আপনি কি এর মধ্যে পপকর্ন খেয়েছেন? খেলেই কিন্তু হল না। বলতে হবে, কোথায় খেয়েছেন। বাড়িতে? নাকি সিনেমা হলে? মাল্টিপ্লেক্স বা সিনেমা হলে খেলে বলুন, কীভাবে কিনেছেন। টিকিটের সঙ্গে? নাকি ইন্টারভ্যালের সময় বেরিয়ে, আলাদাভাবে? এই উত্তর মনে পড়লে এবার বলুন, কেমন খেতে ছিল ওই পপকর্ন? নোনতা? মিষ্টি? নাকি বিস্বাদ। মনে পড়াটা জরুরি। কারণ, এই সব প্রশ্নের উত্তরে লুকিয়ে আছে, আপনি কত টাকা ট্যাক্স দিয়েছেন। থুড়ি ট্যাক্স বললে মাননীয় ভারত সরকার গোঁসা করবেন। বলতে হবে—জিএসটি। পণ্য ও পরিষেবা কর। খোলা পপকর্ন কিনলে ৫ শতাংশ জিএসটি। ওটাই প্যাকেটে ভরে ফেললে ১২ শতাংশ, আর ক্যারামেল যদি একবার মিশে যায়, তাহলেই ১৮ শতাংশ কর গুনতে হবে আপনাকে। যদি টিকিটের সঙ্গে কম্বো হয়? জিএসটি ওই সিনেমার টিকিটের সম পরিমাণ।
সরলীকরণ। এই একটি শব্দেই জিএসটির প্রচার-আয়োজন সেরেছিল মোদি সরকার। এই কর ব্যবস্থা চালু হতেই নাকি সব মুশকিল আসান। ব্যবসায়ীদের আর নানাবিধ কর দিতে হবে না, হিসেব মেলাতে রাত জাগতে হবে না, সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি যাবে না... এমন আরও অনেক কিছু। জিএসটি চালুর পর সাত বছর পার হয়ে গিয়েছে। এই কর ব্যবস্থায় সত্যি কাদের লাভ হয়েছে? সরকারের? মনে হয় না। একটি কর ব্যবস্থা চালুর সাত বছর পরও যদি রাজ্য সরকারগুলিকে ‘ক্ষতিপূরণ’ দিতে হয়, তাহলে কেন্দ্র বা রাজ্য—কারও লাভ হয়েছে বলে দাবি করা যায় না। যে রাজ্যগুলিতে উৎপাদন ক্ষেত্র শক্তিশালী, অর্থাৎ গুজরাত, হরিয়ানার মতো রাজ্যের চাপে জিএসটি ক্ষতিপূরণ চালু করেছিল মোদি সরকার। প্রশ্ন হল, যে কর ব্যবস্থা কার্যকর করলে পাঁচ বছর ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ গুনতে হবে, সেই সিস্টেম চালু করব কেন? আর যখন পুরো টাকাটাই যাচ্ছে আমার-আপনার করের টাকা থেকে! ব্যাপারটা তো এমন... আপনি একটা ব্যবসা শুরু করতে চলেছেন। কিন্তু জানেন, আগামী পাঁচ বছর এতে বিস্তর লোকসান হবে। তাহলে কি ওই ব্যবসা আপনি শুরু করবেন? কেন্দ্র কিন্তু করেছে? কার স্বার্থে?
তাহলে কি লাভ সাধারণ মানুষের? নিত্যপ্রয়োজনীয় এমন বহু পণ্য রয়েছে, যার জন্য আম জনতাকে পকেট খুঁড়ে জিএসটি দিতে হচ্ছে। আগে কিন্তু এই অসন্তোষ সাধারণের মধ্যে দেখা যেত না। বিমায় জিএসটি, রেস্তরাঁয় জিএসটি, বেড়াতে গেলে হোটেলে জিএসটি। এর সঙ্গে সার্ভিস ট্যাক্স গোনার রীতিও রয়েছে পুরোদমে। অর্থাৎ, সাধারণ মানুষ এতটুকু উপহার পায়নি জিএসটি থেকে।
তাহলে কি এই কর ব্যবস্থায় লাভ হয়েছে ব্যবসায়ীদের? এই প্রশ্নের উত্তরও যে বড্ড তেতো। কারণ, এতে বড় কর্পোরেট বন্ধুদের সুরাহা হতে পারে। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীদের কখনওই নয়। ২০১৭ সালে জিএসটি চালু হওয়ার পরই সদ্য প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, ‘এটা মোদি সরকারের বড় ব্লান্ডার। ছোট ব্যবসায়ীদের কোমর ভেঙে দেবে।’ মনমোহন সিং কি জ্যোতিষী ছিলেন? তা তো নয়। তাহলে এমন কঠোর বাস্তবটা কীভাবে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। আসলে, অর্থনীতির এই রূপ দেখার জন্য সত্যিই জ্যোতিষী হতে হয় না। নিজের দেশ, দেশবাসী এবং অর্থনীতিটা বুঝতে হয়। মনমোহন সিং সেটাই বুঝতেন। তাই জিএসটি তাঁর আমলের উদ্যোগ হওয়া সত্ত্বেও কার্যকর করেননি মনমোহন। অটলবিহারী বাজপেয়ি যে কেলকার কমিটি গঠন করেছিলেন, তারাই রিপোর্ট দিয়েছিল মনমোহন সরকারের কাছে। সেখানেই কর সংস্কারের পদক্ষেপ হিসেবে জিএসটির কথা বলা হয়েছিল। সেটা ২০০৪ সাল। মনমোহন সময় নিয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটা কিছু করতেই হবে। কিন্তু ধীরে। সাবধানে। ২০০৬ সালে বাজেট পেশের সময় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম এমন পণ্য ও পরিষেবা করের কথা উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, সম্পূর্ণ রূপরেখা তৈরির পর এবং প্রত্যেকের স্বার্থ বিবেচনা করে ২০১০ সালে এই ব্যবস্থা কার্যকরের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হল। ২০১০ সালে অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ওই লক্ষ্যমাত্রা আরও এক বছর বাড়িয়ে দেন। ’১১ সালে এই সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল পেশ হতেই তা চলে যায় স্ট্যান্ডিং কমিটিতে। তীব্র প্রতিবাদ ওঠে বিরোধী পক্ষ থেকে। ওই প্রতিবাদের সবচেয়ে সামনের সারিতে কে ছিলেন? গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর তাঁর সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। তাঁদের যুক্তি ছিল, এই ব্যবস্থা চালু হলে রাজ্যের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে। কোন পণ্যের উপর কত কর বসবে, সেটা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঠিক করবেন। তাতে জিএসটি কাউন্সিল মাথা নাড়বে। রাজ্যগুলির কী হবে? যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে পড়বে। একচ্ছত্র আধিপত্য চালাবে কেন্দ্র। ফলে ইউপিএ জমানায় এই ব্যবস্থা কার্যকর করা যায়নি। মনমোহন সিং কিন্তু চাপাচাপিও করেননি। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, ভারত এবং এই ব্যবস্থা—দুটোর কোনওটাই পুরোপুরি তৈরি নয়। আরও অনেক ‘মডিফিকেশন’ দরকার। এই একই রায় তাঁর ছিল ২০১৭ সালেও। তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। আর তিনি যা ভেবেছিলেন, সেটাই হয়েছে। জিএসটি চালুর পর বহু সংস্থা স্রেফ লাটে উঠেছে। আগে উৎপাদন ক্ষেত্রে বড় কোম্পানির বরাতে ফুলেফেঁপে উঠত ছোট সংস্থাগুলি। জিএসটি নামক ‘রাবণে’র চাপানো নানাবিধ শর্তের জেরে বড় কোম্পানিগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এখন আর এমএসএমই’কে কাজের বরাত দিতে চায় না। ফলে টিমটিম করে জ্বলতে জ্বলতে বন্ধ হয়ে যায় ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা। সব যখন ঠিকঠাক ছিল, শিল্পক্ষেত্রের ৮৫ শতাংশ কর্মসংস্থান হতো এমএসএমইর মাধ্যমে। জিএসটি কার্যকরের পর ইনভয়েস-রিটার্নের জ্বালায় কত এমএসএমই বন্ধ হয়েছে, মোদিজি একবার সেই পরিসংখ্যান প্রকাশ করবেন কি? একে এই বিপুল ধাক্কা, তার উপর শ’খানেক সেস তো রয়েছেই। বছরের পর বছর ব্যবসায়ীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। আর একইসঙ্গে পোয়াবারো অসৎ কারবারিদের। ভুয়ো কোম্পানি খুলে কোটি কোটি টাকা জিএসটি প্রতারণা চলছে বছরের পর বছর। রাজকোষে টাকা ঢুকছে না, অথচ কাগজ বলছে সরকারের প্রাপ্তিযোগ ঘটেছে। তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে প্রতারকদের অ্যাকাউন্ট ভর্তি করে। কোন টাকা দিচ্ছে সরকার? আম জনতার করের টাকা। কর্পোরেটের হাজার হাজার কোটির অনাদায়ী ঋণ মকুব হচ্ছে, আর চাকরিজীবী, সাধারণ মধ্যবিত্ত তার মূল্য চোকাচ্ছে। এটাই আজ সবচেয়ে কঠিন বাস্তব। বলতে পারেন, একজন মধ্যবিত্ত কখন গাড়ি কেনে? স্বপ্ন দেখলে। একটা অল্টো। কিংবা আই টেন। বছরের পর বছর আয়কর দেওয়ার পর যতটুকু সঞ্চয় হয়েছে, তার থেকে বেশিটা টেনে-হিঁচড়ে বের করে ডাউন পেমেন্ট দেয়। বাকিটা লোন। তারপর তার মুখে ফোটে বিজয়ীর চওড়া হাসি। তাও নিজের জন্য নয়। স্ত্রীয়ের জন্য। যে প্রতিদিন, প্রতি মাস, প্রতি বছর তার সঙ্গেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই চালিয়ে গিয়েছে। সংসারের লড়াই। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই। এই হাসি তার ছোট ছোট ছেলেমেয়ের জন্য। যারা এখন বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে, জানিস... আমারও গাড়ি আছে। গর্বে বুক ফুলে উঠবে ওদের। কিন্তু এই স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে অনেকগুলো টাকা জিএসটি গুনতে হয় তাকে। এরপর আছে গাড়ির ইনস্যুরেন্স। তাতেও জিএসটি। রোড ট্যাক্স নিচ্ছে সরকার। জিএসটি গুনতে হচ্ছে তাতেও। সঙ্গে আছে সড়ক উন্নয়ন সেস। এতে কোনও ছাড় নেই! আগামী সপ্তাহেই গাড়ি নিয়ে দীঘা যাওয়ার ইচ্ছে আছে। তার আগে সহকর্মী ভয় দেখিয়ে রেখেছে, অনেক টাকা টোল ট্যাক্স দিতে হবে কিন্তু। ফাস্ট্যাগ অ্যাকাউন্ট ভরে রেখো। আর কিছু কি বাকি রইল? আছে তো—পেট্রল! মধ্যবিত্ত মানুষটি খবরের কাগজে পড়েছে, ট্যাক্স-সেস চাপার পরই নাকি পেট্রলের দাম ১০০ টাকার উপর চলে গিয়েছে। না হলে নাকি ৭০ টাকারও নীচে পাওয়া যেত। এরপরও কি এই দেশের আম জনতা দমে যাবে না? নেতা-মন্ত্রীরা গাড়িতে যান। কিন্তু তাঁদের টোল ট্যাক্স দিতে হয় না। তাঁরা গাড়িতে তেল ভরেন। ব্যবস্থা সরকার করে দেয়। ফ্রিতে তাঁরা সিলিন্ডারও পান। এই নীতি নির্ধারকরা সত্যি আম জনতার