ভারতের সংবিধান গ্রহণের ৭৫তম বার্ষিকী আমরা উদযাপন করেছি ২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর। সংবিধানের ৭৫ বছরের যাত্রাকে স্মরণ করার জন্য সংসদের দুটি কক্ষই তাদের নিয়মিত কার্যাবলির বাইরে দুটি দিন আন্তরিকতার সঙ্গেই উৎসর্গ করেছিল। ভালো এবং মন্দ দু’রকম ভাষণই শোনা গিয়েছে তখন। কিন্তু সেগুলির কোনোটিই আগামী ৭৫ বছর মনের রাখার মতো হয়ে উঠেত পারেনি, যেমন ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ আগস্ট জওহরলাল নেহরুর ‘আ ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ কিংবা ১৯৪৯ সালের ২৫ নভেম্বর সংবিধান পরিষদে বাবাসাহেব আম্বেদকরের ‘গভর্নমেন্ট বাই দ্য পিপল’ ভাষণ থেকে পাওয়া গিয়েছিল।
৭৫ বছর আগে, কংগ্রেস দলই ছিল গণপরিষদের আলোচনার মূল চালিকাশক্তি। গণপরিষদে ‘সংহতি ও শৃঙ্খলা’ নিয়ে আসার জন্য ডঃ আম্বেদকর কংগ্রেসকে সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। আজ, কংগ্রেস লোকসভা এবং রাজ্যসভায় বিরোধী বেঞ্চে বসে। এটি ভাগ্যের একটি বেদনাদায়ক পরিবর্তন কিন্তু অপরিবর্তনীয় নয়।
বিজেপির ইমার্জেন্সি অবসেশন
কংগ্রেস-বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরে, বিশেষ করে বিজেপি ও ডানপন্থী শক্তিগুলির ধারণায় সংবিধানের সঙ্গে কংগ্রেসের যোগ ছিল জরুরি অবস্থা (১৯৭৫ সালের জুন থেকে মার্চ ১৯৭৭ সাল) এবং নাগরিকের মৌলিক অধিকার হরণ করার সঙ্গে। নিঃসন্দেহে, কংগ্রেসের ১৩৯ বছরের ইতিহাসে এটি একটি জঘন্য অধ্যায় গিয়েছে, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন এবং অঙ্গীকার করেছিলেন যে জরুরি অবস্থার পুনরাবৃত্তি আর কখনোই হবে না। ভারতবাসী ইন্দিরাজিকে
ক্ষমাও করেছিল এবং তাঁকে ও কংগ্রেসকে ১৯৮০ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল দেশের ক্ষমতায়।
সংবিধান প্রণয়ন ও সংবিধানকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে কি কংগ্রেসের আর কোনও অবদান নেই? আছে, এবং সেই অনুপ্রেরণামূলক কাহিনি খুব কমই শোনানো হয়। সংবিধান সংশোধন করার জন্য সংসদকে ক্ষমতা দিয়েছে সংবিধানের ৩৬৮ নম্বর অনুচ্ছেদ। যেকোনও দেশের সংবিধানে এই প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেওয়া থাকে। কেননা একটি জাতি পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হয়। একটি জাতির সামনে নতুন নতুন হুমকি উপস্থিত হয় এবং নতুন সুযোগেরও সম্মুখীন হয় দেশ। বিভিন্ন মামলার শুনানিতে বিচারপতিরা সংবিধানের ব্যাখ্যা এবং পুনঃব্যাখ্যাও করে থাকেন। সংবিধান এমন একটি জীবন্ত দলিল, জাতির পরিবর্তিত জীবনের সঙ্গে তাকে খাপ খাইয়ে চলতে হয়।
সংশোধনীগুলি সংবিধানকে শক্তিশালী করেছে
বিতর্কে অংশ নিলে, কংগ্রেস সরকারগুলি সংবিধানের যেসব সংশোধনী এনেছিল আমি সেসবের কথাই স্মরণ করতাম। কেননা, ওই পদক্ষেপগুলি আসলে সংবিধানকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি সংবিধানের প্রস্তাবনায় নির্ধারিত মহান লক্ষ্যগুলিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার এবং মর্যাদা ও সুযোগের সমতার দিকগুলি।
সংবিধান (প্রথম সংশোধন) আইন, ১৯৫১ ছিল একটি মৌলিক আইন। তার দ্বারা, নাগরিকদের
মধ্যে যারা সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে অনগ্রসর শ্রেণি বা যারা তফসিলি জাতি ও জনজাতির অন্তর্গত, তাদের অগ্রগতির জন্য সংরক্ষণকে সাংবিধানিকভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছিল। প্রথম সংশোধনীটি করা না-হলে সংরক্ষণের সম্পূর্ণ কাঠামোটি দাঁড় করানো যেত না।
প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৩১-এ এবং ৩১-বি যুক্ত করা হয়। এই ব্যবস্থা আসার ফলেই অত্যাচারী, সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পথ প্রশস্ত হয়েছিল। ওই ব্যবস্থা মুক্তি দিয়েছিল লক্ষ লক্ষ কৃষক ও খেতমজুরকেও। ভূমি সংস্কার এবং জমি বণ্টন প্রক্রিয়াও সহজতর করেছিল ওই ব্যবস্থা।
প্রথম সংশোধনীটি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠার আইনি ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। নাগরিকের সম্পূর্ণ বা আংশিক ক্ষেত্র বাদে—যেকোনও বাণিজ্য, শিল্প, ব্যবসা বা পরিষেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারি ক্ষেত্রকে আইনি পরিসর দিয়েছিল ওই সংশোধনী।
সংবিধানে অনেক পরিবর্তন ঘটানোর কারণে সংবিধান (৪২তম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৬ বিশেষভাবে সমালোচিত হয়েছিল। যাই হোক, এতে যে-দুটি পরিবর্তন করা হয়েছিল, উত্তর প্রজন্ম তা মনে রাখবে বলে কেউ ভাবে না। তার মধ্যে প্রথমটি ছিল ৩৯-এ অনুচ্ছেদের সন্নিবেশ। সবার জন্য সমান ন্যায়বিচার নিশ্চিত ব্যাপারে এটির মাধ্যমে ‘বিনামূল্যে আইনি সহায়তা প্রদান’ করতে রাষ্ট্রকে আইনত
বাধ্য করা হয়। অন্যটি ছিল ৪৮-এ অনুচ্ছেদের সন্নিবেশ। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা ও তার উন্নয়ন এবং বন ও বন্যপ্রাণ রক্ষা রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
সংবিধান (৫২তম সংশোধনী) আইন, ১৯৮৫-র মাধ্যমে সংবিধানের দশম তফসিলটি প্রবর্তিত হয়েছিল। এটাই ছিল আয়ারাম-গয়ারাম বা দলত্যাগের মতো ক্রনিক সমস্যা মোকাবিলার প্রথম প্রচেষ্টা। ওই আইন, দুঃখজনকভাবে, নির্বাচিত বিধায়কদের ধূর্তামি কিংবা স্পিকারদের যোগসাজশ অথবা আদালতের বিভ্রান্তিকর রায়ের কথা মাথায় রাখেনি। দশম তফসিলের উদ্দেশ্য সফল করতে হলে ওই তফসিলের ফের সংশোধনই জরুরি।
তবে সংবিধানের সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী সংশোধনী ছিল—সংবিধান (৭৩তম সংশোধন) আইন, ১৯৯২ এবং সংবিধান (৭৪তম সংশোধন) আইন, ১৯৯২। এই দুটির মাধ্যমে পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলির জন্য পৃথক বিধান তৈরি হয়েছিল। গণতন্ত্র আরও গভীর ও শক্তিশালী হয়েছিল তার দ্বারা। এইভাবে লক্ষ লক্ষ নারী এবং তফসিলি জাতি ও জনজাতির সদস্যকে রাজনৈতিক মূলধারায় আনা সম্ভব হয়েছে। গণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেওয়া গিয়েছে তাঁদের। ক্ষমতা হস্তান্তর এবং পুনঃবণ্টনের এত বড় দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর নেই।
উভয় কক্ষে যে বিতর্ক, তা দুর্ভাগ্যবশত ছিল অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের। এই বিতর্কে সংবিধানের ৭৫ বছরের যাত্রায় একমাত্র বিকৃতিটির উপর গুরুত্ব আরোপের ব্যাপারটি সত্যিই দুঃখজনক। এক জাতি এক নির্বাচন এবং বিজেপির অন্যান্য মতলবি পরিবর্তনগুলি আরও খারাপ। ওইসব পরিবর্তনের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে গণতন্ত্র এবং ফেডারেলিজম বা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করার বীজ। যাই হোক, আমি নিশ্চিত যে সংবিধানের মজবুত মেরুদণ্ড এবং এর শক্তিশালী ও প্রগতিশীল চেতনাই শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে।
• লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত