বিদায় নিল আরও একটি বছর, ২০২৪। আজ, নতুন সালে পা রেখে আমরা বুঝে নিতে চাই—বিদায়ী বছরে কী পেয়েছি আর কী হারিয়েছি এবং আরও কী কী নিতে পারতাম তার ঝুলি থেকে কিন্তু নিতে পারিনি।
প্রথমেই মনে আসে তিনটি উল্লেখযোগ্য নাম—বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, রতন টাটা ও মনমোহন সিং। তাঁদের পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। গত পাঁচমাসের ভিতরে তাঁরা একে একে প্রয়াত হয়েছেন। রাজনীতি-প্রশাসন এবং শিল্প-বাণিজ্য জগৎ তাঁদের শূন্যতা বহুকাল অনুভব করবে। এছাড়া দেশজুড়ে ঘটে গিয়েছে অজস্র ঘটনা, দুর্ঘটনা। তাতে অসংখ্য সহনাগরিককে হারাতে হয়েছে আমাদের। বন্ধুত্ব বৃদ্ধির জায়গাতেও ২০২৪ সাল আমাদের হতাশ করেছে। ঐতিহাসিকভাবে একাধিক বন্ধু দেশ বিরূপ হয়েছে আমাদের প্রতি। এত এত ক্ষয়ক্ষতির সবটাই ‘গ্রহের ফের’ ছিল না, বেশিরভাগের জন্য আমাদের ভুল, অপরাগতা কিংবা ব্যর্থতাকেই দায়ী করা চলে।
তবে প্রাপ্তির ভাঁড়ারও ছোট নয়। ভারতের বহু কৃতীসন্তান দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাতে ভারতের সুনাম বৃদ্ধি হয়েছে অনেক। বিজ্ঞানের নানা ক্ষেত্রে ভারতের দুর্দান্ত অগ্রগতি চিহ্নিত হয়েছে। তার মধ্যে অবশ্যই রাখতে হবে মহাকাশ বিজ্ঞানকে। ইসরোর হাত ধরে মহাকাশ বিজ্ঞানে ভারত ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল ২০২৩-এ। চন্দ্রযান-৩-এর সফল অভিযানের মাধ্যমে চাঁদের কুমেরু অঞ্চলে ভারতই প্রথম পা রাখতে পেরেছে। একইসঙ্গে চাঁদের মাটিতে মহাকাশযান অবতরণকারী চতুর্থ দেশের (রাশিয়া, আমেরিকা ও চীনের পরেই) স্বীকৃতি পেয়েছি আমরা। এই সাফল্যকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২০২৪-এ ব্রতী ছিলেন ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। ইসরোর পাইপলাইন প্রজেক্টগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম ‘গগনযান’। ২০১৮ সালে স্বাধীনতা দিবসে ‘গগনযান-২০২২’ প্রকল্প ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তার প্রেক্ষিতে ইসরো জানিয়েছিল, তিনজন ভারতীয় মহাকাশচারীকে নিয়ে ২০২২ সালে শ্রীহরিকোটার উৎক্ষেপণ কেন্দ্র থেকে ওই মহাকাশযান ছাড়া হবে। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিমি উপরে পৃথিবীর কক্ষপথে মহাকাশচারীরা অবস্থান করবেন তিনদিন। অবশেষে সমুদ্র উপকূলের কোনও স্থানে তাঁদের নিরাপদ অবতরণের ব্যবস্থা করা হবে। প্রকল্পটি সফল হলে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের পর ভারতই নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাকাশে নভশ্চর প্রেরণকারী চতুর্থ দেশের স্বীকৃতি পাবে। কিন্তু প্রযুক্তি বিষয়ক অত্যন্ত কঠিন এই চ্যালেঞ্জে ভারত এখনও চূড়ান্তভাবে সফল হয়নি। নিষ্ঠাবান ভারতীয় বিজ্ঞানীরা তাঁদের সাধনায় অবিচল। আশা করা যায়, এই গর্বের প্রকল্পে ভারত ২০২৫-এ আরও অনেকটাই অগ্রসর হতে পারবে।
পশ্চিমে পাকিস্তান, পুবে বাংলাদেশ। এছাড়া আশপাশে আছে আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো নানা মাপের দেশ। বস্তুত এই প্রতিবেশী দেশগুলির কোনোটিতেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত নয়। সর্বক্ষণের গদির লড়াই এমন কদর্য হয়ে আছে যে দেশগুলির নাগরিকরা জানে না, পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কার হুকুম তামিল করতে বাধ্য হবে তারা। কবে কার গলা কাটা যাবে, এই ভয় নিয়েই রাতে ঘুমোতে যায় অনেকে। এরকম এক ভয়াবহ পরিবেশ পরিস্থিতির মধ্যেও ২০২৪-এ আমরা দেশে নতুন নির্বাচিত সরকার পেয়েছি। নিশ্চয় আরও ভালো মানের সরকারের প্রত্যাশা অনেকের ছিল, কিন্তু যা পেয়েছি তাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে এটা তৃতীয় এনডিএ সরকার। প্রথম দুটি সরকারে বিজেপি ছিল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের গুরুঠাকুর হল আরএসএস। ওই হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের এজেন্ডা পূরণ করতে নেমেই গত এক দশকে মোদি সরকার অনেক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। তার জন্য দেশকে যা মূল্য দিতে হয়েছে তা অপরিমেয়। বিশেষ করে নষ্ট হয়েছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং বেড়েছে ধনবৈষম্য ও রাজনৈতিক দুর্নীতি। অযোধ্যায় রামমন্দির আন্দোলন দিয়েই জাতীয় রাজনীতিতে প্রথম নজর কেড়েছিল বিজেপি। পরবর্তী ইতিহাস অনেক অশান্তির ও সুদীর্ঘ এবং তা সকলেরই জানা। গত ২২ জানুয়ারি রামলালার মূর্তিতে প্রাণপ্রতিষ্ঠাসহ অযোধ্যায় মন্দিরের উদ্বোধন করেন মোদি স্বয়ং। তার কয়েকমাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এবং মোদিকে রামমন্দির কোনও ডিভিডেন্ড দেয়নি। উল্টে কেন্দ্রে শক্তিক্ষয় হয়েছে বিজেপির। ২০২৪-এ হ্যাটট্রিক করেও মন খারাপ মোদির, কেননা, এবার তাঁর সরকারের ভাগ্য সমর্পিত তেলুগু দেশম পার্টির চন্দ্রবাবু নাইডু এবং জনতা দল ইউনাইটেড সুপ্রিমো নীতীশ কুমারের হাতে।
তবুও কি ক্ষান্ত হবে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা? ভারতের একজনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যত্রতত্র মসজিদের নীচে হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেতে চায় না। এবার অন্তত বন্ধ হোক সম্ভল কাণ্ড। আর চাই না এখলাক, বিলকিস বা সিদ্দিক কাপ্পানের জীবনে নেমে আসা একটিও দুর্ভাগ্য। ভক্তি হল ভিতরের সত্য। তাহলে রামভক্তি প্রদর্শনের নামে যাকে তাকে পাকড়ে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য করা হবে কেন? এতে যে ভগবান রামচন্দ্রকেই ছোট করছে মূর্খরা! কঠোর প্রশাসনের নামে বুলডোজ নীতি এবং এনকাউন্টাররাজেরও আশু অবসান কাম্য। পঁচিশে পৌঁছে গিয়েছেন—মোদিই প্রতিজ্ঞা করুন, চমক সৃষ্টির নেশা ছেড়ে তিনি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক প্রশাসন উপহার দেবেন আমাদের। দল এবং সরকারের মাথা তিনি। মাথা ঠিক কাজ করলে বাকি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও স্বাভাবিক কাজ করবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।
মোদি ক্ষমতাসীন হয়েছেন সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। সংবিধানে একনায়কতন্ত্রের কোনও স্বীকৃতি নেই। কিন্তু মোদি শুরু থেকেই নিজেকে একনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া। আর তাঁর এই অন্যায় স্বপ্নের বলি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। সিঙ্গল ইঞ্জিন, ডাবল ইঞ্জিন তত্ত্বের আমদানি এই অগণতান্ত্রিক চিন্তার সূত্রেই। মোদির এই তুঘলকিপনার সবচেয়ে বড় শিকারের নাম পশ্চিমবঙ্গ। ১০০ দিনের কাজ এবং গরিবের জন্য পাকাবাড়ি তৈরির প্রকল্পে বাংলার লক্ষ লক্ষ গরিব পরিবার টানা বঞ্চনার শিকার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনদরদি সরকারকে বিপাকে ফেলতেই এই অন্যায় রাজনীতি। এমনকী, বাংলাকে টুকরো করার খেলাতেও মেতে রয়েছে বিজেপি এবং মোদি সরকার। তাদের এই বোধ কেন হচ্ছে না যে পশ্চিমঙ্গের অখণ্ডতার প্রশ্নে সবাই এককাট্টা? বিজেপি সত্যিই যদি এখানে রাজনীতি করতে চায় তবে বাংলার অখণ্ডতা মেনে নিয়েই তাকে তা করতে হবে।
২০২৪-এই বাংলাদেশে পতন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। সেখানে বহাল এখন অর্থনীতিবিদ মহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সব মিলিয়ে কয়েকমাস যাবৎ এক নারকীয় অস্থিরতা গ্রাস করেছে দেশটিকে। পঁচিশের অ্যতম প্রার্থনা বাংলাদেশে গণতন্ত্র। নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চাই ওপার বাংলায়। আগামী নির্বাচনে ওদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির সর্বতোঅংশগ্রহণ জরুরি। কোনও কৌশলে একটিও প্রধান রাজনৈতিক শক্তিকে এড়িয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রহসন বলেই নিন্দিত হবে। এটি আর একান্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। এর সঙ্গে ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গসহ দেশের সমগ্র পূর্বাঞ্চলের সম্পর্কটি প্রত্যক্ষ। কারণ বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেরি হলে সেখানে পাক মদতপুষ্ট উগ্র মুসলিম মৌলবাদী এবং স্বৈরতান্ত্রিক শক্তি অনেক বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। তাতে আরও বিপন্ন হতে পারে সে-দেশের হিন্দুসহ সমস্ত সংখ্যালঘু শ্রেণি। বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে হিন্দুসহ সংখ্যালঘু জনতার বিপন্নতার কী প্রভাব বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের উপর পড়ে, তা আমরা জানি এবং এ এক ঐতিহাসিক সত্য।
শান্তি ফিরুক সুন্দর মণিপুরে এবং সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। শত্রু নয়, বন্ধুবৃদ্ধি হোক ভারতের, বিশেষ করে চারধারে প্রতিবেশী মহলে বা দক্ষিণ এশিয়ায়। নিছক সংখ্যায় বৃদ্ধি যে কাজের কাজ কিছু নয়, জনসংখ্যায় ‘বিশ্বকাপ’ পেয়েই মালুম হয়েছে আমাদের। অলিম্পিক, বিশ্বকাপ ফুটবল প্রভৃতি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এই বৃদ্ধি কোনও কাজে আসেনি। আমাদের আগামীর সাধনায় গুরুত্ব পাক বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্য থেকে মুক্তি এবং মাথাপিছু আয় ও জিডিপি বৃদ্ধি। ক্ষুধা, সুখ, স্বচ্ছতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের মান প্রভৃতি প্রশ্নেও ধারাবাহিক লজ্জা দূর হয় যেন আমাদের। সব রাজ্যের এবং দেশের উন্নয়নের প্রশ্নে পার্টিগুলি যেন সংকীর্ণ দলাদলির ঊর্ধ্বে ওঠার বেনজির দৃষ্টান্ত রাখতে পারে এবার। অতল থেকে উঠে আসার ব্যাপারে দেশকে আরও সুন্দর দিশা দেখাতে পারে যেন আমাদের সকলের প্রিয় বাংলা। পঁচিশের একান্ত প্রার্থনা—সুন্দর বাংলার সঙ্গে অগ্রণী ভারত এবং প্রতিবেশ, সব মিলিয়ে এক বাসযোগ্য পৃথিবী।