পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ বেজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে পা রেখেছিলেন ২০০৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। সেদিন তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে একটি বিশাল ঘড়ি লাগানো হয়েছিল। ঘড়ির কাঁটা চালু হয়েছিল ১ হাজার ৪১৭ দিন গণনার জন্য। লক্ষ্য ২০০৮-এর গ্রীষ্মকালীন ওলিম্পিক্স। চীনের নেতারা তিয়েনআনমেন স্কোয়ারকে দমন-নিপীড়নের প্রতীক থেকে মুক্ত করে দেশের উদার, মুক্ত পরিবেশ এবং নতুন শক্তির প্রতীকে পরিণত করতে চেয়েছিলেন।
ওলিম্পিক্স আয়োজন করে গোটা দুনিয়ায় নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চেয়েছিল চীন। এই আয়োজন তাদের অর্থনৈতিক সংস্কারেরও প্রতিনিধিত্ব করবে, এমন ভাবনা নিয়েই এগিয়েছিলেন চীনের নেতারা। ওলিম্পিক্সের কয়েক মাস আগে চীনের নেতারা একটি নিউ ডিজনিল্যান্ড তৈরির পরিকল্পনা করেন। একইসঙ্গে তাঁদের দেশের ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ইংরেজি শেখার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেন পর্যটকদের কোনও অসুবিধা না হয়। তিয়েনআনমেনের ইতিহাস ভুলে বিশ্ব যেন নতুন চীনকে চিনতে পারে, সেই প্রচেষ্টায় কোনও খামতি ছিল না।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সাংবাদিক এরিখ শোয়ার্টজেলের তাঁর ‘রেড কার্পেট: হলিউড, চায়না অ্যান্ড দ্য গ্লোবাল ব্যাটল ফর কালচারাল সুপ্রিমেসি’ বইয়ে লিখছেন, হলিউডে তখন ভিন্ন এক ঘড়ি টিকটিক করছিল। একসময়ের নিশ্ছিদ্র ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় ফাটল তৈরি হচ্ছিল। হলিউডে তখন সাংস্কৃতিক বাঁক পরিবর্তনের সময় চলছিল। হলিউডকে টিকতে হলে প্রয়োজন ছিল চীনের বিশাল বাজার। আর বেজিংও চাইছিল, হলিউড চীনের দিকে
ঝুঁকতে বাধ্য হোক। ওলিম্পিক্সে প্রবেশ করার
আগে চীনের নেতারা এই ভাবনা থেকেই থিম
পার্কের চিন্তা করেছিলেন।
২০০৮ সালে ডিজনি কর্তা রবার্ট ইগার সাংহাই কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ইউ ঝেংশেংয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি তাঁর কোম্পানিকে চীনে প্রবেশ করতে দু’টি বড় ছাড় দেন। একটি ছিল, চীনা কোম্পানি ডিজনি থিম পার্কের ৫৭ শতাংশ শেয়ারের মালিক হতে পারবে। এছাড়া রুম ভাড়া, থাকা-খাওয়া এবং মিকি মাউসের টুপি কেনা থেকেও ব্যবসা করতে পারবে চীনা কোম্পানি। দ্বিতীয়টি ছিল, চীনের এয়ারওয়েবের অনুমতি পেতে ডিজনি চ্যানেলে নিজেদের প্রচার বাদ দেবেন। চীনের নেতারা সেখানেই থেমে থাকেননি। তাঁরা তাঁদের নাগরিকদের জন্য ডিজনিতে আরও সুযোগ সুবিধে বাগিয়ে নিয়েছিলেন। তারপরও হলিউডের কোম্পানিগুলির জন্য চীনের বাজার ছিল সেরা ব্যবসায়িক ক্ষেত্র। ওয়াল স্ট্রিটও সেই মুহূর্তে হলিউডের চীনমুখী ভাবনাকে প্রাধান্য দিয়েছিল। কারণ, শেয়ারহোল্ডারদের খুশি রাখতে চীনের বিশাল বাজারের প্রয়োজন ছিল হলিউডের। আর সেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বেজিং।
আত্মজীবনীধর্মী বই ‘সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট’ লিখেছিলেন হেনরিখ হারের। ১৯৯৭ সালে এর উপর ভিত্তি করে একই নামে নির্মিত হয় হলিউড সিনেমা। কিন্তু চীন নিয়ে গল্প বলতে গেলে চীনের সঙ্গে সমঝোতা করেই যেন চলতে হবে। প্রাথমিকভাবে তিব্বতে শুটিং চলতে দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে লাতিন আমেরিকায় তৈরি করা হয় তিব্বতের প্রতিরূপ। তার পরও শেষ রক্ষা হয়নি। সিনেমা মুক্তির প্রসঙ্গে বেঁকে বসে চীনের সেন্সর বোর্ড। প্রতিক্রিয়া হিসেবে শুধু সোনির পরবর্তী সিনেমা নয়, প্রযোজক জিন-জ্যাক আনাউদ ও অভিনেতা ব্র্যাড পিটকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় চীনে। নিজেদের ব্যবসার ক্ষতি চিন্তা করে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় সোনি পিকচার্স। এত বড় বাজার হাতছাড়া করা যে কারও জন্য বোকামি। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর তারা চীনের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছায়। প্রায় একই ঘটনা ঘটে ‘কুন্দুন’ নির্মাণের পর। নিষিদ্ধ হয় পরিবেশক প্রতিষ্ঠান ডিজনি, পরিচালক মার্টিন স্করসেসি ও সংশ্লিষ্টরা। দু’টি সিনেমার পরিণতি হলিউডের চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজকদের পরবর্তী সিদ্ধান্তকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
গত তিন দশকে যথেষ্ট বিতর্ক হয়েছে হলিউড ও চীনের সম্পর্ক নিয়ে। একদিকে কুন্দুন ও সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেটের বাণিজ্যিক সঙ্কট ও অন্যদিকে কুংফু পান্ডার সাফল্য ভাবতে বাধ্য করেছে হলিউডের স্টুডিওগুলিকে। চীনের বাজারে প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত করতে তারা এখন নিজেরাই বিশেষ ধরনের সেন্সরশিপের মধ্যে দিয়ে এগচ্ছে। একইসঙ্গে চীনের চলচ্চিত্র নির্মাতারাও হলিউডের দিকে ঝুঁকছেন। এটা এক ধরনের সূক্ষ্ম যুদ্ধ। সাংস্কৃতিক আধিপত্যের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্রের গতিপথ। নব্বইয়ের দশকে ডিজনি ও সনি পিকচার্স যা করেছে, এখন তারা নিজেরাই তা থেকে দূরে থাকতে চায়। দলাই লামা, তিব্বত, ধর্ম ও অন্যান্য বিষয়ের চিত্রায়ণে চীনকে গুরুত্ব দিতে বাধ্য হচ্ছে। প্রয়োজনে স্ক্রিপ্ট পুনরায় পড়া হবে, যেন চীন থেকে নেতিবাচক কোনও সিদ্ধান্ত না আসে। এর মধ্য দিয়েই জন্ম নিয়েছে স্বয়ংক্রিয় সেন্সরশিপের সংস্কৃতি। স্টুডিওর সিইওরা বেজিং কী চায় ও কী চায় না, এ বিষয়ে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। স্টুডিও প্রধানরা এমনভাবে স্ক্রিপ্ট পড়েন, যেন তারা বেজিংয়ের সেন্সর বোর্ড। সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, এমন যেকোনও কিছু নিয়ে তারা সতর্ক। মাত্র দু’টি উদাহরণ তৈরি করতে হয়েছে চীনকে। তারা ‘কুন্দুন’ ও ‘সেভেন ইয়ার্স ইন টিবেট’-এর ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতেই অবস্থান স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, দলাই লামা নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না!
এর একটাই কারণ, দেড় দশক আগে থেকেই হলিউডের বাজার সঙ্কুচিত হতে থাকে। ২০০৩ সালে শুধুমাত্র ‘ফাইন্ডিং নিমো’ সিনেমারই আট কোটি ডিভিডি কপি বিক্রি করেছিল ডিজনি। অথচ, ২০০৮ সালের মধ্যে সেই ডিভিডি ব্যবসা সঙ্কুচিত হয়েছে ৩৩ শতাংশ। দর্শক হারানোর জন্য তাদের আয়ের অর্ধেক উধাও হয়ে গিয়েছে। ঠিক একই সময়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছিল চীন। হলিউডের বিপরীতে যেন নতুন ফ্রন্ট হিসেবে দেখা দেয় চীনের চলচ্চিত্র শিল্প। ২০০৮ সালের পর থেকেই চীনের বক্স অফিস দ্রুত বড় হতে থাকে। স্টুডিওগুলিতে চীনকে মাথায় রেখে সিনেমা নির্মাণের প্রবণতা বাড়ে। পাশাপাশি সিনেমা নিয়ে বাড়তে থাকে বাজেট। চীনের বাজার তো আর বিদেশের আট-দশটা বাজারের মতো নয়। সেখানকার রাজনৈতিক দল ও সেন্সর বোর্ড নিজেদের সংস্কৃতির জন্য উপযোগী কি না, সেটা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিটি সিনেমা দেখার পরেই মুক্তির অনুমোদন দেওয়া হয়। আর এই কারণেই ‘মিশন ইম্পসিবল থ্রি’ থেকে কিছু দৃশ্য সরিয়ে দেওয়া হয়, ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড’ সিনেমার স্ক্রিপ্ট পুনরায় লেখা হয় এবং ‘স্কাইফল’ থেকে কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়। তার চেয়ে বড় কথা ‘রেড ডন’ সিনেমার কিছু অংশ চীনে মুক্তি পাওয়ার জন্য
পুনরায় নির্মাণ করতে হয়।
প্রযোজকরা চীনের আপত্তি মেনে নিয়েছেন। বেজিংকে সন্তুষ্ট রাখতে চীনের কোনও একটা শহর, কোনও একটা রেস্তরাঁ অথবা কোনও একটা ব্যক্তিকে হাজির করছেন সিনেমায়। ‘ট্রান্সফরমার: এজ অব এক্সটিংকশন’ সিনেমায় যে হংকংকে দেখা যায়, তা এই দীর্ঘ অভিযোজন প্রক্রিয়ারই দলিল। এভাবেই চীন তার বক্স অফিসের মাধ্যমে যে অর্থনৈতিক পাটাতন দাঁড় করিয়েছে, তা দ্রুত রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের শর্তে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা তাদের নীতি নিয়ে সবসময়ই কঠোর। যে স্টুডিওগুলি চীনের বাজারে প্রবেশ করতে চায়, তাদের অবশ্যই নিয়ম মেনে প্রবেশ করতে হবে।
হলিউড দীর্ঘদিন ধরেই তাদের আদর্শ সিনেমার মাধ্যমে রপ্তানি করে চলেছে। বিক্রি করেছে আমেরিকার ধাঁচে গণতান্ত্রিক চেতনা ও পশ্চিমের ব্যাকরণ মানা স্বাধীনতা ও উদারনৈতিকতা। সুযোগ পেলেই চিত্রিত হয়েছে আমেরিকানদের বীরত্ব এবং সামরিক শক্তি। চীন কিন্তু খুব বেশি পিছিয়ে নেই। সেখানকার সরকারও রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি
রপ্তানির প্রচেষ্টায়। তার জন্য হলিউডই সেরা পথ। বিশ শতকের সফল অস্ত্রগুলির একটি হচ্ছে আমেরিকান সফট পাওয়ার। যা আমেরিকাকে আধিপত্য বিস্তারে সহযোগিতা করেছে। চীন শুধু তাকেই অনুকরণ করার চেষ্টা করছে।
মার্কিন ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক স্তরে প্রচারিত চলচ্চিত্রগুলিতে আমেরিকার প্রশাসনের কড়া নজরদারি রয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মার্শাল প্ল্যানের সময় থেকেই চলচ্চিত্রগুলি হোয়াইট হাউসের সরঞ্জামে পরিণত। তার মানে যে রাজনৈতিক প্রচার কম থাকা সিনেমা তৈরি হয়নি, এমনটা নয়। কিন্তু সেগুলিও আমেরিকান সংস্কৃতিকেই সর্বজনীন করার প্রচেষ্টার অংশ। ‘ডার্টি ড্যান্সিং’ ও ‘ব্যাক টু দ্য ফিউচার’-এর মতো সিনেমাগুলি মার্কিন
তারকাদের আন্তর্জাতিক তারকায় পরিণত করেছে। তবে চীনের প্রচেষ্টা দ্বিমুখী। প্রথমত, প্রোপাগান্ডা মুভি বা মেন মেলোডি তৈরি, যেখানে সরকার বেশ ভালোভাবেই নাক গলায়। এর বাইরে রয়েছে সত্যিকার প্রচেষ্টা, যা বাণিজ্যিক সিনেমা তৈরি করছে। চীনের সংস্কৃতিকে তুলে ধরছে বিশ্বের দরবারে। যেভাবে মার্কিন জীবন সম্পর্কে সিনেমাগুলি আমেরিকাকে তুলে ধরে।
আজ ‘নেটফ্লিক্স’ প্রায় ১৯০টি দেশে দেখা যায়। কিন্তু চীনের বড় বাজারটি তাদের জন্য উন্মুক্ত হয়নি। নেটফ্লিক্সের কর্তারা চীন সরকারের সঙ্গে অনেক আলোচনা করেও এখনও বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজারটির নাগাল পায়নি। স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চীনে এখন বেশি জনপ্রিয়, কিন্তু সে বাজারে নেটফ্লিক্স এখনও পা রাখতে পারেনি। চীন সরকার এক্ষেত্রে তার স্ট্রিমিং বাজারকে বাইরের কোম্পানির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে ভূমিকা নিয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীন সরকার তাদের সাংস্কৃতিক নীতি পরিবর্তন ও বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বাজার শক্তি এবং বহুজাতিক পুঁজিকে ব্যবহার করে চলচ্চিত্র ক্ষেত্রকে মুনাফা অর্জনকারী শিল্পে পরিণত করেছে। সরকারের নীতি চীনের স্থানীয় সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নতুন করে নির্মাণ করেছে, একই সঙ্গে তারা আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও নিজেদের প্রভাব বিস্তৃত করেছে। ফলে হলিউডের র্যাম্বোর জায়গা চীনের স্পেশাল ফোর্সের লেং ফেং কতটা নিতে পারবে সেটা এই শতকেই নির্ধারণ হয়ে যাবে। সেই লড়াই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কীভাবে লড়েন, সেটাই দেখার!