যদি প্রশ্ন করা হয়, এ রাজ্যের সদ্য সমাপ্ত উপ নির্বাচনের ফল কী প্রমাণ করল? প্রায় সকলের বক্তব্য মোটামুটি এরকম হবে, আর জি কর কাণ্ড সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনও প্রভাবই ফেলেনি। বাংলাদেশের ধার করা ‘দফা এক দাবি এক’ স্লোগানে তেমন কেউ সাড়া দেননি। এই অভিমত একশো শতাংশ সত্যি। তারপরেও একটা কথা বলতেই হবে, এবারের উপ নির্বাচন বুঝিয়ে দিল, শুধু অন্যের দিকে আঙুল তুলে ভোটে জেতা যাবে না। ক্ষমতায় থাকতে গেলে বা সরকার গড়তে গেলে কাজ করতে হবে। মোদ্দা কথা, নেগেটিভ ভোটের জোরে বাংলায় কিস্তিমাতের দিন শেষ।
যেকোনও উপ নির্বাচনে রাজ্যের শাসকদল অ্যাডভান্টেজ পায়। সেই অঙ্কে রাজ্যের পাঁচটি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের জয় নিয়ে কারও সংশয় ছিল না। কিন্তু মাদারিহাট নিয়ে সকলের বিশেষ কৌতূহল ছিল। কারণটা খুব স্পষ্ট। এই আসনে তৃণমূল কংগ্রেস আগে কোনও দিন জেতেনি। মাদারিহাট বিধানসভা কেন্দ্র ও আলিপুরদুয়ার লোকসভা আসনটি দীর্ঘদিন বিজেপির দখলে। তাই মাদারিহাট নিয়ে বিজেপি তো বটেই, অন্য বিরোধী দলগুলিও আশাবাদী ছিল। মাদারিহাটে জিতলে বিজেপি ছাব্বিশের নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলকে লড়াইয়ের সামনে দাঁড় করাতে পারত। সেই অঙ্কেই বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস প্রার্থী দিলেও সেভাবে লড়াইয়ে ছিল না। তাই প্রতিষ্ঠিত দুই দলের চেয়েও নির্দল প্রার্থী ভোট পেয়েছেন অনেকটাই বেশি।
মাদারিহাটি কেন্দ্রের ভোট বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, এক দশক ধরে যেসব চা-বাগান এলাকা বিজেপির গড় বলে পরিচিত ছিল, সেখানেও তারা হেরেছে। লোকসভা নির্বাচনে বিন্নাগুড়ি ও সাঁকোয়াঝোরা-১ পঞ্চায়েত এলাকা থেকে বিজেপি প্রায় সাড়ে সাত হাজার ভোটে এগিয়েছিল। উপ নির্বাচনে সেই ঘাটতি মিটিয়ে তিন হাজারেরও বেশি ভোটে এগিয়ে গিয়েছে তৃণমূল। একই ঘটনা ঘটেছে আলিপুরদুয়ার জেলার অন্তর্গত বেশ কিছু চা-বাগান এলাকায়। এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি হল, মাত্র কয়েক মাসে এতটা ভোট স্যুইং করল কেন? চা-বাগানগুলিতে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন কি খুব ভালো কাজ করছে, নাকি বিজেপির উপর মানুষ বিরক্ত? তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের কাজে শ্রমিকরা খুশি, এমন দাবি করলে তা হবে সত্যের অপলাপ। বরং বহু ক্ষেত্রে স্থানীয় এবং রাজ্যের কিছু শ্রমিক নেতার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্যই শোনা গিয়েছে। তারপরেও তৃণমূলকে এলাকার মানুষ ঢেলে ভোট দিল। কেন?
