বিশেষ নিবন্ধ

নতুন বছরে বঙ্গীয় বাবুসমাজ আত্মসমীক্ষা করুক
সমৃদ্ধ দত্ত

বঙ্গীয় বাবুসমাজের সবথেকে বড় গর্ব হল, ‘আই নো অল’ মনোভাব। তাদের নিশ্চিত বিশ্বাস যে, তারা সব জানে। বাবুসমাজের প্রিয় শখ হল কারণে অকারণে অন্যদের অসম্মান ও অপমান করা। কারণ তাদের ধারণা অপমান করলেই জয়ী হওয়া যায়। তাই সারাক্ষণ ভুল ধরা অথবা সব বিষয়ে নাক গলানো কিংবা অবিরত সব কাজে ত্রুটি খুঁজে বেড়ানো চরিত্রদের বাবুসমাজ নাম দেয় ‘বিধবা পিসিমা’। যারা সারাক্ষণ অন্যের ভুল ধরে, বাবুসমাজ তাদের ঠেস দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে বাঙালি পরিবারের একটি দুখী চরিত্রকে। উদাহরণ হিসেবে মনোনীত করেছে ‘বিধবা পিসিমা’। যেন বিধবা পিসিমা মাত্রই এরকম। ভালো বিধবা পিসিমা যেন হতে নেই। কেউ যদি কম স্মার্ট, সরল হয় এবং তুলনায় বুদ্ধিতে পিছিয়ে থাকে, বাবুসমাজ তাদের চিরকাল বলে এসেছে ‘গ্রাম্য’। বাবুদের কাছে গেঁও মানে বোকা। বোকা মানে বিদ্রুপযোগ্য। অর্থাৎ গ্রামের বাসিন্দাদের কেউ যেন বুদ্ধিমান হতে পারে না! গ্রাম্য মানেই সে বোকা। 
যে কোনও নতুন বছরের শুরুতেই একটি প্রিয় খেলার চর্চা করে শহুরে বাবুসমাজ। তাকে বলা হয় নিউ ইয়ার রেজোলিউশন। নতুন বছরের প্রতিজ্ঞা। কেউ বলে সিগারেট ছেড়ে দেব, কেউ বলে রোজ ভোরে উঠে হাঁটব, কেউ বলে মোবাইল কম ব্যবহার করব, কেউ বলে বেশি বই পড়ব, কেউ বলে খাবারদাবারে সংযত হব ইত্যাদি। বঙ্গীয় বাবুসমাজের উচিত নতুন বছরে রেজোলিউশন নেওয়া, হুজুগে গা ভাসাব না, পরিণতমনস্ক হব এবং ফেক নিউজ চিনে ফেলব। যে কোনও ঘটনাকে নিজের বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে বিচার করব। আমাকে কেউ মানসিকভাবে চালনা করবে সেই অপমান মেনে নেব না। যে কোনও ঘটনার কার্যকারণ খতিয়ে দেখব। 
এই প্রতিজ্ঞা করার প্রয়োজনীয়তার কারণ বিগত বছরে বাবুসমাজ নিয়ম করে গুজবে ভেসেছে। উৎসাহ সহকারে ফেক নিউজ বিশ্বাসও করেছে, শেয়ারও করেছে। বাবুসমাজ হুজুগের সবথেকে বড় উপভোক্তা। তারা আছে বলেই হুজুগ ও গুজব বেঁচে আছে। ভোটের ফলাফল হোক অথবা রাজনৈতিক তথা সামাজিক ঘটনার গতিপ্রকৃতি— বাবুসমাজকে ভেবে দেখতে হবে বারংবার প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাদের পূর্বাভাস ভ্রান্ত প্রমাণিত হয় কেন? তাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং-এ ভুল হচ্ছে কেন? তারা যা ভেবেছে সেটা আসলে মিথ্যা এরকম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে কেন? 
সন্দেশখালি অথবা আর জি কর। এই দুই ইস্যু বাবুসমাজকে বড়সড় চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। তাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে যে, ওই দুই ইস্যুতে তাদের মনোভাব ঠিক কী ছিল? এবং পরবর্তীকালে সেই মনোভাবের স্বপক্ষে কোনও ঘটনাপরম্পরা অগ্রসর হল না কেন? কেন নিজেরাই নিজেদের অবস্থান এবং জোরালো মনোভাব থেকে ক্রমে পিছিয়ে এল তারা? কেন শুরুতে যতটা আগ্রাসী ছিল, শেষে ততই উদাসীন হয়ে গেল? যে ঘটনাগুলিকে মনে করা হচ্ছিল শতাব্দীর ইস্যু, কেন সেগুলি কয়েকমাসের মধ্যেই স্তিমিত হয়ে গেল? কেন ভোটে তা সামান্যতম প্রভাব ফেলল না? কেন তাদের এজেন্ডাকে বৃহত্তর গ্রামীণ, সাবঅলটার্ন এবং নিম্নবিত্ত সমাজ গ্রহণই করছে না? কেন বাবুসমাজ আর সমাজের ওপিনিয়ন মেকার হতে পারছে না? 
এই দুই ইস্যুর অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কিন্তু নিছক জঘন্যতম একটি অপরাধ ঘটেছে এবং তার শাস্তি চাই, এই কঠোর অবস্থানেই বাবুসমাজ নিজেদের সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়নি। তারা লক্ষ্যের থেকে উপলক্ষ্যে বেশি করে উৎসাহী হয়ে পড়েছিল। অপরাধটা যেখানে নিজেই যথেষ্ট ঘৃণ্য, সেখানে অতিরিক্ত গুজবের দরকার পড়ল কেন? একটাই দাবি যুক্তিসঙ্গত, অপরাধীর শাস্তি চাই। কিন্তু বাবুসমাজ অপরাধ ছেড়ে গুজব, ফেক নিউজ এবং থ্রিলারের পিছনেই ছুটে গেল কেন? কারণ বাবুসমাজের নাটকীয়তা পছন্দ। নিস্তরঙ্গ জীবনে উত্তেজনা পছন্দ। এবং ইভেন্ট পছন্দ। আজ রাতদখল। কাল নাটক কবিতায় প্রতিবাদ। পরশু অরন্ধন। একটি চরম দুর্ভাগ্যজনক ও মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদ করতে কারা অর্ডার দিয়ে বিশেষ কালো রঙের পোশাক তৈরি করে? কারা ড্রেস কোড তৈরি করে রাস্তায় নামে যাতে ক্যামেরায় দেখতে ভালো লাগে? কারা বিচার চাওয়ার পরিবর্তে গান, কবিতা, নাটক, স্লোগান, পোস্টার, নৃত্যকলার মাধ্যমে আসলে নিজেদের প্রতিভা প্রদর্শনেই বেশি আগ্রহী হয়ে পড়ে? দাঁতে দাঁত চেপে সবরকম সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করা হল না কেন? কেন নাগরিকদের দাবি আসলে কিছু স্বার্থান্বেষী ডাক্তারের ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের দাবিতে পর্যবসিত হল? অথচ সেইসব নাগরিক বুঝতেই পারল না যে তারা ফাঁদে পা দিয়েছে? কারণ অন্ধ একটি রাজনৈতিক বিরোধিতা এই তাবৎ কাজের চালিকাশক্তি ছিল। তারা বিচার চায়নি। নির্দিষ্ট ব্যক্তির অপসারণ চেয়েছে। তাই ভেবে দেখেনি যে জুডিশিয়াল সিস্টেম কীভাবে চলে। উল্টে আজগুবি নানারকম তত্ত্ব, ভিডিও, অডিও এবং প্রচারকে ধ্রুবসত্য ভেবে এসেছে। 
বাবুসমাজ মনে রাখুক যে, আমার যাকে ইচ্ছা তাকে ভোট দেব, সমর্থন করব, সরকারের সবরকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করব। বিরোধিতা করব। আবার ভালো কাজের সমর্থনও করব। কিন্তু আমার বুদ্ধিকে অন্য কেউ যেন নিজেদের স্বার্থে কোনও ঘটনাতেই চালনা করতে না পারে। এই বুদ্ধি ও সতর্কতা অর্জন করব নতুন বছরে। 
বাবসুমাজ দুর্গাপুজোকে বয়কট করে একমাস পরই গানমেলা, বইমেলা, সিনেমামেলা, ক্রিসমাস মেলা, নিউ ইয়ার্স মেলায় গা ভাসিয়েছে। বাবুসমাজ এভাবে নিজেকেই অপমান করেছে সবথেকে বেশি। আর এই কারণেই বাবুসমাজের গুরুত্ব কমছে সমাজের বৃহত্তর মানুষের কাছে। বাবুসমাজ নিজেরা ঩নিজেদের সিরিয়াসলি নেয় না। তারা জানে আজ যা বলছি, সামনের সপ্তাহে তার উল্টো কথা বলব। কেন? কারণ বাবুসমাজ মোমেন্টে বাঁচে। দীর্ঘমেয়াদি সংযম, দৃষ্টিভঙ্গি, গভীরতা এবং অন্তর্দৃষ্টি নেই। 
বাবু সমাজকে কি দেখা যাচ্ছে রবি হাঁসদাকে নিয়ে মাতামাতি করতে? দেখা যাচ্ছে না। কেন? কারণ, রবি হাঁসদা অনুশীলনের পূজারি। ধৈর্যের পূজারি। সংযমের পূজারি। পূর্ব বর্ধমানের ভাতার থানার মশারু গ্রামের রবি হাঁসদা বছরের শেষে বাংলাকে, বাঙালিকে ফুটবলে ভারতসেরার তকমা পাইয়ে দিলেন সন্তোষ ট্রফির ফাইনালে অনবদ্য গোল করে। তাঁর মা এখনও জমিতে চাষের কাজ করেন। এখনও রবি হাঁসদার নির্দিষ্ট চাকরি নেই। কিন্তু তিনি নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন নিজের প্রতিভাকেই অবলম্বন করে। বাবুসমাজের কোনও প্রতিনিধি কিন্তু বাংলার গর্ব কিংবা ভারতশ্রেষ্ঠ হতে পারছে না। অথচ রবি হাঁসদাকে সংবর্ধনা দেওয়ার কোনও ঢল পড়ছে না উচ্চবর্গের সমাজে। 
বাবুসমাজ বাংলায় থাকে। কিন্তু বাংলা ও বাঙালির স্বাজাত্যবোধ অর্জন করতে পারছে না। দক্ষিণ ভারতের কোনও শহরের বিবাহে উত্তর ভারতীয় স্টাইলে রোকা, সঙ্গীত, মেহেন্দি হচ্ছে কল্পনাই করা যায় না। বাংলায় হয়। বাবুসমাজ হিন্দি এবং ইংরেজিতে অবাধে কথা বলাকে শিক্ষা ও স্মার্টনেস ভাবে। কেন? কারণ তাদের অনেকে বাংলা ভাষায় প্রাঞ্জলভাবে কথা বলতে পারে না। তাই আমরা বহু বঙ্গীয় নব্য সেলেব্রিটির কথাকে মন দিয়ে শুনলে বুঝতে পারি যে, তারা বাংলা বাক্য গঠনে, শব্দচয়নে এবং না থেমে সুসংহত ও সুসংবদ্ধ বাংলার ব্যবহার করতে অপারগ। 
সেলেব্রিটি নয় এমন বাবুসমাজের মধ্যেও এই একই প্রবণতা। তাই কথোপকথনের মাঝে হিন্দি ও ইংরেজিকে প্রবেশ করাতে হয়। ওটা এমন নয় যে, তারা হিন্দি ও ইংরেজি ভালো জানে। আসল কারণ বাংলা একটানা বলার মতো শব্দভাণ্ডার মস্তিষ্কের হার্ড ডিস্কে সঞ্চিতই নেই। এও এক কঠিন অনুশীলন। অভ্যাসের চর্চা। কিন্তু পক্ষান্তরে দেখা যায় যে, কেউ যদি গুছিয়ে কথা বলতে না পারে, কেউ যদি বুদ্ধিদীপ্ত যুক্তি দিতে ব্যর্থ হয়, বাবুসমাজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘চাষার মতো কথা বলিস না’। কাউকে যদি মনে হয় সে কোনও কাজে পারঙ্গম নয়, তাকে কী পরামর্শ দেয় বাবুসমাজ? ‘যা, মাঠে গিয়ে লাঙল ঠেল, এসব কাজ তোর কম্ম নয়’ অর্থাৎ চাষি যেন কিছু জানে না। চাষির কাজ যেন কাজই নয়। তাহলে সব জানে কারা? বাবুসমাজ! নতুন বছরে বাবুসমাজ আত্মসমীক্ষা করুক। শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের চেষ্টা করুক। বুদ্ধি ও জ্ঞানের চর্চা করুক। হুজুগ এবং অ্যাটেনশন সিকিং মনোভাব থেকে দূরে থাকুক। 
বাবুসমাজ ১ জানুয়ারি কাশীপুর উদ্যানবাটিতে ভিড় জমায়। কিন্তু ওই দিন যে বাক্যটি এই উদ্যানে ভাবীকালের জন্য বলে গিয়েছিলেন যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ, সেই ‘চৈতন্য হওয়ার’ আশীর্বাদটি ভুলে থাকে সারাবছর!
2d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাজকর্মে উন্নতি। ব্যবসায় গতি বৃদ্ধি। ব্যবসা ক্ষেত্রে লগ্নিবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সাফল্য। সন্তান বিষয়ে কোনও সুখবর পেতে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.৯৩ টাকা৮৬.৬৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.৭২ টাকা১০৮.৪৪ টাকা
ইউরো৮৬.৮১ টাকা৯০.১৭ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা