১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘে যখন ১০ ডিসেম্বর তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছিল, ঠিক তখন সারা পৃথিবীর মধ্যে সম্ভবত সবথেকে বেশি মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছিল পূর্ববঙ্গে। সম্পূর্ণ পূর্ববঙ্গ তখন সংখ্যালঘুদের রক্তে প্লাবিত। ঢাকা, সিলেট, বরিশাল, রাজশাহির কোনও জেলাই সেদিন রেহাই পায়নি।
সময় যত এগিয়েছে অত্যাচারের মাত্রাও বেড়েছে তত। কোনও সাময়িক উত্তেজনা নয়, সেটা ছিল একটা পরিকল্পিত ‘এথনিক ক্লিনসিং’—পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করা হবে প্রতিটি হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টানকে।
১৯৪৯ সালের আগস্ট মাসে সিলেটের বিয়ানি বাজার আর বড়লেখায় মৌলবাদীদের সঙ্গে পুলিস আর আনসাররাও গণহত্যায় যোগ দেয়। পাকিস্তানি পুলিস সে-বছর বরিশালের ভাণ্ডারিয়াতে হিন্দু মহিলাদের গণধর্ষণ শুরু করে বলে অভিযোগ উঠেছিল। ফাদার টমাস ক্যাট্টোনিও রাজশাহি থেকে জানালেন, মৌলবাদী আর পাকিস্তানি পুলিস যৌথভাবে সাঁওতাল মেয়েদের গণধর্ষণ করছে।
১০ ডিসেম্বর তারিখেই রাজশাহির পুঁটিয়া রাজবাড়ি মৌলবাদীরা দখল করে নিয়েছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ঘোষণার সেদিন ছিল বর্ষপূর্তি! তার ঠিক দশদিন পরে বাগেরহাটের মোল্লাহাট থানার কালশিরা গ্রামে পুলিস এক কমিউনিস্ট নেতার বাড়িতে ঢুকে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে প্রবৃত্ত হয়। ভদ্রমহিলার চিৎকারে স্থানীয় হিন্দুরা একত্র হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পরদিন পুলিস সুপারিনটেন্ডেন্ট এক বিশাল বাহিনী নিয়ে কালশিরা গ্রাম আর তার সংলগ্ন এলাকায় নির্বিচারে হিন্দুহত্যা করে। বাঘ শিকার করে যাওয়ার পরে হায়না আসে—জঙ্গলের এটাই নিয়ম। পুলিস চলে যাওয়ার পরে সেখানে হিন্দুদের সম্পত্তি অবাধেই লুট হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের পুলিস প্রশাসনের এইরকম ভূমিকার মধ্যেই ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল নতুন দিল্লিতে নেহরু লিয়াকত চুক্তি হল। দুই দেশের সংখ্যালঘুদের জান-মাল রক্ষা করার দায়িত্ব নিল ভারত আর পাকিস্তান সরকার। সেদিন ভারতের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে পূর্ববঙ্গের বাস্তব পরিস্থিতি সবচেয়ে ভালো জানতেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের পাকিস্তান সরকারের দয়ার উপর ছেড়ে দিতে ঘোর আপত্তি করেছিলেন। তাঁর আপত্তিতে কর্ণপাত না করায় তিনি নেহরুজির মন্ত্রিসভা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন।
মূলত এই চুক্তির উপরে ভরসা করেই ভারত ১৯৫১ সালের জেনেভা শরণার্থী কনভেনশনে সদস্য দেশ হিসেবে অংশ নিল না। ১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশন আর ১৯৬৭ সালের উরুগুয়ে প্রোটোকল মেনে সারা পৃথিবীর উদ্বাস্তু কল্যাণের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর)। তাই ইউএনএইচসিআর-এর হিসেবে, পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশের একজন উদ্বাস্তুও ভারতে নেই! অথচ সরকারি হিসেবেই ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২৪ ভাগ হিন্দু ছিলেন, অত্যাচারিত হয়ে বিতাড়িত হতে হতে আজ সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৮ শতাংশে। কোনও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মঞ্চে এত বড় নরমেধ যজ্ঞের আলোচনা হল না, হিসেব থাকল না!
হঠাৎ করে মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের উপর হামলা করা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। এই পর্যায়ে চূড়ান্ত অনাচার হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। ভারতের কাশ্মীরে ‘হজরতবাল’ মসজিদ থেকে পবিত্র কেশরাজি চুরি গিয়েছে, এমন গুজব ছড়িয়ে পাকিস্তানের সরকারি মদতে হিন্দুনিধন করা হয়। পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ইসলামাবাদ যাওয়ার আগে উস্কানি দিয়ে যান। তারপরেই ৩ জানুয়ারি পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লিগ ‘কাশ্মীর দিবস’ ঘোষণা করে। খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট থেকে ময়মনসিংহ সর্বত্র নিদারুণ অত্যাচার চলে। ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির আক্রান্ত হয়।
দেশভাগের পরে এদেশে ভূমিসংস্কার হলেও পাকিস্তানে প্রায় কিছুই হয়নি। রাজশাহিতে কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ইলা মিত্র। ১৯৫০ সালে ইলা মিত্রকে গ্রেপ্তার করার পরে তাঁর যাবজ্জীবন সাজা ঘোষণা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জেলে তাঁকে যে অত্যাচার করা হয়েছিল, মহিলা বন্দিনির্যাতনের নিরিখে মানবসভ্যতার ইতিহাসে সেই কাহিনি বিরাট কলঙ্ক হয়েই থাকবে। ১৯৫৪ সালে অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে প্যারোলে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে আনা হয়। তিনি আর কখনও নিজের দেশে ফিরতে পারেননি।
আজ মানবাধিকার দিবসে মানবসভ্যতার ইতিহাসের এক অন্ধকারময় অধ্যায়ের কথা স্মরণ করা প্রয়োজন। সেটি মুক্তিযুদ্ধের ঠিক আগে পাকিস্তানের খান সেনাদের অত্যাচার। সেইসময় ঢাকায় আমেরিকার কনসাল জেনারেল ছিলেন আর্চার কেন্ট ব্লাড। তিনি তাঁর প্রতিদিনের বীভৎস অভিজ্ঞতা ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ হিসেবে মার্কিন মুলুকে পাঠিয়েছিলেন। পৃথিবীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সেটি একটি প্রমাণ্য দলিল। অপারেশন সার্চলাইটের মতো নৃশংস অভিযান দেখে শিউরে উঠেছিল বিশ্ববাসী। পাকিস্তানের খানসেনা প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। মহিলা ধর্ষণ করা হয়েছিল আনুমানিক ৪ লক্ষ। ১ কোটি বাঙালি সেদেশ থেকে পালিয়ে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। এই হতভাগ্যদের বেশিরভাগই বাঙালি হিন্দু। পাকিস্তানে ফতোয়া জারি করে হিন্দুর সম্পত্তি ও মহিলাদের ‘গনিমতের বস্তু’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জামাত কর্মীরা পূর্ব পাকিস্তানে ‘শান্তি কমিটি’ গঠন করে। এরা রাজাকার বাহিনী, আল বদর বাহিনী এবং আল শামস বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানের সেনাদের নরসংহারে সহযোগিতা করে।
১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনা জেলার ডুমুরিয়ায় চুকনগর সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে আসতে চাওয়া ১২ হাজার হিন্দু নরনারীকে হত্যা করা হয় একদিনে! ১৯৪২ সালের আগস্ট, সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর মাসে নাৎসি বাহিনী একদিনে গড়ে ১৫ হাজার ইহুদিকে হত্যা করেছিল। সম্ভবত তারপরেই স্থান পাবে চুকনগরের ওই নৃশংসতা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বন্ধ হয়নি। হিন্দুদের সম্পত্তি হস্তগত করার কালাকানুন ছিল শত্রুসম্পত্তি আইন। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে তা পরিবর্তিত হয়ে হয়েছিল ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে দেখা যাবে বাঙালি হিন্দুর সম্পত্তি দখল করে বসে আছেন কোনও নেতা। চোদ্দো পুরুষের বসতবাড়ি ছেড়ে বহু হিন্দু বাঙালি কোনও আশ্রমে বা কোনও ভাড়া বাড়ির ছোট্ট ঘরে দিন কাটাচ্ছেন, এমন ঘটনা বাংলাদেশের সর্বত্র। কারণ তিনি বাড়ির দাবি করতে গেলে অস্ত্রের সামনে তাঁকে সই করতে বাধ্য করা হবে। আর কোনও এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে জমি বা বাড়ির ‘মালিক’ দেখিয়ে ‘খাঁড়া দলিল’ বানিয়ে নেওয়ার নজিরও আছে হাজার হাজার।
১৯৮৮ সালে ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ ঘোষণার পর থেকে সে-দেশের সংখ্যালঘু মানুষের মানবাধিকার আবার লঙ্ঘিত হতে থাকে। হিন্দু, বৌদ্ধ আর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ঐক্যও এই অমানবিক নির্যাতনের হাত থেকে বাঙালিকে বাঁচাতে পারেনি।
এই নিত্যদিনের অত্যাচার সহ্য করেও কিছু
সংখ্যালঘু নাগরিক ওই দেশে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু সংখ্যাগুরুর অত্যাচার মাঝেমধ্যেই অসহ্য হয়ে উঠেছে সেখানে। ২০০১ সালে যখন বাংলাদেশে বিএনপি আর জামাতের নেতৃত্বে চার দলের সরকার এসেছিল, তখন আবার অবর্ণনীয় অত্যাচার নেমে আসে।
সে-বছর চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপালকৃষ্ণ মুহুরিকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ১২ বছরের একটি মেয়েকে সারারাত ধরে ১২-১৪ জন ক্রমান্বয়ে ধর্ষণ করেছিল তার মায়েরই সামনে! অদ্ভুত ব্যাপার হল, কলকাতায় কোনও ‘প্রগতিশীল’ দল বা সংগঠন এই মানবাধিকারের শ্রাদ্ধ দিবসে কোনও প্রতিবাদ মিছিল বের করেননি। আজও যখন ইসকনের নিরাপরাধ সন্ন্যাসীকে শাস্তি দেওয়ার প্রহসন হচ্ছে তখনও তাঁদের কণ্ঠরুদ্ধ।
আসলে, বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের একশ্রেণির শিক্ষিত মানুষের জন্যই এই ভয়ানক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিক ঘটনা আন্তর্জাতিক স্তরে উঠে আসেনি। উদ্বাস্তু জীবনের কষ্ট নিয়ে উপন্যাস লেখা হয়েছে, ছায়াছবি হয়েছে কিন্তু কেন যে মানুষগুলো উদ্বাস্তু হলেন, তা বলা হল না।
স্টিফেন স্পিলবার্গের ‘শিন্ডেলার্স লিস্ট’ বহু মুসলিম দেশে নিষিদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু হলিউডের এই প্রবাদপ্রতিম ইহুদি পরিচালক ভাবেননি যে, তাঁর আসন টলে যাবে। বার্লিনে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনও হলোকাস্ট মিউজিয়াম উদ্বোধন করতে কোনও নোবেলজয়ী ইহুদির সাম্প্রদায়িকতা বলে মনে হয়নি।
কাশ্মীরের পণ্ডিতদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলতে কখনও কোনও প্রথিতযশা কাশ্মীরের মানুষ ইতস্তত করেননি।
১৯৪৬ সালে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর দিন নোয়াখালিতে নির্বিচারে হিন্দুনিধন শুরু হয়েছিল। ছুটে গিয়েছিলেন গান্ধীজি। সেই মানবাধিকার নিধন সমানে চলেছে।
এই উপমহাদেশে পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দুর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বেদনাবিধুর কাহিনি কোথাও প্রদর্শিত হল না। অথচ এই বাংলারই কবি বলেছিলেন, যে অন্যায় করে আর যে সহ্য করে তারা উভয়েই ঘৃণার পাত্র।
লেখক কলকাতায় সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত