বিশেষ নিবন্ধ

লোকশিক্ষক রামকৃষ্ণ সদাই কল্পতরু
অতূণ বন্দ্যোপাধ্যায়

একটু খোলামেলা জায়গায় রোগীকে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার  সরকার। সেই মতো বাড়ি খোঁজা শুরু হল।  রামচন্দ্র দত্ত কাশীপুর নিবাসী মহিমাচরণ চক্রবর্তীর সাহায্যে খুঁজে পেলেন একটি বাগানবাড়ি। রানি কাত্যায়নীর জামাই গোপাল চন্দ্র ঘোষের বাড়ি। মাসিক ভাড়া ৮০ টাকা।  পঞ্জিকা দেখে আগেই সবকিছু স্থির করা হল। শ্যামপুকুর থেকে শুক্রবার বেলা আড়াইটে নাগাদ ঘোড়ার গাড়ি করে কাশীপুরের  উদ্দেশে যাত্রা শুরু হল। শুক্লা পঞ্চমী তিথি, শুক্রবার ১১ ডিসেম্বর অসুস্থ শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তজন সহ কাশীপুরে ভাড়া বাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। প্রশস্ত বাগানের মাঝে ছোট্ট দোতলা বাড়ি, চারিদিকে নানা ফুল ফলের গাছ। সঙ্গে ছোট্ট দুটি পুকুর। শ্যামপুকুরের ঘিঞ্জি পরিবেশ ছেড়ে কাশীপুরের ভাড়া বাড়িতে এসে শ্রীরামকৃষ্ণ খুশি হলেন। শ্রীমা সারদা দেবী সঙ্গে সেবক লাটু, বুড়োগোপাল, কালীপ্রসাদ, নরেন্দ্রনাথ ও রামচন্দ্রও সেদিন রামকৃষ্ণের সঙ্গে এসে পৌঁছলেন কাশীপুরের বাটিতে।
গলরোগে আক্রান্ত শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসার জন্য তাঁকে প্রথমে দক্ষিণেশ্বর থেকে শ্যামপুকুরের ভাড়া বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ৭০ দিন চিকিৎসা করেও তার আশানুরূপ উপকার না হওয়ায় ডঃ মহেন্দ্র সরকার রোগীকে শহরের ঘিঞ্জি পরিবেশ ছেড়ে খোলামেলা জায়গায় রাখার পরামর্শ দেন।  সেইমতো কাশীপুরের খোলামেলা পরিবেশে এসে এবং ডাক্তার মহেন্দ্র সরকার ও রাজেন্দ্র মিত্রের চিকিৎসায় প্রথম এক সপ্তাহের ভেতর অনেকটা ভালো বোধ করেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তবে তারপরেই ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তাঁর সেবার জন্য কাশীপুরে একে একে  উপস্থিত হলেন যুবকবৃন্দ। চলতে থাকল দিনরাত এককরে সেবা করা। কলকাতার শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যান্য গৃহী ভক্তরাও নিয়মিত আসা-যাওয়া শুরু করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের অদ্ভুত প্রেম আকর্ষণে ও তাঁর পূতসঙ্গ লাভের জন্য  তাঁরা কাশীপুরে উপস্থিত থাকেন। ছুটির দিনগুলিতে বাড়তে থাকে  ভক্তের সংখ্যা। অসুস্থতার মধ্যেও শ্রীরামকৃষ্ণের মুখনিঃসৃত কথা শোনার জন্য ভক্তদের ছিল নিত্য আনাগোনা। সকাল থেকেই নানা জন আসেন তাঁর  সান্নিধ্যে লাভ করে কৃপা প্রার্থনা করতে। 
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে শ্রীরামকৃষ্ণের শারীরিক অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে তিনি বাড়ির নীচে নামতে পারেননি। তবু ভক্তদের আসার বিরাম নেই।  ইংরেজি নববর্ষের দিন সকাল থেকেই অনেক গৃহী ভক্ত উপস্থিত হলেন কাশীপুরে শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভের আশায়। দুপুরে আহারের শেষে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রোদ ঝলমলের দুপুরে শ্রীরামকৃষ্ণ নীচে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। ভক্তরা বাগানের চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে তখন গল্পে ব্যস্ত। ভাইপো রামলালের সঙ্গে দোতলা থেকে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তখন বেলা তিনটে, দুপুরের রোদ্দুরে সামান্য হাঁটাহাঁটি করার জন্য তাঁর নেমে আসা। ‘সেই দিনকার রূপের কথা স্মরণ হলে আমরা এখনো আশ্চর্য হয়ে থাকি। তাঁর সর্ব শরীর বস্ত্রাবৃত এবং মস্তকে সবুজ বানাতের কান ঢাকা টুপি ছিল। কেবল মুখমণ্ডলের জ্যোতিতে দিগমণ্ডল আলোকিত হইয়াছিল’ সেদিন উপস্থিত রামচন্দ্র দত্ত তাঁর স্মৃতি কথায় এইরকম সচিত্র বর্ণনা দিয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে রাস্তা দিয়ে আসতে দেখে গিরিশচন্দ্র ঘোষ জুতো খুলে সেখানেই  সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করেন। ভক্ত গিরিশের কাণ্ড দেখে প্রসন্ন বদনে শ্রীরামকৃষ্ণ তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি যে সকলকে এত কথা বলে বেড়াও (নিজেকে দেখিয়ে), তুমি কি দেখেছ? কি বুঝেছো?
