বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
বিশেষ নিবন্ধ

কাজ ও প্রচারের নিরিখে মোদি বনাম মনমোহন
সন্দীপন বিশ্বাস

আপনারে বড় বলে, বড় সেই নয়, / লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়। কোন বালক বয়সে পড়া ‘বড় কে’ নামের এই কবিতার লাইনটি আজও মানুষ ভুলে যাননি। অনেকে সেই কবির নামই জানেন না বা ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু লাইন দু’টির মধ্যে যে ঘোর বাস্তবতা রয়েছে, সেটা আমরা মাঝে মাঝেই টের পাই। অর্থাৎ এই পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষই আছেন। একদল 
মানুষ কাজের থেকে বাজনা বাজান বেশি। ‘হ্যান করেঙ্গা, ত্যান করেঙ্গা’ বলে বাজার গরম করে প্রচারের আলো শুষে নিয়ে হাততালি কুড়োন। আর একদল নিঃশব্দে কাজের কাজ করে ফেলেন। তাঁরা প্রচারের বা হাততালির তোয়াক্কা করেন না। 
আমাদের দেশের পরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর তুল্যমূল্য বিচার করলে কবি হরিশচন্দ্র মিত্রের এই কবিতার লাইন দু’টি মনে আসবেই। 
দুই প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান রেখেছেন। প্রায় প্রশ্ন ওঠে— কে বড় প্রধানমন্ত্রী, মনমোহন না মোদি?  সম্প্রতি এই বিতর্কটা উস্কে দিয়েছেন জার্মানির প্রাক্তন চ্যান্সেলার অ্যাঞ্জেলা মার্কেল। তিনি ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীকেই খুব কাছ থেকে দেখেছেন। কূটনৈতিক সম্পর্কের বাইরেও তাঁদের যে মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি, দেশ গঠনের রীতি, তা নিয়েও তাঁদের আলোচনা হয়েছে। সেখান থেকে মার্কেল একটা বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর সাম্প্রতিক ‘ফ্রিডম: মেমোয়ার্স ১৯৫১-২০২১’ বইতে। বিশ্লেষণটাকে তিনি একেবারে ভিতরের দিক থেকে ধরতে পেরেছেন। মনমোহন সম্পর্কে মার্কেল লিখেছেন, ‘তিনি অত্যন্ত দূরদর্শী। দেশকে কী করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় তিনি জানেন। সেই সঙ্গে তিনি উদার অর্থনীতির জনক। আধার, একশো দিনের কাজ সব তাঁর হাত ধরেই এসেছে। তাঁর কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা আছে।’ আবার মোদি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘উনি প্রচারসর্বস্বতায় বিশ্বাসী। আলোচনায় উনি তাঁর নির্বাচনী প্রচারের কৌশল নিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। আমার মনে হয়েছে, মনমোহন সিং কাজই করে গেছেন, মার্কেটিং নয়।’ এটাকেই মোদি বনাম মনমোহনের মার্কশিট বলে বিবেচনা করা যেতেই পারে।      
হ্যাঁ, প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দু’জনের মধ্যে অসংখ্য পার্থক্য রয়েছে। একজনের ভাবনার মধ্যে ছিলেন বর্ণ, ধর্ম, জাত, কুল নির্বিশেষে দেশের মানুষ। আর একজন হতে চান বিজেপি পন্থী হিন্দুদের প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকায় কাজের মধ্যে ফারাক আসা অনিবার্য। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশগঠনের সময় মনমোহনের ভাবনার মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ ভীষণভাবে কার্যকর ছিল। গান্ধীজি বলেছিলেন, ‘সমস্ত দিক থেকে আমার ঘরে হাওয়া আসুক। কিন্তু সেই হাওয়া যেন আমাকে দিগভ্রষ্ট করতে না পারে।’ মনমোহন চেয়েছিলেন দেশের প্রতিটি মানুষের ঘরে সেই ‘হাওয়া’ পৌঁছে দিতে। একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, একজন পণ্ডিত মানুষ হিসাবে তিনি বুঝেছিলেন, উন্নয়নের প্রথম শর্ত হল, অর্থনীতির চাকাকে সক্রিয় রাখা। সেই কারণে তিনি চালু করেছিলেন একশো দিনের কাজ। মানুষের কাজের অধিকারকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের রোজগার নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন। তাই সেই প্রকল্প দেশের অর্থনীতিতে জোয়ার এনেছিল। আর মোদি এসে সেই বিকাশের অস্ত্রে বিভেদের শান দিয়ে বসলেন। শুরু করলেন, আমরা বনাম তোমরার রাজনীতি। বারবার বুঝিয়ে দিলেন— বশংবদ হও, নাহলে তোমাদের ভাতে মারব। 
ভারতীয় অর্থনীতির একজন বড় জাদুকর হিসাবে মনমোহনের ধারে কাছে আমরা কাউকে ভাবতেই পারি না, তুলনা তো দূরের কথা। ভারতীয় অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে তাকে শক্তিশালী করার কাজ তিনি শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও এক দশক আগে। ১৯৯১ সালে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার মতো। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও বুঝেছিলেন, এ দেশে আছেন একমাত্র মানুষ, যিনি এই ডুবন্ত সময়ে দেশকে পুনরুদ্ধার করতে পারেন। তাই তিনি মনমোহনকে নিয়ে এসে দায়িত্ব দিলেন দেশের অর্থমন্ত্রীর। লাইসেন্স রাজ প্রথা তুলে দিয়ে দেশের বাণিজ্যে মনমোহন নিয়ে এলেন এক মুক্ত হাওয়া। বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে গেল হু হু করে। দেশের বিদেশি মুদ্রাভাণ্ডার আবার চাঙ্গা হয়ে উঠল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও সেই অর্থনীতি উন্নতির পথে ছুটেছে তাঁরই নেতৃত্বে। ২০০৭ সালে ভারতের জিডিপি দাঁড়ায় ৯ শতাংশে। তখন বিশ্বের দ্রুততম অর্থনৈতিক বিকাশের তালিকায় ভারতের স্থান ছিল দ্বিতীয়।
বিপরীত দিকে মোদি হেট স্পিচের মাধ্যমে দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছেন। দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি গোধরা মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। এজন্য মনমোহন সিং মোদির তীব্র সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘মোদিজিই প্রথম  প্রধানমন্ত্রী, যিনি পদের মর্যাদাকে এভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। সেই সঙ্গে পরিকল্পনাহীন এক ব্যবস্থা দেশকে ভয়ঙ্কর পথে পরিচালিত করছে।’
তবুও বারবার ‘আচ্ছে দিন’এর কথা বলে মোদিজি প্রমাণ করতে চাইছেন, তিনি দেশকে ‘আচ্ছে দিনের’ মধ্যে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু সেই ‘আচ্ছে দিন’ আসলে একটা হরর মুভি। একবার মোদি ক্যাবিনেটের মন্ত্রী  নীতিন গাদকারি বলেছিলেন, ‘এই যে আচ্ছে দিন শব্দটি মোদি ব্যবহার করেন, সেটি প্রথম ব্যবহার করেছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং।’ সুতরাং শব্দটা তাঁর ধার করা।
মনমোহন সিংয়ের আমলে চালু হয়েছিল আরটিআই বা দেশের সাধারণ মানুষের তথ্য জানার অধিকার। সরকারি কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা আনাই ছিল এর উদ্দেশ্য। কিন্তু মোদির আমলে তার অনেকটাই অস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। আসলে আরটিআইতে জমা পড়া বেশ কিছু প্রশ্ন মোদিকে অপ্রস্তুতে ফেলে দিয়েছিল। যেমন, দিল্লির এক বাসিন্দা দেখতে চেয়েছিলেন মোদির শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজপত্র। এছাড়া নোট বাতিল সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেকেই সরকারের কাছে নানা প্রশ্ন করেও উত্তর পাননি। আধার সংক্রান্ত ব্যাপারে নাগরিকদের গোপন তথ্য সরকার গোপন রাখতে পারছে না। বহু ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের গোপন নথি অন্যের কাছে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ উজ্জ্বলা গ্যাসের সংযোগ নিয়েও আরটিআই করেছেন। এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত জবাব মেলেনি। এখন আরটিআই নিয়ে কোনও বিতর্কিত প্রশ্ন এলেই সরকার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে তাদের কাছে কোনও নথি নেই। এমনকী কোভিডকালে কত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাও সরকার জানাতে অক্ষম। নির্বাচনী বন্ড থেকে প্রাপ্য টাকার ব্যাপার লুকোছাপা করতে চেয়েছিল সরকার। সুতরাং সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে বিরাট প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