নির্বাচনের কয়েকদিন আগে মাদারিহাট ঘোরার সময় একটা কথা অনেকেই বলেছিলেন, ‘কয়েকবার বিজেপিকে তো ভোট দিলাম। কিন্তু উন্নয়ন কিছুই হল না। এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভোট দিয়ে দেখা যাক না কী হয়!’ উপ নির্বাচনে প্রমাণ হয়েছে, এলাকার মানুষ উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে ভোট দিয়েছে। মানুষ মনে করেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থী জিতলে চা-বাগান এলাকার সার্বিক উন্নতি হবে। কিন্তু বিজেপিকে ভোট দিলে শুনতে হবে সেই একই কথা, ‘ওরা আমাদের কাজ করতে দিচ্ছে না।’
তাই মাদারিহাটের জয় তৃণমূলকে যেমন একদিকে স্বস্তি দিয়েছে, তেমনই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। কী সেই চ্যালেঞ্জ? উন্নয়নের। তৃণমূল নেতৃত্ব উন্নয়নকে পাখির চোখ করলে আগামী দিনে তার প্রভাব শুধু মাদারিহাটে নয়, আলিপুরদুয়ার এবং জলপাইগুড়ি জেলার বাকি আসনেও পড়বে। মাদারিহাট যে সুযোগ দিয়েছে তা কাজে লাগাতে পারলে উত্তরবঙ্গকে নিয়ে তৃণমূলের দুশ্চিন্তার পারদ পৌষের চেয়েও দ্রুত নামবে। কোনও ‘পশ্চিমী ঝঞ্ঝা’ তার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। স্তিমিত হবে বাংলা থেকে উত্তরবঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করার ‘গেরুয়া হুঙ্কার’। তবে মাদারিহাটকে উত্তরবঙ্গের ‘গেম চেঞ্জার’ বানানোর জন্য তৃণমূলের হাতে খুব একটা সময় নেই। বড়জোর বছর খানেক। কোনও দলের ভোটবৃদ্ধি অবশ্যই সেই দলের উপর মানুষের আস্থার লক্ষণ। একইসঙ্গে তা বিরোধী শিবিরের প্রতি অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। উপ নির্বাচনে প্রতিটি আসনে তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট বেড়েছে এবং বিজেপির ভোট কমেছে। আড়াই থেকে প্রায় ২৭ শতাংশ পর্যন্ত। একে কমছে বললে কমিয়ে বলা হয়, ধস নেমেছে বলাই ভালো।
এ রাজ্যের শাসক বিরোধীরা ভোট দেওয়ার আগে দেখেন, কাকে সমর্থন দিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চাপে পড়বেন। সেই অঙ্ক কষেই তাঁরা ভোট দেন। তারজন্যই মমতা বিরোধী বাম ভোট কখনও রামে যায়। আবার রামের ভোট বামে ফেরে। কিন্তু এবার সেই অঙ্ক মেনে ভোট স্যুইং করেনি। উপ নির্বাচনে বিজেপির ভোটে ব্যাপক ধস নামলেও তা বামে ফেরেনি। উল্টে অনেকটাই গিয়েছে তৃণমূলে। ব্যতিক্রম বাঁকুড়ার তালডাংরা। এখানে বিজেপির কিছু ভোট বামে ফিরেছে। কংগ্রেসের সঙ্গ ছাড়াই সিপিএম লোকসভার চেয়ে প্রায় তিন হাজার ভোট বাড়িয়ে নিয়েছে। তবে, অধিকাংশ জায়গায় বিজেপির এমনকী, কিছু এলাকায় বাম ও কংগ্রেসের ভোটও তৃণমূলে গিয়েছে। এ রাজ্যে ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর’ কমছে অথবা তার সুযোগ বিরোধীরা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
এবারের উপ নির্বাচনের ফলাফলে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তাঁদের মতে, ২০১৯ সাল থেকে বিজেপি এ রাজ্যে ‘নেগেটিভ ভোটে’র ফায়দা তুলছে। কেন্দ্রের ক্ষমতায় থাকলেও বাংলার মানুষের জন্য আলাদাভাবে কিছুই করেনি। স্রেফ তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলে বিজেপি এ রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল। নেগেটিভ ভোটের সৌজন্যে বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক যত পুষ্ট হয়েছে বাংলার প্রতি গেরুয়া আগ্রাসন ততই তীব্র হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে শুধু তৃণমূলের নেতা, মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বন্ধ করে দিয়েছে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্প। তাতে বাংলার অর্থনীতি দুর্বল হলেও মনোবলে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। উল্টে বিজেপিকে জবাব দেওয়ার ইচ্ছা আরও দৃঢ় হয়েছে।
আন্দোলনের সিঁড়ি ভেঙে নবান্নে পৌঁছেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানেন, শুকনো কথায় যেমন চিঁড়ে ভেজে না, তেমনই শুধু স্লোগানে ভরে না ক্ষুধার্ত মানুষের পেট। তাই আগে করেছেন গরিবের পেট ভরানোর ব্যবস্থা। প্রান্তিক মানুষরা যাতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তারজন্য নিয়েছেন বিভিন্ন কর্মসূচি। ঘোষণা করেছেন একগুচ্ছ সামাজিক প্রকল্প। তাতে বিরোধীদের পায়ের তলার মাটি আলগা হয়নি, একেবারে ধসে গিয়েছে। সেটা বুঝেই জনপ্রিয় প্রকল্পগুলিকে বিরোধীরা কখনও ‘ভিক্ষে’, কখনও ‘ডোল পলিটিক্স’ বলে কটাক্ষ করেছে। এখন বিজেপি সেই নীতিকেই আঁকড়ে ধরছে। এই মুহূর্তে মমতার চালু করা কর্মসূচির সুফল পায় না এমন পরিবার গ্রামবাংলায় তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। অবশ্য যাঁরা কট্টর মমতা বিরোধী তাঁরা ‘এটা তৃণমূলের নয়, সরকারের টাকা’ এই বলে ‘গঙ্গাজলে’ শুদ্ধ করে প্রকল্পের সুবিধা নেন। দল, মত, ধর্ম নির্বিশেষে প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার বেনিফিট তৃণমূল পাচ্ছে। যাঁরা পারিবারিক রাজনৈতিক ঐতিহ্য এবং অভ্যাসের কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী ছিলেন তাঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে ‘পজিটিভ ভোটে’র শরিক হচ্ছেন। সেই কারণে বিজেপির ভোট কমার আনুপাতিক হারে তৃণমূলের ভোট না বাড়লেও ভোটব্যাঙ্ক দিন দিন স্ফীত হচ্ছে।
অনেকেই বলছেন, উপ নির্বাচনে মানুষের এই রায়কে হালকা চালে নিলে বিরোধীদের পস্তাতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনে বামেরা যেভাবে জামানত খুইয়ে চলার ট্র্যাডিশন বজায় রেখে চলেছে তাতে সিপিএমের নতুন করে হারানোর কিছু নেই। ‘সর্বহারা’র দল এখন সব হারিয়ে নিঃস্ব। তবে, বিজেপির সামনে শুধরে নেওয়ার সময় এবং সুযোগ এখনও আছে। তারজন্য অতি দ্রুত চালু করতে হবে ১০০ দিনের কাজ। কারণ পেটে লাথি পড়লে কেউই ছেড়ে কথা বলে না। আবাস যোজনার টাকা মিটিয়ে দিয়ে বিজেপি প্রমাণ করুক, বাংলা ও বাঙালির প্রতি তাদের বিদ্বেষ নেই। ভোটের ফল প্রকাশের পর মেদিনীপুরের পরাজিত বিজেপি প্রার্থীও প্রচারে গিয়ে এনিয়ে বারবার ক্ষোভের মুখে পড়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনিও চান, অবিলম্বে টাকা দেওয়া হোক। প্রয়োজনে কেন্দ্র মনিটরিং করুক।
এই উপ নির্বাচনকে ছাব্বিশের মহারণের আগে ‘সেমিফাইনাল’ বলে মানতে নারাজ বিরোধীরা। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ প্রাপ্তির ভাঁড়ার শূন্য। তবে এটা সেমিফাইনাল না হলেও ‘প্রস্তুতি ম্যাচ’ তো বটেই। ফলাফল ৬-০। এরপরেও যদি বিরোধীদের ঘুম না ভাঙে তাহলে ছাব্বিশে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে ‘শীতঘুম’। কারণ ধস নেমেছে ‘নেগেটিভ ভোটে’র বাজারে।