বিশেষ নিবন্ধ

সিবিআইকে নিয়ে গদগদ হওয়ার কিছু আছে কি?
শান্তনু দত্তগুপ্ত

১) ময়নাতদন্ত নিয়ে প্রশ্ন। কল্যাণী এইমস এবং দিল্লির গঙ্গারামপুর হাসপাতালে পাঠানোর পরও কিন্তু খুঁত মিলল না।
২) ভিসেরা সংরক্ষণে গলদ। সেন্ট্রাল ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করানোর পরও কলকাতা পুলিসের বিরুদ্ধে উল্লেখ করার মতো কিছু পেল না সিবিআই।
৩) সেমিনার হল ঘটনাস্থল নাও হতে পারে। আর জি কর হাসপাতালের অন্য তলেও তদন্ত চলল। নিশ্চিত কি হল সিবিআই? চার্জশিট বা আদালতে ফরওয়ার্ডিংয়ে তার পাকাপোক্ত উল্লেখ মিলল না।
৪) পর্যাপ্ত নথি ও ফুটেজ দেয়নি কলকাতা পুলিস। নিম্ন আদালতে সিবিআই খোদ জানিয়েছিল, সব ক্যামেরা মিলিয়ে মোট ৯০০ ঘণ্টার ফুটেজ। খতিয়ে দেখতে সময় লাগছে। 
৫) ঘটনাস্থলে সঞ্জয় একা ছিল না। সত্যিই যদি একাধিক ব্যক্তি ধর্ষণ-খুনের সময় থেকে থাকে, তারা কোথায়? শতাধিক জেরা-জিজ্ঞাসাবাদের পরও তাদের খোঁজ মিলল না! এই ‘একাধিক’ লোকজন নিশ্চয়ই বাইরের লোক নয়। তাহলে কোনও না কোনও ক্যামেরায় ধরা পড়ত। সেক্ষেত্রে কি হাসপাতালের লোক? কারা তারা? চার্জশিটে নেই। 
৬) বৃহত্তর ষড়যন্ত্র এবং তথ্য-প্রমাণ লোপাট। অভয়া কাণ্ডে তদন্তে নামার পর এটাই ছিল সিবিআইয়ের অভিমুখ। সেই কারণে মূল অভিযুক্ত সঞ্জয়কে হেফাজতে নিলেও আসল ঝোঁক তাদের ছিল হাসপাতালের প্রশাসনমুখী। থুড়ি, সন্দীপ ঘোষ-মুখী। এবং সেইসঙ্গে টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডল। এই দু’জনেই নাকি পুরো ষড়যন্ত্রের রচয়িতা। দীর্ঘ ফোনালাপ করেছেন তাঁরা নিজেদের মধ্যে। আর আর জি কর হাসপাতালের অধিকর্তা ঘোষবাবুর কথামতোই নাকি তথ্য-প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে। তাঁদের গ্রেপ্তারও করে সিবিআই। কিন্তু ৯০ দিন পরও চার্জশিট জমা হল না এই দুই ‘অপরাধী’র বিরুদ্ধে। গোলমেলে ফোনালাপের যে তত্ত্ব খাড়া করা হয়েছিল, তার পক্ষে কোনও প্রমাণও দাখিল হয়নি। তাহলে কোন তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে এই দুই সরকারি আধিকারিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল? এতদিন তাঁদের হেফাজতে রেখে এবং জেরা চালিয়ে কী মিলল? প্রমাণ হাতে থাকলে চার্জশিট পেশ হল না কেন?
আর জি করে চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ-খুন নিয়ে সাড়ে চার মাস যাবৎ এতরকম সমীকরণ সাজিয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা। এবং সবশেষে বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে আনকোরা উপন্যাসের প্লট। প্রচুর চরিত্র আমদানি হয়েছে। কিন্তু শেষে গিয়ে আর মেলানো যাচ্ছে না। পাঠক তো দূরঅস্ত, খেই হারিয়ে ফেলেছেন লেখকই। কলকাতা পুলিস মাত্র ২৪ ঘণ্টায় এই মামলার যে ফয়সালা করেছিল... হিল্লি-দিল্লি, নিম্ন-উচ্চ, চক্রান্ত-রহস্যের পর ওই গন্তব্যেই থামতে হচ্ছে সিবিআইকে। সঙ্গে রসদ মিলছে একঝাঁক প্রশ্নের। এই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাই কি না সুপ্রিম কোর্টে জমা করা স্টেটাস রিপোর্টে এমন কিছু দাবি করেছিল, যাতে ‘বিচলিত’ হয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়! আইনজীবী তথা সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা তদন্ত সংক্রান্ত কিছু বলতে গেলে থামিয়েও দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘তদন্তের অত্যন্ত স্পর্শকাতর কোনও বিষয় জনসমক্ষে বলবেন না।’ বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের দাবিতে তাঁর আরও মন্তব্য ছিল, ‘জেনেবুঝে বলছেন তো? যদি এমনটা হয়ে থাকে, তাহলে ফল ভয়াবহ।’
সেই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তত্ত্বই আপাতত সন্দীপ ঘোষ এবং অভিজিৎ মণ্ডলের জামিনের নির্দেশে লাট খাচ্ছে। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার চলছে অভয়া মামলার। চার্জ গঠনের পর শুনানি, তারপর রায় ঘোষণা। ইঙ্গিত যা মিলছে, এই মামলায় রায় ঘোষণা করতে বেশি সময় নেবেন না বিচারক। হতে পারে ২৫ ডিসেম্বরের ছুটির আগেই। সেক্ষেত্রে সিবিআইয়ের পেশ করা চার্জশিটের ভিত্তিতে সঞ্জয় ছাড়া আর কেউ আদালতের সামনে নেই। তার বিরুদ্ধে কষে তথ্য-প্রমাণ গোছানো হয়েছে। তাতেও অবশ্য সিবিআইয়ের কৃতিত্ব আদৌ আছে কি না, প্রশ্ন ওঠাটা অমূলক নয়। এই কাজটাও কলকাতা পুলিস করে রেখেছিল। সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ যা আছে, তাতে তার সাজা হওয়াটা মোটামুটি নিশ্চিত। কলকাতা পুলিসের সঙ্গে এক্ষেত্রে সিবিআইয়ের দাখিল করা নথির ফারাক কোথায়? পুলিস দাবি করেছিল, ধর্ষণ-খুন সঞ্জয় করেছে। সিবিআই যে চার্জশিট পেশ করেছে, তাতে সঞ্জয়ের ধর্ষণের অপরাধ নিয়ে ফাঁক রাখা হয়নি। কিন্তু খুনের ক্ষেত্রে অতটা নিশ্চয়তা দেখায়নি তারা। এক্ষেত্রে দু’টি পথ রয়েছে। প্রথমত, ধর্ষণ এবং খুন—দুই অপরাধেই সাজা হতে পারে সঞ্জয়ের। দ্বিতীয়ত, খুনের ব্যাপারে সাজা ঘোষণা ঝুলে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে সিবিআই সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট দেওয়ার সুযোগ পাবে। এই সাফাই অবশ্য কেন্দ্রীয় অফিসাররাও দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি, সেন্ট্রাল ল্যাব থেকে ডিজিটাল এভিডেন্স সংক্রান্ত প্রমাণ হাতে আসতে দেরি হয়েছে। তারপর আর চার্জশিট তৈরির সময় ছিল না। এতেই ৯০ দিন পেরিয়ে গিয়েছে। কী সেই প্রমাণ? যতদূর খবর পাওয়া যাচ্ছে, সন্দীপ ঘোষের সঙ্গে অভিজিৎ মণ্ডলের কথোপকথন। ডিলিট করে দেওয়া কল রেকর্ডিং উদ্ধার হয়েছে। তার থেকেই নাকি অনেক কিছু জানা যাচ্ছে। ভাবনার বিষয় হল, এরপরও কিন্তু সিবিআইয়ের অন্দরমহল থেকে শোনা যাচ্ছে, অভিজিতের বিরুদ্ধে কেস দাঁড়াবে না। এখানে কি প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয় যে, ফোনালাপের রেকর্ডিং থেকে তেমন কিছু পায়নি সিবিআই? এখানে একটা ছোট্ট তথ্য দিয়ে রাখা দরকার। সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে সিবিআই ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছে। আর অভিজিৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের এবং এফআইআরে দেরির। টালা থানার প্রাক্তন ওসির বিরুদ্ধে এই দুটোই প্রমাণ করে উঠতে পারছে না কেন্দ্রীয় সংস্থা। আর সন্দীপ ঘোষ? ষড়যন্ত্র মানে কিন্তু ঘটনার পরের অঙ্ক নয়। পুরোটাই আগের। সেটা প্রমাণ করার মতো নথিও সিবিআইয়ের কাছে আছে তো? নাকি গোটা ব্যাপারটাই সেনসেশন?
গত সাড়ে চার মাসে দেশের কোনও রাজ্যে ধর্ষণ বা খুনের মতো অপরাধ বন্ধ হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকার আইন বদলে ধর্ষণে ফাঁসির সাজা রেকমেন্ড করেনি। সিবিআইয়ের হাতে থাকা ৭ হাজার মামলায় কারও শাস্তি হয়নি। হয়েছে বলতে শুধু রাজ্য-রাজনীতি এবং মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন। দ্বিতীয়টা পাওনা হলেও প্রথমটা নয়। কারণ, রাজপথের রাজনীতি কখনও রাষ্ট্রের উন্নতির পক্ষে ইতিবাচক নয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের রুজিরুটির সমস্যা দেখা দেয়, গরিব মানুষ চিকিৎসা পায় না, ব্যবসায়ীরা লগ্নি করতে চায় না...। সরকারের বিরুদ্ধে যদি ক্ষোভ থাকে এবং এই আন্দোলনে সরকারকে ফেলে দেওয়া যায়, তাহলে এমন রাজনীতির সারবত্তা বলে কিছু পাওয়া যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেটাও হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তায় যে এতটুকু ফাটল ধরেনি, পরবর্তী ভোটগুলিতেই তার প্রমাণ মিলেছে। তার মানে এই আন্দোলন সর্বাত্মক ছিল না! সাধারণ মানুষ একটা বিষয় বুঝেছে, তাদের মতো এই ভদ্রমহিলাও অভয়া খুনের সর্বোচ্চ সাজা চেয়েছেন। কাজেকর্মে তার প্রমাণও দিয়েছেন তিনি। তাহলে সাধারণ মানুষকে সামনে রেখে শুরু হওয়া আন্দোলনে রাজনীতির ইন্ধন পড়েছে বললে কি খুব ভুল হবে? সিবিআইয়ের দাবি, সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট আসবে। দুটো কেসেই যেহেতু সাক্ষী এক, একসঙ্গে পেশ করলে বিচারে সমস্যা হতে পারে। তাই দেরি। এই যুক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এখানে তো আর লজেন্স বিলি হচ্ছে না যে, লাইন বেঁধে দাঁড়াতে হবে! আগে সঞ্জয় পেলে তারপর সন্দীপের নম্বর আসবে! মানুষ বিচার চায়। রাজনীতি নয়। ঢিলেমিও নয়। তদন্তকারী অফিসাররা হয়তো ভাবছেন, আগে সঞ্জয়ের সাজা ঘোষণা হয়ে যাক। তাতে জনতার রোষে খানিক প্রলেপ পড়বে। রাজ্যের একের পর এক অপরাধের ঘটনায় যেভাবে পুলিস দু’মাসের মধ্যে কেস ক্লোজ করে দিচ্ছে এবং দোষীদের সাজা হয়ে যাচ্ছে, তা সিবিআইয়ের উপর চাপ বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট। এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে শুধু সঞ্জয়। সন্দীপদের জন্য তো সময় রয়েইছে। 
পাবলিক সেটা বুঝবে না। সিবিআইয়ের উপর ভরসা তারা করে বলেই নানা ক্ষেত্রে তাদের তদন্তভার দেওয়ার জন্য সওয়াল ওঠে। কিন্তু সেই ভরসার মর্যাদা কি এই তদন্তকারী সংস্থা রাখতে পারে? আদালত এখনও তাদের স্পষ্ট ভাষায় তুলোধোনা করে। বলে, আর কতদিন রাজনীতির বোড়ে হয়ে থাকবেন? সরকারের তোতাপাখি হয়ে থাকাটা তাদের কাজ নয়। রাজনীতি যতদিন তদন্তকে প্রভাবিত করবে, বাড়বে মামলার তালিকা। দীর্ঘ হবে বিচারের অপেক্ষা। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সিবিআইয়ের হাতে এসেছে ২ হাজার ১৮৮টি কেস। প্রচারের আলোয় আসা ছাড়া বাড়তি কিছু করে উঠতে পারেনি তারা। আর তাদের হাতে থাকা কতগুলো হাইপ্রোফাইল মামলায় গত ২০ বছরে সাজা হয়েছে, সেটা তো শিশুও গুনে বের করে ফেলতে পারবে। 
আর জি কর কাণ্ড আরও একবার দেখাল, সিবিআইয়ের নামে গদগদ হওয়ার মতো কিছু নেই। তারা যে সর্বত্র নিরপেক্ষ তদন্ত করে না, দেশের 
শীর্ষ আদালতও তা বারবার বলেছে। আমরাই শুধু এখনও আশা করি, তারা ন্যায়বিচার দেবে। 
ক্ষমতায় আসার আগে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘সিবিআই তো কংগ্রেস ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন হয়ে গিয়েছে।’ আজ তিনি সিবিআইকে নিয়ে কী বলবেন? এখন তো সঙ্গে জুড়েছে ইডিও। অসীম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটকে। দুই এজেন্সি মিলে রাজনীতির ময়দানে একের পর এক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধীদের কোমর ভেঙে দেওয়ার এক গোদা খেলা চলছে দেশজুড়ে। সাজা কিন্তু হচ্ছে না! দিনের শেষে পুরোটাই একটা সাজানো চিত্রনাট্য বলে ধন্দ লাগছে। 
আসলে ক্ষমতার কুর্সিতে বসলে শাসক ভুলে যায় যে, বিরোধী সব সময় সরকারের আয়না হয়। ‘অ্যাপল’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জোবস বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক মুহূর্তে একটা ডট বা বিন্দু তৈরি করে চলেছি। বর্তমান থেকে ভবিষ্যৎ—অগুনতি বিন্দু তৈরি হচ্ছে আমাদের পদক্ষেপে। কিন্তু সেই বিন্দুগুলি কী ছবি তৈরি করছে, তা আমাদের নজরে আসছে না। একমাত্র যদি আমরা অতীতের দিকে পিছন ফিরে তাকাই, তখনই চোখে পড়বে ছবিটা। আমরা বুঝব, সেটা গঠনমূলক হল কি না।’ বিরোধীরা কিন্তু ওই কাজটাই করে। শাসককে প্রকৃত ছবিটা দেখায়। শাসক যদি তার থেকে শিক্ষা নেয়, উন্নতি দেশের। না হলে সবটাই গ্রাস করবে অজ্ঞতা। আর হ্যাঁ, অপদার্থতাও। 
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

অর্থকর্মের ক্ষেত্রে প্রগতি বজায় থাকবে। মরশুমি দ্রব্যের ব্যবসায় লাভ বাড়বে। শরীর-স্বাস্থ্য এক প্রকার থাকবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.০৯ টাকা৮৫.৮৩ টাকা
পাউন্ড১০৬.০৫ টাকা১০৯.৭৯ টাকা
ইউরো৮৭.৫৬ টাকা৯০.৯২ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা