বিশেষ নিবন্ধ

সাহেবি আমল থেকেই বড়দিন বাঙালির নিজস্ব পার্বণ
সন্দীপন বিশ্বাস

সাহেবি আমলের দেশি বাবুরা কেবল দুর্গাপুজো, বুলবুলির লড়াই আর বিড়ালের বিয়ে নিয়েই মেতে থাকতেন না, তাঁরা বড়দিন বা ইংরেজি নববর্ষের আনন্দের স্রোতেও ভেসে যেতেন। সে ছিল এক দেখার মতো ব্যাপার। বাবুদের কাপ্তেনির মেজাজে লাগত সুরা ও সুরের দোল। ইংরেজদের খুশি করতে বাবুরা বড়দিন বা  ইংরেজি নববর্ষ পালনের ব্যবস্থা করতেন। আনন্দে রঙিন হয়ে উঠত নাচঘরের রাত। বাঈজিদের ঘুঙুরের বোল যখন মিলিয়ে যেত, তখন পূব আকাশে আলো ফুটছে। বাবুরা ফরাসে কাৎ। ধীরে ধীরে বাঈজিরা বিদায় নিলে, নাচঘরের আলো ম্লান হয়ে এলে সেই সব উৎসবে নাচের আসর দখল করে নেন মেমরা। সাহেব-মেমের যুগল নৃত্যে যে কোনও পার্টিই হয়ে উঠত জমজমাট। বিশেষ করে বড়দিন বা বর্ষবরণের রাত হলে তো কথাই নেই। সারারাত ধ্রুবতারার মতো জেগে থাকত উৎসবে জোয়ারে ভেসে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা। তাতে ইন্ধন জোগাত বিলিতি কোম্পানির রঙিন পানীয়। ক্লারেট, মোসেল, পেরিয়া, রেনিস, পেল এল ইত্যাদি। সেই সাহেবি পার্বণে বহু ভারতীয় আমন্ত্রিত থাকতেন। 
শীত পড়লেই সাহেবরা যেমন নতুন কোট-প্যান্ট বানাতে ছুটতেন, তেমনই দেশি বাবুরাও  লক্ষ লক্ষ টাকার বাহারি কাশ্মীরি শাল, পশমিনাতে সেজে উঠতেন। বাবুদের সেই শীতবিলাস আরও মধুর হতো বড়দিনের ছোঁয়ায়। ব্যারিস্টার অ্যান্টনি ফে’র স্ত্রী এলিজা ফে ১৭৮১ সালে এক চিঠিতে তাঁর বান্ধবীকে লিখেছিলেন, ‘কলকাতায় ক্রিসমাসের আনন্দে ডুবে আছি। আমার মনে হয় না, ইংল্যান্ডেও এত জাঁকজমক দেখেছি।’ 
সেই আনন্দের ছবি কিছু ধরা পড়ে ঈশ্বর গুপ্তের কবিতায়। ‘খ্রিস্টের জন্মদিন বড়দিন নাম / বহু সুখে পরিপূর্ণ কলকাতা ধাম / কেরানি, দেয়ান আদি বড় বড় মেট / সাহেবের ঘরে ঘরে পাঠাতেছে ভেট।’ বড়দিন ও নতুন বছরকে সামনে রেখে দেশি বাবুরা সাহেবদের খুশি করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন।  
তবে আনন্দ করতে জানতেন সাহেবরা। শুধু ঘরে বসে রঙিন সুধা পান করার মধ্য দিয়ে যে সব আনন্দটুকু উপভোগ করা যায় না, সেটা তাঁরা জানতেন। তাই তাঁরা দৌড়ে যেতেন রেসের মাঠে। তখন কলকাতায় রেস হতো এলেনবরা কোর্সে কিংবা আকরার মাঠে। পাশাপাশি গার্ডেনরিচ এবং বারাসতেও ঘোড়দৌড়ের ব্যবস্থা ছিল। পরে অবশ্য রেসকোর্স তৈরি হয়। সাহেবদের প্রয়োজন মতো কলকাতা শহরে গির্জার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। ১৮৪৭ 
সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চ। এছাড়া শীত পড়লেই সাহেবরা পিকনিকের আয়োজন করতেন বারাকপুর কিংবা ‘বেলভেডেরে’।   
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বড়দিন পালন করতেন। ১৯১০ সাল থেকেই তিনি আশ্রমে খ্রিস্টোৎসবের আয়োজন করেছিলেন। যিশুকে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ‘পরম-আনন্দঃ পরমাগতিঃ’। বিভিন্ন বছরের ২৫ ডিসেম্বর এই ‘মানবপুত্র’কে নিয়ে তিনি কবিতা বা প্রবন্ধ লিখেছেন।  ‘খৃস্টোৎসব’ প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, ‘যে মহাপুরুষ তাঁর জীবনের মধ্যেই অমৃতলোকের পরিচয় দিয়াছিলেন,তাঁর মৃত্যুর দ্বারা অমৃতরূপ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল,আজ তাঁর মৃত্যুর অন্তর্নিহিত সেই পরম সত্যটিকে যেন আমরা স্পষ্ট আকারে দেখতে পাই।’ 
রামকৃষ্ণ মিশনে যিশুখ্রিস্টের পুজো চালু করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি মনে করতেন হিন্দুধর্মের যে বিশাল শক্তি রয়েছে, তার জোরেই সে সমস্ত ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে। এই সমন্বয় চেতনা স্বামীজির মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণই। বিভিন্ন সন্ন্যাসীর লেখা থেকে জানা যায়, শ্রীরামকৃষ্ণ সাধনার সময় যিশু এবং বুদ্ধদেবের দর্শন লাভ করেছিলেন। ঠাকুর সবসময় ধর্মীয় কূপমণ্ডকতার বাইরে গিয়ে এক মুক্ত ধর্মের সাধনা করে গিয়েছেন। 
সময়ের বদলের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয় সংস্কৃতির। বদলে যায় উৎসবের ঘরানা। বর্তমানে পার্ক স্ট্রিট হয়ে উঠেছে কলকাতায় বড়দিন অথবা ইংরেজি নতুন বছরে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, কেন পার্ক স্ট্রিট হয়ে উঠল উৎসবের এপিসেন্টার? এর জন্য নাম করতে হয় এলিজা ইম্পের। একসময় কলকাতায় ছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই কোর্টের চিফ জাস্টিস ছিলেন স্যার এলিজা ইম্পে। তিনিই প্রথম পার্ক স্ট্রিটে বড়দিন এবং ইংরেজি নতুন বছর উপলক্ষ্যে মডেল ও আলো দিয়ে সাজানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানে তিনি ডিয়ার পার্ক তৈরি করেন। সেখানে বসানো হয় একটা মডেল। দেখা যায়, স্লেজ গাড়িতে বসা সান্তাক্লজকে টানছে বল্গা হরিণের দল। সেটা দেখতে বহু সাহেব ও দেশীয়রা ভিড় করেছিলেন। পরে পার্ক স্ট্রিটের রাস্তা ও সাহেবদের বাড়ি বানানো হলে, সেই পার্কটি ভেঙে দেওয়া হয়। কিন্তু একটা পরম্পরা তৈরি হয়ে গেল। সেই পার্ক থেকেই রাস্তাটির নাম হয়ে গেল পার্ক স্ট্রিট। এখনও বড়দিন এবং ইংরেজি নতুন বছরের টানে লক্ষ লক্ষ মানুষ পার্ক স্ট্রিটে ছুটে আসেন আলো আর আনন্দের জোয়ারে ভাসতে। পার্বণের সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। বড়দিন মানেই আজ ঘুরে বেড়ানো, কেক খাওয়া। অথচ একসময় বাঙালি বাবুরা সাহেবদের কেক খেয়ে মাথায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে ঘরে ঢুকতেন।     
সারা বিশ্ব প্রভু যিশুর জন্মদিনকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে। এ এক আন্তর্জাতিক উৎসব। এর মধ্যেই গত ৫০-৬০ বছর ধরে একটা নতুন বিতর্ক চলছে। আচ্ছা, যিশু কি কখনও ভারতে এসেছিলেন? একটা গবেষণা বলছে, যিশু ভারতে এসেছিলেন। সেই কাহিনির সত্যাসত্য বিচার আজও অবশ্য হয়নি। তবে ইদানীং এটা নিয়ে চর্চা চলছে যে, যিশু যখন কাশ্মীরে এসেছিলেন, তখন সেখানে ছিল রাজা গোপদত্তের শাসনকাল। যিশুকে নিয়ে পরবর্তীকালে অনেকেই গবেষণা করেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন সুফি মতিউর রহমান বেঙ্গালি। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত তাঁর একটি বই ‘দ্য টম্ব অব জেসাস’ থেকে জানা যায়, যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হলেও তিনি মারা যাননি। রাজসৈন্যরা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে চলে যাওয়ার পর তাঁর অনুগতরা তাঁকে নামিয়ে আনেন এবং এক গোপন জায়গায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে যিশু দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। কয়েকদিনের শুশ্রুষায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাঁর ভক্তরা বলেন, ‘প্রভু এই স্থান আপনার জন্য নিরাপদ নয়।’ তাই ভক্তদের প্রার্থনা শুনে যিশু এক ঝড়জলের রাতে গোপনে বেরিয়ে পড়েন। এরপর তিনি বিভিন্ন দেশ ঘুরে কাশ্মীরে পৌঁছে যান। সেখানে একশো কুড়ি বছর বয়সে তিনি মারা যান। শ্রীনগরের রোজবালে একটি সমাধি আছে। তার গায়ে লেখা আছে ‘ইয়ুস আসফ’। ইয়ুস শব্দের অর্থ যিশু এবং আসফ শব্দের অর্থ জমায়েত। অর্থাৎ বলা হচ্ছে, সেই সময় যিশুর টানে বহু ইজরায়েলি এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। ইজরায়েলের দশ বিলুপ্ত জাতিগোষ্ঠীকে কাশ্মীর সহ ভারত ও আফগানিস্তানে পাওয়া যায় বলে পণ্ডিতদের দাবি। পণ্ডিতরা বলেন, কাশ্মীরে যে লাদাখ, লে, গিলগিট নামগুলি পাই, সেগুলি এসেছে প্রাচীন সিরিয়ার ল্যাড্ডাক, লেহি এবং গোলগাথা থেকে। নিউ টেস্টামেন্ট থেকে জানা যায়, জেরুজালেমের বাইরে যে পাহাড়টা ছিল, সেটারই নাম ছিল গোলগাথা। সেখানেই যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল। 
মতিউর আরও বলেছেন, যিশুকে যে মসিহা বলা হয়, তার দু’টি অর্থ। একটি হল পরিব্রাজক। এই শব্দের উৎস হল সিয়াহাট। আর একটি অর্থ হল ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি। প্রায় দু’শো বছর আগে কাশ্মীরের এই সমাধি নিয়ে সুফি কবি খাজা মহম্মদ আজম দিদামারি লিখেছিলেন, এই সমাধি এমন এক ব্যক্তির, যিনি ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন। তিনি বিদেশ থেকে এসেছিলেন। মানুষের মধ্যে তিনি প্রেম ও করুণা বিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নাম ইয়ুস আসফ। মতিউর বললেন, ইনিই হলেন যিশু।    
যিশুকে নিয়ে আজও গবেষণা চলছে। যিশুর প্রতিকৃতি নিয়ে চলছে অন্বেষণ। কেমন দেখতে ছিল যিশুকে? তাঁর কি সত্যিই অমন লম্বা চুল ছিল? দাড়ি ছিল? তাই নিয়ে নানা মত আছে। তবে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন, তাঁর চোখজুড়ে ছিল এক গভীর প্রসন্নতা। ভালোবাসার নীল প্রশান্তি। বিভিন্ন শিল্পীর আঁকা ছবিতে এই প্রসন্নতার ছায়া বারবার ফিরে এসেছে। বেশ কিছুদিন আগে মিশরে প্রাপ্ত একটি ছবি নিয়ে আলোড়ন পড়ে গিয়েছে। সেখানকার এক প্রাচীন শহর অক্সিরিংকাস। কায়রো থেকে সেই শহরের দূরত্ব প্রায় দেড়শো কিলোমিটার। এখানেই রয়েছে মিশরীয়দের দেবতা অসিরিসের মন্দির। সেখানে একদল ছাত্রকে নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছিলেন বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ পেড্রো। সেখানে সপ্তম শতাব্দীর একটি সমাধি খনন করে তাঁরা একটি ছবি পান। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে একটি মানুষ, তাঁর চুল কোঁকড়া ও অনেকটা লম্বা। হাতের মুদ্রায় আশীর্বাদের ভঙ্গিমা। এই ছবিটি পাওয়ার পর গবেষকদের সিদ্ধান্ত হল, এটাই যিশুর সবথেকে পুরনো ছবি।
যিশুর যে মানবধর্ম, তার চৈতন্যে রয়েছে শুধুই ভালোবাসা। পৃথিবীর সকল মহাপুরুষই যুগে যুগে মানুষকে ভালোবাসার কথাই বলে গিয়েছেন। পরবর্তীকালের কিছু হীনচেতা মানুষ আপন স্বার্থে সেই ধর্মের মধ্য থেকে নানা বিভেদ খুঁজে বের করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফিরতে হবে আলোর পথেই। আজ বড়দিন তাই বড় মনের মানুষ হয়ে ওঠার দিন।
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পড়ে গিয়ে বা পথ দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্তির যোগ থাকায় সতর্ক হন। কর্মে  উন্নতি ও সাফল্যের যোগ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.২৮ টাকা৮৬.০২ টাকা
পাউন্ড১০৪.৮৬ টাকা১০৮.৫৭ টাকা
ইউরো৮৬.৮৬ টাকা৯০.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
25th     December,   2024
দিন পঞ্জিকা