সম্প্রতি একটি নিবন্ধে ভারতীয় গণতন্ত্রের মুমূর্ষু অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের মধ্য থেকে জেগে উঠছে একটা স্বৈরতান্ত্রিক অবয়ব। সেখানে প্রধান হয়ে উঠছে বিদ্বেষ, হিংসা, বৈষম্য, উস্কানি। সর্বত্র ‘গোলি মারো শালোকো’র প্রচ্ছন্ন হুঙ্কার গণতন্ত্রকে ঠেলে দিচ্ছে গঙ্গাযাত্রার দিকে। আসলে মোদি সরকার দেশকে দু’টি ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন। বিজেপি, অবিজেপি। অবিজেপি হলেই নানাভাবে তাকে অতিষ্ঠ করে তোলার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। নানা অজুহাতে পশ্চিমবঙ্গকে ভাতে মারার চেষ্টা করে চলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। তার কারণ সুস্থ মানসিকতার বাঙালি মোদিজির নীতি ও মানসিকতাকে পছন্দ করেন না। তাই আক্রোশে বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ মোদি নিজের গদি বাঁচাতে অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহারকে ঢেলে টাকা দিচ্ছেন। সুযোগ বুঝে চন্দ্রবাবু নাইডু ও নীতীশ কুমার দুয়ে নিচ্ছেন।  এটা গণতন্ত্র নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এভাবে বঞ্চনা করা যায় না। কিন্তু সবক্ষেত্রে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষিত হচ্ছে না।  
দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা বারবার বলছেন, কেন দীর্ঘদিন নিয়োগ বন্ধ? কেন রেল অপুষ্টিতে আক্রান্ত? কেন দিনের পর দিন সরকারের ঋণের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে? কেন সরকারকে সব বেচে কোষাগার ভরার দিকে যেতে হচ্ছে? এত বক্তৃতা, এত নিজেকে জাহির করা, নিজেকে অবতার সাজানো বা অন্যদের নানাভাবে অপমানিত করার মধ্যে অন্তত সুস্থ সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় না। এর পাশে মনমোহন সিং সত্যিই বেমানান। তাঁর শিক্ষা কখনও তাঁকে পাল্টা ঢিল মারতে প্রবৃত্ত করেনি। একদিকে মাসের পর মাস মন কি বাতের অসারতা, অন্যদিকে আত্মপ্রচার, সেই সঙ্গে বিদেশভ্রমণ। এর মধ্যেই ডুবে আছেন মোদি। এই আত্মপ্রচারের পাশে মনমোহন সিং সত্যিই বেমানান। বিজেপি নেতারা তাঁকে ‘মৌনী’ বলে কটাক্ষ করেন। উত্তরে মনমোহন বলেন, ‘আমার নীরবতার উত্তর থাকে আমার কাজের মধ্য দিয়ে।’ চাণক্য শ্লোকেই আছে, ‘স্বদেশে পূজ্যতে রাজা, বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’। মোদি ও মনমোহনের মধ্যে এই পার্থক্যটুকু চিরকাল থেকেই যাবে।
মোদি এবং মনমোহনের তুল্যমূল্য বিচার ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। দেশে শুরু হয়েছিল আগেই। এখন বিদেশেও শুরু হয়েছে। প্রাক্তন রাষ্ট্রনায়করা তাঁদের স্মৃতিকথায় এসব নিয়ে লিখতে শুরু করে দিয়েছেন। সেসব ক্রমশ প্রকাশ্য। ক্ষমতা থেকে যেদিন মোদি সরে যাবেন, তারপর থেকেই সমালোচনায় আরও বাড়বে। ইতিহাস বড় নির্মম ও নিরপেক্ষ! ‘গুণেতে হইলে বড়, বড় বলে সবে / বড় যদি হতে চাও, ছোট হও তবে।’
1Month ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

স্ত্রীর  শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে হঠাৎ সমস্যায় মানসিক চিন্তা ও উদ্বেগ। কাজকর্ম কমবেশি এগবে। অতিরিক্ত পরিশ্রমে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৫৩ টাকা৮৭.২৭ টাকা
পাউন্ড১০৩.৬৪ টাকা১০৭.৩২ টাকা
ইউরো৮৭.৩১ টাকা৯০.৬৬ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা