পড়ান। আদ্যপ্রান্ত মিথ্যাচার। বলেন, ভারতের ইতিহাস নাকি মুসলিমরা আসার পরেই শুরু। হিন্দু হচ্ছে নুহ নবীর ছেলে হিন্দের বংশ। হিন্দ থেকে হিন্দু! বক্তা হয়তো সিন্ধু নদীর নামটাই জানেন না। এরপরে সব বাদ দিয়ে মুসলিমদের আগমনের গল্প। মাঝে সব বাদ। মুসলিমদের পরে ইংরেজ শাসনের গল্প শুরু। সেই ইতিহাসের কোনও মা-বাপ নেই! ওয়াজ যাঁরা করেন তাঁরা একটা অদ্ভুত সুরে কথা বলেন। মঞ্চে উঠেই সেই সুরে কথা বলা শুরু করেন। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। কিছু একটা বলার পরেই বলে ওঠেন, ‘চিল্লায় কন ঠিক কি না! কথা বলেন, ঠিক কি না!’
বাংলাদেশে জাকির নায়েকের প্রভাব বিস্তারের পরে একটা ধারা তৈরি হয়েছে, ইংরেজি বলা! বক্তারা স্মার্ট ভাব আনার জন্য মাঝে মধ্যেই ভুলভাল ইংরেজি বলেন। ইংরেজি বলে একটা শব্দ পরে ওটাকে আবার বাংলা বলেন! এই চলতে থাকে, মানুষ ভাবে, বাপরে, কত্ত জানে হুজুর! এদিকে হুজুর গল্প বলছেন, ‘নীল আমস্ট্রং চাঁদে গিয়ে আজান শুনে এসেছিলেন! পৃথিবীতে এসে এক মসজিদে আজান শুনে মসজিদের ইমামকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এইটা কোন গান? ইমাম কইছে এইটা গান না, এইটা আজান! নীল বেচারা আর থাকতে পারে নাই, তখনই কলেমা 
পরে মুসলিম হয়ে গিয়েছে!’ এমন ডাহা মিথ্যাচার শুনতেই এইসব বক্তাকে ভাড়া করে নিয়ে যায় মানুষ! আর সরকার? 
বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জের মানুষ জেনে গিয়েছে, আওয়ামি লিগকে গালি দিতে হবে এখন। ভারতকে গালি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। আর বলতে হবে, চিল্লায় কন ঠিক কি না! একটু পরে পরে বলতে হবে কোরান শরিফে সব আছে না নাই? অমুকটা আছে না নাই? আল্লা ব্যবসাকে করেছে হালাল 
আর মানুষ সবচেয়ে বড় ব্যবসা বানিয়েছে ধর্মকে! কোনও লস নাই, লাভই লাভ শুধু!  চটপটে মিথ্যা 
কথা বলতে পারলেই হল! চোখ খুলে না পারলে 
বন্ধ করে সংখ্যালঘুদের গালি দিয়ে যেতে পারলেই চলবে এই ব্যবসা। আর এটাই ইউনুস সরকারের জমানা— যে জমানায় শুধু শেখ হাসিনা, আওয়ামি লিগ আর ভারতকে গালি দিলে সাত খুন মাফ। 
তা সে চরম মৌলবাদী হোক কিংবা হাড়হিম করা 
জঙ্গি হোক। ফ্যাসিবাদী চরিত্রের প্রাথমিক শর্তগুলি কখন যে ইউনুস সরকারের রক্তে মিশে যাচ্ছে তা হয়তো টেরও পাচ্ছেন না সোহরাব হাসান, আলি রিয়াজ, সারফুদ্দিন আহমেদের মতো বিশিষ্ট সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা।
একসময় ডিসেম্বর মাস এলে আগে রাজাকারদের শরীরে জ্বালা ধরে যেত। আর এবার দেখা গিয়েছে, খোদ ইউনুস সরকারের শরীরে জ্বালা ধরে গিয়েছে। যত ভাবে পেরেছে চেষ্টা করেছে মুক্তিযুদ্ধকে সরিয়ে ২৪-এর জুলাই আন্দোলনকে সামনে আনার। সংসদ ভবনে ‘বিজয় দিবস’ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন কেমন হয়েছে জানেন? সেখানে মুক্তিযুদ্ধের ঠাঁই হয়নি, ২০২৪ সালের আন্দোলনের স্লোগান, গ্রাফিতি প্রদর্শনীতে ভরা! এখন ‘জয় বাংলা’ বললে যে কেউ রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় আটকে পড়তে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের কথা বললে ‘ভারতের দালাল’ বলে ট্যাগ আটকে দেওয়া হয়। সংখ্যালঘুর নিরাপত্তার কথা বললে আপনার গায়ে হিন্দুত্ববাদের সমর্থক, বিধর্মী, নাস্তিক ট্যাগ লেগে যাবে।
বাংলাদেশের প্রবীণ লেখক-গবেষক বদরুদ্দীন উমর ঠিকই বলেছেন, ‘আজ বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে দেখুন, জ্ঞানের চর্চা বলে কিছু নেই।’ সহজেই মানুষকে ধর্ম দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে। সঙ্গে ভারত বিরোধিতার প্রবল ঝড়। হিন্দুরাই সব ঝামেলার উৎস, আওয়ামি লিগের পক্ষে কাজ করে যাচ্ছে— এমন সব কথা দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে সব ব্যর্থতা। এদিকে আরাকান আর্মি মায়ানমার বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলের দখল নিয়ে নিয়েছে, নাফ নদীতে নৌকা চলতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে! কেউ এটা নিয়ে লং মার্চও করে না, কেউ গরম গরম কথাও বলে না। কোনও প্রাক্তন আর্মি অফিসারকেও দেখা যায়নি রাস্তায় মিছিল করতে, যিনি চারদিনেই আরাকান আর্মির ঘর দখল করে ফেলার হুঙ্কার দিতে পারেন! অথচ, এটাই এখন বাংলাদেশের বাস্তব সমস্যা, ভয়ঙ্কর সমস্যা। এদিকে কলকাতা চারদিনে দখল করে ফেলতে রোজ ফেসবুকজুড়ে মৌলবাদী নেতা মুফতি কাজি ইব্রাহিমদের পোস্ট। হিপোক্রেসিরও তো একটা সীমা থাকা দরকার!
সম্প্রতি ভারতের ১১ পাতার অভ্যন্তরীণ সমীক্ষা রিপোর্টে (‘উত্তেজনা থেকে সন্ত্রাস— বাংলাদেশে মৌলবাদের ঢেউ’) বলা হয়েছে, ‘যেভাবে বাংলাদেশে ঘটনার গতি এগোচ্ছে, তাতে খুব বেশি সংশয় থাকার কথা নয় যে, বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন চরমপন্থী মৌলবাদী ইসলামিক সংগঠনের প্রভাব বাড়ছে। গোটা দেশের বিভিন্ন জায়গায় অল্পবয়সিরা যেভাবে হিংসার চরমপন্থা নিয়ে চলছে, তা দেখছে গোটা বিশ্ব।’ রিপোর্টের বক্তব্য, লুটপাটের প্রবণতা, শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ভাবে কলকাঠি নাড়া, সমাজমাধ্যমকে চরমপন্থী করে তোলা এবং জঙ্গি সংগঠনগুলির উত্থানের কারণে একদিকে যেমন দেশের বহুত্ববাদী পরিচয়কে চাপের মধ্যে ফেলেছে, তেমনই আগামী দিনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক সুস্থিতিকে ভিতর থেকে ক্ষয় করছে। ক্ষমতার হাত বদলের পর মৌলবাদী ইসলামিক সংগঠনগুলি বাংলাদেশের সমাজ এবং প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব কায়েম করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশকে মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রাথমিক অস্ত্র হল ধর্ম। আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় থাকার সময়ও সে দেশের বহুত্ববাদী পরিচয় এবং বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রবল প্রভাব থাকা মোল্লাতন্ত্রের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছে। সেই মোল্লাতন্ত্রই এখন চোখ রাঙাচ্ছে...।
খুব জানতে ইচ্ছে করে, ইউনুসের সরকার বাংলাদেশকে আসলে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? 
24d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পেশাগত উচ্চশিক্ষায় দিনটি বিশেষ শুভ। ধৈর্য ধরে মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন সাফল্য পাবেন। অর্থ ও...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৪৮ টাকা৮৭.২২ টাকা
পাউন্ড১০৫.০৯ টাকা১০৮.৮১ টাকা
ইউরো৮৮.৪৭ টাকা৯১.৮৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
25th     January,   2025
দিন পঞ্জিকা