হাঁটু মুড়ে বসে জোরহাত করে গিরিশ বলতে থাকেন, ‘ব্যাস বাল্মীকি যার ইয়াত্তা  করতে পারেনি আমি তাঁর সম্বন্ধে বেশি কি আর বলতে পারি।’ ভক্ত গিরিশের মুখে এই সরল উপলব্ধির কথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে ফুটে ওঠে এক অদ্ভুত হাসি। দিব্য হাসি মাখা সেই রূপ দেখে ভক্তরা বাগানের গাছ থেকে ফুল তুলে এনে তাঁর চরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করেন। মুহূর্তে অসুস্থ  শ্রীরামকৃষ্ণের চোখে মুখে ফুটে ওঠে এক দিব্য কান্তি। সহাস্যে  তিনি বলে ওঠেন, ‘তোমাদের আজ কি বলিব, আশীর্বাদ করি তোমাদের চৈতন্য হোক।’
এক অপূর্ব দিব্য ভাবে আবিষ্ট শ্রীরামকৃষ্ণ এরপর উপস্থিত সকল গৃহী ভক্তকে স্পর্শ দিয়ে কৃপা আশীর্বাদ করতে থাকেন। তাঁর পূত স্পর্শের প্রভাবে উপস্থিত সকলের মনে এক অদ্ভুত ভাবান্তর অনুভব হতে থাকে। কোনও ভক্ত হাসতে থাকেন, কারও চোখ থেকে ক্রমাগত আনন্দের অশ্রু বিসর্জন হতে থাকে। উপস্থিত হরিশ মোস্তাফি চোখের জলে আনন্দে রামচন্দ্র দত্তকে বলে ওঠেন, ‘ভাইরে! আমার আনন্দ আর ধরে না।’ 
এই ভাবাবেশ কিছুটা সংবরণ করার পর উপস্থিত অক্ষয় কুমার সেন, নবগোপাল ঘোষ, উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, রামলাল চট্টোপাধ্যায় উপেন্দ্রনাথ মজুমদার, অতুল কৃষ্ণ ঘোষ সহ অনেককে একে একে কৃপা করতে থাকেন। কৃপায় উচ্ছ্বসিত ভক্তরা চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘তোরা কে কোথায় আছিস আয় প্রভু আজ কল্পতরু হয়েছেন।’ বেশ কিছু সময় ধরে শ্রীরামকৃষ্ণ দিব্য ভাব অবস্থায় ভক্তদেরকে অকাতরে কৃপা করতে থাকেন। ভক্তদের মনে থাকা বাসনা পূরণের আশীর্বাদ পেতে থাকে সকলে। এই দিন শ্রীরামকৃষ্ণ যেন তাঁর কৃপার ডালি উজার করে দিয়েছিলেন উপস্থিত সব গৃহী ভক্তদের মাঝে। ভক্তদের কাছে তিনি সেদিন হয়ে উঠেছিলেন শাস্ত্রে বর্ণিত কল্পতরুর জীবন্ত বিগ্রহ। রাত জেগে সেবা করার কারণে ত্যাগী ভক্তরা তখন অধিকাংশই ছিলেন বিশ্রামে। শ্রীরামকৃষ্ণ নীচে নেমে আসায় তাঁর বিছানার লেপতোষক রৌদ্রে দেওয়ার সময় দোতলা থেকেই  লাটু নজর করেন এই ঘটনা। 
দক্ষিণেশ্বরে থাকাকালীন শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন বলেছিলেন, যাওয়ার আগে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে যাব। ইংরেজি নববর্ষের সূচনার দিনের গৃহী ভক্তদের অকাতরে কৃপা বিতরণকে শ্রীরামকৃষ্ণ পুঁথিকার অক্ষয় কুমার সেন এইভাবে উল্লেখ করেছেন,
প্রভুর প্রতিজ্ঞা ছিল শুন বিবরণ।/ হাটেতে ভাঙ্গিব হাঁড়ি যাইব যখন।।/ সেই হাঁড়ি-ভাঙ্গা রঙ্গ আজিকার দিনে।/ কীভাবে ভাঙ্গিলা হাঁড়ি শুন এক মনে।।
শ্রীরামকৃষ্ণ আধুনিক যুগের আধুনিকতম অবতার। তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে  ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত কলকাতার মানুষজন দলে দলে  জড়ো হয়েছিলেন। তৎকালীন ইংরেজ শাসনের রাজধানী কলকাতায়, শ্রীরামকৃষ্ণ নিজেকে মেলে ধরার জন্য তাই যেন ইংরেজি নতুন বছরের দিনটিকে বেছে নিয়েছিলেন। ভক্তদের কাছে এই দিনটিতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন কল্পতরু। রামকৃষ্ণের অবতার লীলায় আমরা দেখি বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন সময় তিনি কৃপা করেছেন। তাই ভক্তদের কাছে তিনি ছিলেন নিত্য কল্পতরু। স্বামী শিবানন্দ বলতেন, ‘তিনি (রামকৃষ্ণ) সদাই তো কল্পতরু। জীবকে কৃপা করাই তাঁর একমাত্র কাজ ছিল। আমরা তো চোখের সামনে দেখেছি, তিনি নিত্যই কত জীবকে কত ভাবে কৃপা করতেন। হ্যাঁ কাশীপুর বাগানে এই দিনে তিনি একসঙ্গে অনেক ভক্তকে কৃপা করেছিলেন। সে হিসেবে এই দিনটির একটা বিশেষত্ব আছে। তিনি যে কৃপাসিন্ধু তা সেদিনকার ঘটনায় ভক্তরা বিশেষ করে বুঝতে পেরেছিলেন।’ ইংরেজি বছর শুরুর দিনটিতেই নতুন বছরের সূচনায় তাঁর এই কৃপাবিতরণে ধন্য অনেকেই পরবর্তীকালে তাঁদের অভিজ্ঞতা লিখে গিয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথ মজুমদার লিখছেন, ‘বৈকাল বেলায় আপনি কল্পতরু হয়ে বসলেন।... আপনি যাচিয়া যাচিয়া সকলকে কৃপা করিতে লাগলেন। আর বক্ষ কাহারো মস্তক স্পর্শ করিলেন, কাহারো কানে কানে কি বললেন।’ ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি কাশীপুরে সেই সময় উপস্থিত ছিলেন প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন গৃহী ভক্ত। ওইদিন উপস্থিত বৈকুণ্ঠ সান্যাল পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, কল্পতরু তুল্য করুণা-বিতরণ দর্শনে অল্পবুদ্ধি বৈকণ্ঠ মুগ্ধ হইয়া ‘কে কোথায় আছিস আয়’ বলিয়া রব তুলিলে প্রভু তাহাকে নিরস্ত হইতে ইঙ্গিত করায়, যেন আরো কিছু পাওয়ার প্রত্যাশায় সম্মুখে দাঁড়াইলে স্মিত মুখে কহেন, ‘তোর তো আগেই সব হয়ে গেছে।’ রামকৃষ্ণ তাঁর সরল সুন্দর উপমা দিয়ে কল্পতরু কী তা ভক্তদের বুঝিয়েছিলেন। কল্পতরুর কাছে কী আর কীভাবে চাইতে হয় তাও আগে থেকে ভক্তদের কথার ছলে শিখিয়ে রেখেছিলেন লোকশিক্ষক রামকৃষ্ণ। কাশীপুরে সেই দিনের এই ঘটনাকে, তাঁর আত্মপ্রকাশের অভয় প্রদান বলে বর্ণনা করেছেন স্বামী সারদানন্দ। শ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ বইটিতে তিনি রামকৃষ্ণের দুটি সত্তার কথা উল্লেখ করেছেন, ‘ঠাকুরের (শ্রীরামকৃষ্ণের) দুটি ভাব আছে। একটা মানুষ ভাব। অন্যটির দিব্য ভাব। মানুষ ভাবে তিনি সকলের উপর অত্যন্ত সহানুভূতিপূর্ণ। যারা তাঁর কাছে আসতো তাদের সকল দুঃখ দূর করতে সচেষ্ট।’ অসুস্থ অবস্থাতেও তাঁর এই দুটি ভাব বিদ্যমান ছিল। তাই তিনি সেদিন দিব্যভাবে বিভোর হয়ে জগৎবাসীকে অভয় প্রদান করেছিলেন। বলেছিলেন— ‘তোমাদের চৈতন্য হোক।’
3d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাজকর্মে উন্নতি। ব্যবসায় গতি বৃদ্ধি। ব্যবসা ক্ষেত্রে লগ্নিবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সাফল্য। সন্তান বিষয়ে কোনও সুখবর পেতে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.৯৬ টাকা৮৬.৭০ টাকা
পাউন্ড১০৪.৫৩ টাকা১০৮.২৪ টাকা
ইউরো৮৬.৫১ টাকা৮৯.৮৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা