অনেক সংশয় কাটিয়ে সোমবার ঢাকাতেও পালিত হল ‘বিজয় দিবস’। এমনকী, কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামের বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও যোগ দিল বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন হয় এবং ৮ আগস্ট বাংলাদেশের দায়িত্ব নেয় মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশের নয়া জমানায় এটাই প্রথম বিজয় দিবস উদযাপন। কিন্তু এই অনুষ্ঠান ঘিরে ঘোর সংশয়ের কারণ সেদেশের নবীন নেতৃত্বের মতিগতি। আওয়ামি লিগ সরকারের বিরোধিতায় নামা উন্মত্ত লোকজনের টার্গেট হয়ে উঠেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার। গণঅভ্যুত্থানের আঁচে ভস্মীভূত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত মিউজিয়ামও। টাকার নোট থেকে মুজিবের ছবির চিরবিদায় আসন্ন। যে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে আপামর বাঙালিকে তিনি একত্র এবং বিস্ময়কর তৎপরতায় উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন, তাকে নতুন বাংলাদেশ বিদায় জানাচ্ছে। জাতীয় শোক দিবস (১৫ আগস্ট) সহ ৮টি ‘জাতীয় দিবস’ ইতিমধ্যেই ‘বাতিল’ ঘোষিত হয়েছে। কারণ হিসেবে দাবি করা হয়েছে, এগুলির ‘জাতীয় গুরুত্ব’ কিছু নেই, ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসক দল আওয়ামি লিগ তার প্রচারের জন্যই এগুলি চালু করেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাস এবার নতুন করে লেখা হবে। অথচ মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে (এমওডব্লিউ) এখনও পর্যন্ত যে ৪২৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথি সংগৃহীত হয়েছে, তার মধ্যে একটি হল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। ইউনুস জমানায় ৮ বাতিলের ভিড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে সেটিকেও! বাকি বাতিল দিবসগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি হল: ১৭ মার্চ (জাতির পিতার জন্মদিবস ও জাতীয় শিশু দিবস) এবং ৪ নভেম্বর (জাতীয় সংবিধান দিবস)। বস্তুত ওপার বাংলার হালের মাতব্বররা মুজিবের ছায়াকেও ভয় পাচ্ছেন! স্বাধীনতার চেতনার স্মৃতি বহনকারী চিহ্নগুলিকে মুছে ফেলা হচ্ছে মূর্খের মতোই নির্বিচারে। ঢাকা, চাটগাঁর একদল উচ্চশিক্ষার প্রতিভূর নেতৃত্বে রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা চলছে কয়েক বছর যাবৎ। তাঁরা হয়তো শীঘ্রই সফল হবেন ‘হিন্দু’ (যদিও তিনি ব্রাহ্ম এবং হিন্দু ও ব্রাহ্ম ধর্মের তফাত সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল) কবির লেখা জাতীয় সঙ্গীত বাদ দিতে।
মনে পড়ে, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট মুজিবহত্যার পর ক্ষমতা দখল করেন সেনানায়ক জিয়াউর রহমান। এরপর ৩০ মে, ১৯৮১ এক সামরিক অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হবার পর বেরিয়ে পড়ে আর এক সেনাকর্তা হোসাইন মহম্মদ এরশাদের দাঁত-নখ। রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে দ্রুত (২৪ মার্চ, ১৯৮২) হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন তিনিও। অল্পদিনেই বুঝেছিলেন, যে-মুকুট তিনি পরেছেন সেটি আসলে কাঁটার! তাই কাঁটা দিয়েই কাঁটা তোলার নীতি প্রয়োগ করেন এরশাদ: তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত জোরদার ছাত্র আন্দোলনের মোকাবিলা করতে ১৯৮৮ সালে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে সবার ঘাড়ে চাপিয়ে দেন ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের যন্ত্রণা’। এরশাদের এই অপকীর্তির তীব্র বিরোধিতা করেছিল তখন দুই প্রধান বিরোধী দল আওয়ামি লিগ এবং বিএনপি। কিন্তু পরবর্তীকালে তারাও বুঝেছিল, অশিক্ষিত মানুষে ভরা একটা দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা হাসিল ও ধরে রাখার জন্য ইসলামি জিগিরের বিকল্প নেই। ফলে পরবর্তীকালে কুর্সি দখল করে খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার কেউই