কষ্টটা বোঝেন তো? এঁরাই কিন্তু ১ ফেব্রুয়ারি বাজেট পড়বেন। নীতি তৈরি হবে সাধারণ মানুষের জন্য। মধ্যবিত্তের জন্য। কীভাবে আরও বেশি সরকারকে ট্যাক্স দেবেন তাঁরা। পণ্যের উপর। পরিষেবার উপর। পরিষেবা না পেলেও দিতে হবে। এই দেশের নাগরিক তারা। গাড়ি কিনলে জিএসটি দিতে হবে। বেচলেও। ধরুন আপনি ৫ লক্ষ টাকা দিয়ে একটা গাড়ি কিনেছিলেন পাঁচ বছর আগে। এখন সেটা বিক্রি করতে চান। দাম পাচ্ছেন তিন লক্ষ টাকা। অথচ সরকার মনে করছে, এই গাড়ি ১ লক্ষ টাকার বেশি দামে বিক্রি হওয়ার কথা নয়। মানে (৩ লক্ষ-১ লক্ষ) দু’লক্ষ টাকার উপর আপনাকে ১৮ শতাংশ জিএসটি দিতে হবে। এই যে ‘ফারাক’, সেটাই সরকারের কাছে লাভজনক। আপনার কাছে ‘ডেপ্রিসিয়েশন’ হলেও।
এই সরকার প্রোপাগান্ডা মার্কা সিনেমা ট্যাক্স ফ্রি করে। কিন্তু শিশুর দুধের উপর জিএসটি চাপায়। করের বোঝায় চাল-আটা-তেলের দাম হু হু করে বাড়ে। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘জিনিস কিনবেন, আর জিএসটি দেবেন না?’ সস্তায় দু’বেলা দু’মুঠো খাবার জোগাড় হওয়ার মতো পরিস্থিতি কি আজ সত্যি আছে? দিল্লির দরবারের কর্তাব্যক্তিরা কি খোঁজ নিয়ে দেখেছেন যে, একটা চারজনের সংসার চালাতে মাস গেলে আজ কত খরচ হয়? উপার্জনকারী মানুষটা কত রোজগার করে, আর কত টাকা তাকে ধার নিতে হয়? সেই হিসেব সামনে আসে না। সরকার বরং পরিসংখ্যান দেয়, আম জনতার ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এই ফর্মুলা মেনে নিতে হলে, সঙ্গে আরও একটা ডেটা যে চাই—কোন ধরনের জিনিসের উপর সাধারণ মানুষ বেশি খরচ করছে। সেইসব কি ভোগ্যপণ্য। তালিকা চেয়ে পাঠান মোদিজি। আর হ্যাঁ, তালিকাটা নির্মলাজিকেও দেবেন। কারণ দেখতে পাবেন, তার ৯০ শতাংশই নিত্যপণ্য। মোবাইল ফোন, এসি, টিভি, ফ্রিজ... এগুলো কিন্তু এখন সাধারণ মধ্যবিত্ত বাড়ির প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তালিকাতেই ঢুকে গিয়েছে। একে আর বিলাসিতা বলা চলে না।
জিএসটির সরলীকরণ আজও হয়নি। হওয়া এত সহজও নয়। যে গাছের গোড়া শক্ত নয়, সে সুস্বাদু ফল দেবে কীভাবে? অথচ, তেমনটাই সরকার ভাবছে। এবং সবচেয়ে বেশি কথা, আম জনতাকে সেটাই ভাবানো হচ্ছে। যোজনা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া লিখেছিলেন, ‘নোট বাতিল এবং জিএসটি অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ধসিয়ে দিয়েছে। অকৃষিজনিত জিডিপিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের অবদান ২৫ শতাংশ। ধাক্কা খেয়েছে সেটাই।’ আজ আরও একটা বছর শেষ হল। আরও এক সূর্যাস্ত... মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের একরাশ উদ্বেগ, যন্ত্রণা বুকে নিয়ে। খাদ্যপণ্যের দাম যে কিছুতেই কমছে না! ২০০৯ সালে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি যখন মাথাচাড়া দিয়েছিল, মনমোহন সিং শস্যের মজুত বাড়িয়েছিলেন সরকারের ঘরে। অত্যন্ত সস্তায় এবং রেশন দোকানের মাধ্যমে তার বণ্টন হয়েছিল দেশজুড়ে। নিয়ন্ত্রণে এসে গিয়েছিল খাদ্যপণ্যের দাম। আজ তিনি আর নেই। বছরের শেষ বেলায় মনমোহন সিং বিদায় নিয়েছেন। তিনি বেঁচে থাকলেও তাঁর পরামর্শ এই সরকার শুনত কি? মনে হয় না। তাহলে হয়তো সত্যি আচ্ছে দিন এসেই যেত।