বঙ্গবন্ধুর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান ফেরাতে উচ্চবাচ্য করেননি। ওয়াজ মাহফিলে দেখি এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির ছাত্র-শিক্ষকেরও মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছে যে, ৯০ শতাংশ মুসলমানের বাংলাদেশ কেবল তাদেরই। হিন্দুসহ অন্যরা ‘আশ্রিত’ কিংবা ‘দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক’ হিসেবে থাকতে হলে থাকবে আর না-পোষালে কেটে পড়বে ‘ইন্ডিয়া’য়! এই ধর্মীয় সংকীর্ণতা মান্যতা পেয়েছে শাসক দলের কিছু নেতা এবং প্রশাসনের একাংশের নীরবতায়। হাসিনা সরকারের পতনের পর হিন্দু, বৌদ্ধ, চাকমাসহ ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু শ্রেণির উপর লাগাতার নির্যাতনের নেপথ্য কাজ করছে এই ফ্যাসিবাদ।
ভারত এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে। আমাদের বিদেশ সচিব ঢাকা সফর করেও বার্তা দিয়েছেন। প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে পশ্চিমি দুনিয়া থেকেও। কিন্তু দমেনি ইউনুস প্রশাসন। গুরুতর অভিযোগগুলিকে তারা এখনও ‘অসত্য’ এবং ‘কিছুটা রাজনৈতিক’ বলে চালাতে চাইছে। ধর্মীয় অন্যায়ের প্রতিবাদ যত জোরদার হচ্ছে, কিছু অর্বাচীন উগ্র মৌলবাদী মুসলিম লোক ওপার বাংলার মাটি থেকে ভারতের বিরুদ্ধে হুংকার ছাড়ছে। এমনকী সেভেন স্টারস (অসমসহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য), কলকাতা এবং সিরাজের হৃত রাজ্য (সাবেক বাংলা-বিহার-ওড়িশা) দখলেরও হুমকি শোনানো হচ্ছে। আর এই অবাঞ্ছিত আবহেই সোমবার পালিত হল বিজয় দিবস। এটা কিছুটা যে বাধ্যবাধকতা থেকেই, মালুম হয় তাও। জিয়া এবং এরশাদও নিজেদের সামরিক সরকারের সর্বাঙ্গে গণতন্ত্রের নামাবলি পরাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। এবারের বিজয় দিবস পালন কতটা মেকি তা ধরা পড়ে নেতৃত্বের ভূমিকায়। ইউনুসের ভাষণে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনা বাহিনী এবং জনগণের অবদানের উল্লেখ নেই। উল্লেখ নেই চূড়ান্ত বিজয় হাসিল করার আগে ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারত সরকারের তরফে প্রথম বাংলাদেশকে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’-এর স্বীকৃতি প্রদানের কথা। মুক্তিযুদ্ধে নিহত ভারতীয় সেনাদের স্মৃতির প্রতিও শ্রদ্ধা জানাননি ইউনুস। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলিতে মুক্তিযুদ্ধের মূল কারিগর বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মহম্মদ মনসুর আলি এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্মরণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাঙালি নরনারী শহিদ হন, ইজ্জত লুট হয় অগণিত মা-মেয়ের। বিজয় দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রাপ্য তাঁদেরও। ব্যতিক্রম ঘটল এবারই। একাত্তরে ইতিহাসের নৃশংসতম অপরাধের জন্য পাকিস্তান আজও ক্ষমা চায়নি। সোমবার জাতির উদ্দেশে ভাষণে ইউনুস সেই ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ পাকিস্তানের নাম পর্যন্ত মুখে নেননি। উল্টে, যে-প্রতিবেশীর সাহায্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভ, সেই ভারতেরই তীব্র বিরোধিতার সুর প্রকট হল ইউনুস সাহেবের গলায়! দিল্লি থেকে ইউরোপের দেশগুলির ভিসা অফিস ঢাকায় সরানোর পক্ষে সওয়াল করেন তিনি বিজয় দিবসের ভাষণে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইউরোপের যেসব দেশের ভিসার জন্য বাংলাদেশ দিল্লির উপর নির্ভরশীল, সেগুলি সরাতে হবে ঢাকায় অথবা ‘অন্যকোনও প্রতিবেশী দেশে (পড়ুন, পাকিস্তানে)’। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতদের কাছে এই আর্জি রেখেছেন ইউনুস। বিজয় দিবসের ভাষণে তিনি আরও মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ‘ভুলবার্তা’ প্রচার চলছে। অভিযোগের তর্জনী যে ভারতেরই দিকে, তাতে সংশয় নেই। সোজা কথায়, ভারতের সঙ্গে দ্রুত দূরত্ব রচনার চেষ্টায় ইউনুস প্রশাসন, একইসঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্ব কমানোরই স্পষ্ট ইঙ্গিত।
সঙ্গে দোসর কিছু উচ্চ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী। যেমন ভারত-বিদ্বেষের সুর শোনা গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন অধ্যাপকের মুখে। হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ-পাকিস্তানকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন এই বুদ্ধিজীবী। বিজয় দিবসের প্রাক্কালে, ১৫ ডিসেম্বর ইসলামাবাদে পাকিস্তান ন্যাশনাল কাউন্সিল অব আর্টস অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্ক’ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এক ভার্চুয়াল ভাষণে তিনি বলেন, হাসিনার পতনের পরই মূলত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অন্তর্বর্তী সরকার তৈরির পর থেকে দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের অগ্রগতি ঘটেছে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ঐতিহাসিক বন্ধনে আবদ্ধ! আমাদের মধ্যে উত্থান-পতন হয়েছে। কিন্তু আমরা সবসময় বুঝেছি যে, আমাদের একে অপরকে প্রয়োজন। এদিকে, পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে বিএনপি কর্মীদের তরফে শপথ নেওয়া হল যে, ‘ভারতের আগ্রাসনবাদ এবং ভারতের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকব আমরা।’ মোদ্দা কথা, সবরকমে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব রচনার চেষ্টায় আছে আজকের বাংলাদেশ।
তবে এত অল্পে অভিজ্ঞ ভারতের হতাশ হওয়া চলে না। কারণ এইসব বাগাড়ম্বর কতটা সাধারণ মানুষের মনের কথা এবং তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তা নিয়ে সংশয় আছেই। বাংলাদেশের উগ্র মৌলবাদী মুসলিমরাও অচিরে ভুল বুঝবে। পেটে খেলে পিঠে সয়। ভারত একমাস নির্বাক দর্শক হয়ে থাকলে, হলফ করে বলা যায়, পেটে টান পড়বেই। খিদে পেটে ধর্মের কথাও (উগ্র মৌলবাদী কথাবার্তা) বেশিদিন সইতে পারা শক্ত। অর্বাচীনগুলোকে শুধরে যেতে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন দেশবাসীই বাধ্য করবে শীঘ্রই। নিকটতম বৃহৎ প্রতিবেশী হিসেবে ভারত সেদিন সর্বোতভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াবার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারবে না। তাই কিছু পাগলের প্রলাপকে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। ভারত কখনও অন্য দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাক গলায়নি, হস্তক্ষেপ করেনি তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতায়। তাই তো ১৯৭১ সালে বিপুল বিজয়ের পরও বাংলাদেশকে ভারতভুক্ত করে নেওয়ার সুযোগ হেলায় উপেক্ষা করেছিল দিল্লি। অভ্যন্তরীণ হাজার প্ররোচনার বিপরীতে শিক্ষণীয় সংযমই দেখিয়েছিলেন ভারত নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী। শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনাটি কোনোভাবেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ নয়। ভারত এটা করেছে মানবিকতা ও মানবাধিকারের জায়গা থেকে। শুধু শেখ হাসিনা নন, অতীতে বাংলাদেশের আরও অনেক গণতান্ত্রিক নেতা-কর্মীকে ভারত রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে। এটাই ভারতের কূটনৈতিক সৌজন্য। ভারতবাসী বাংলাদেশকেও স্বনির্ভর আত্মনির্ভর দেখতে চায়। অতএব চূড়ান্ত ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্ররোচনায় সেখানে ভারত বিরোধিতার পথটি ভ্রান্ত। বরং দায়িত্বশীল প্রতিবেশী হিসেবে ভারতই বাংলাদেশকে এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করতে পারবে। একটি শান্তিকামী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত সবসময়ই চায় উন্নত, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক প্রতিবেশীদের। বাংলাদেশ অবশ্যই এই বন্ধনীতে রয়েছে। বাংলাদেশের মনে রাখা উচিত, ভারত তার পুবে তাকাও এবং প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকারের নীতিতে অবিচল।