আগে জামাকাপড় কেনাকাটার উপর বছরে একবারই ছাড় দেওয়া হতো। বাংলায় যার নাম ‘চৈত্র সেল’। বিক্রি না হওয়া মালপত্রের সদ্গতি করাই ছিল লক্ষ্য। বহু মানুষ চৈত্র সেলের অপেক্ষায় থাকত। কিন্তু এখন? মলে, বড় বড় দোকানে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রায় সারা বছরই ‘অফার’ দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, স্টক ক্লিয়ার করা। বিজেপি নেতারা নানা টোপ দিয়ে ‘সদস্যতা অভিযান’কে সেই সেলের পর্যায়েই নামিয়ে এনেছেন। সেলে গোডাউন খালি করতে হয়, আর এখানে ধরেবেঁধে বিজেপির ঘর ভরানোই লক্ষ্য। তাই দেওয়া হচ্ছে জ্যাকেট, নগদ টাকা সহ নানান টোপ। আর বিজেপি শাসিত রাজ্যে চলছে রীতিমতো জোরজবরদস্তি। হাসপাতালে যাওয়া অসুস্থ রোগীকে মাঝরাতে ঘুম থেকে তুলে, এমনকী স্কুলের নাবালক ছাত্রকেও জোর করে সদস্য করা হচ্ছে। লক্ষ্যপূরণের লক্ষ্যেই চলছে এমন সব অনাসৃষ্টি কাণ্ড।
২ সেপ্টেম্বর বিজেপির দিল্লির সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শুরু হয় সদস্য সংগ্রহ অভিযান। দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা জানিয়েছিলেন, দলের সদস্য সংখ্যা ৮কোটি ৮০ লক্ষ। এবারের লক্ষ্যমাত্রা ১০ কোটি। সেই মঞ্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, পরিবারে নতুন সদস্য এলে আনন্দ হয়। বিয়ের পর নববধূ এলে যে আনন্দ হয় বিজেপি পরিবারেও নতুন সদস্য এলে হয় সেই একই রকম অনুভূতি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একেবারে হক কথা বলেছেন। কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, অন্যের সন্তানকে নিজের ছেলে বলে দাবি করলে কি সে নিজের হয়ে যায়, নাকি আনন্দ হয়?
এই প্রশ্ন মোটেই অবান্তর নয়। বরং এর যথেষ্ট কারণ আছে। প্রধানমন্ত্রীর নিজের রাজ্য গুজরাতের কথাই ধরা যাক। সেখানে বিজেপির সদস্যতা অভিযানকে কেন্দ্র করে এমন কিছু ঘটনা সামনে এসেছে যাতে এই প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। গুজরাতের রাজকোটের এক হাসপাতালে চোখের অপারেশনের জন্য রোগীদের ভর্তি করা হয়েছিল। অভিযোগ, মাঝরাতে এক বিজেপি নেতা তাঁদের ঘুম থেকে তুলে সকলের মোবাইল নিয়ে নির্দিষ্ট নম্বরে মিসড কল দেন। অপারেশনের ফলে তাঁদের রোগমুক্তি হয়েছে কি না জানা নেই, কিন্তু বিজেপির সদস্যপদ প্রাপ্তিতে কোনও সমস্যা হয়নি। গোটা ঘটনাটা এক রোগী মোবাইলে রেকর্ড করায় বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। বিজেপির সদস্যতা অভিযানের শিকার হচ্ছে বহু নাবালক পড়ুয়াও। তাদের মোবাইলে বিজেপির অভিনন্দন বার্তা আসার পর বিষয়টি জানা যাচ্ছে। তা নিয়ে হইচই হচ্ছে বটে, কিন্তু লক্ষ্য পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে বিজেপি।
মধ্যপ্রদেশ এই মুহূর্তে বিজেপির সবচেয়ে শক্তঘাঁটি। মাত্র ২৪ দিনে নাকি এক কোটি সদস্য সংগ্রহের রেকর্ড গড়েছে। সেই রেকর্ড বাজাতেই এমন সব আওয়াজ বেরচ্ছে যাতে মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না বিজেপি। লক্ষ্মণ ঘনঘোরিয়া মধ্যপ্রদেশের একজন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা। কিন্তু তাঁকেও বিজেপির সদস্য করে নেওয়া হয়েছে। তাঁর মোবাইলে বিজেপির সদস্য হওয়ার জন্য অভিনন্দন বার্তা আসার পরই বিষয়টি তিনি জানতে পারেন। লক্ষ্মণ ঘনঘোরিয়া সেই মেসেজ দেখিয়ে দাবি করেছেন, বিজেপির সদস্যতা অভিযান আসলে ধাপ্পাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়।
মধ্যপ্রদেশে আরও একটি চমকপ্রদ ঘটনা সামনে এসেছে। বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বিধায়ক অজয় বিশনোইয়ের একটি টুইটে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়েছে। অজয় বিশনোই জানিয়েছেন, তাঁর কাছে একটি ফোন নম্বর থেকে বহুবার ফোন আসে। সদস্য সংগ্রহের দায়িত্ব তাদের সংস্থাকে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। ঘরে বসেই প্রচুর সদস্য সংগ্রহের হাতছানি। তারজন্য দিতে হবে টাকা। টাকার জোরে বসে বসেই হয়ে যাবেন নেতা। গোটা বিষয়টি অজয়বাবু টুইট করে জানান। সদস্যতার দায়িত্ব এজেন্সিকে দেওয়া হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও তোলেন। সেটা হলে মাটিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা সংগঠনকে মজবুত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা যে পিছিয়ে পড়বেন, সেই আশঙ্কাও প্রকাশ করেন।
অজয়বাবুর এসব দলের মধ্যে বলার কথা। কিন্তু তিনি টুইট করে তাঁর আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। কারণ সদস্যতা নিয়ে কী চলছে, সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। তাঁর টুইটে বিজেপি নেতৃত্ব চরম অস্বস্তিতে পড়ে যায়। নেতৃত্বের পরামর্শে তিনি থানায় এফআইআর করেছেন। পুলিসের হাতে তদন্তভার দিয়ে বিষয়টিকে আপাতত হিমঘরে পাঠানো হয়েছে। বিজেপি যে ক্রমশই এজেন্সি নির্ভর পার্টিতে পরিণত হচ্ছে, সেটা অজয় বিশনোইয়ের ঘটনায় আরও প্রকট হল।
এজেন্সির যে কী মহিমা, সেটা একুশের নির্বাচনে এ রাজ্যের মানুষ টের পেয়েছে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের দৌলতে বিজেপি নেতাদের মাথায় ঝরে পড়েছিল লাল গোলাপের পাপড়ি। জনসমর্থনের ছিটেফোঁটা নেই এমন এলাকাতেও বিজেপির পদযাত্রাকে ঘিরেও উঠেছিল আবেগের তুফান। তবে সে সবই যে মেকি ছিল, তা বাংলার সচেতন মানুষের বুঝতে ভুল হয়নি।
বিজেপির সদস্যতা অভিযানকে ঘিরে দেশজুড়ে জোর ঢাক পেটানো চলছে। ইতিমধ্যেই নাকি সদস্য সংগ্রহের সংখ্যা ৯ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। তারজন্য অভিনন্দন জানিয়ে টাঙানো হয়েছে পোস্টার। এরমধ্যে কতটা দুধ আর কতটা জল, সেটা বলা কঠিন। তবে ‘ইস বার চারশো পার’এর স্লোগান দিয়ে ২৪০ আসনে আটকে যাওয়ার মতোই বিজেপির সদস্যতা অভিযানের হাল।
বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি তবুও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, পুরসভার অস্থায়ী কর্মীদের নামিয়ে সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু বাংলায়? এখানে বিজেপি ক্ষমতায় নেই। উল্টে দিন যত যাচ্ছে ততই দুর্বল হচ্ছে সংগঠন। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র যে মিঠুন চক্রবর্তীর মতো বিজেপির ‘অতিথি নেতা’ও প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন। সেই বঙ্গ বিজেপির সামনে দেওয়া হয়েছে এক কোটি সদস্য সংগ্রেহের টার্গেট। তবে, পরিণতি সেই আগের মতোই হতে চলেছ। ইতিহাস বলছে, ২০০ আসনের টার্গেট দিলে পায় ৭৭। ৩০ আসনের টার্গেট দিলে জোটে ১২টি। বাংলায় সদস্য সংগ্রহের কাজও এগচ্ছে সেই অনুপাতেই।
বিজেপি সূত্রের খবর, ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সদস্য সংগ্রহের সংখ্যাটা ৩৭ লক্ষের কাছাকাছি। এরমধ্যে দুধ আর জলের অনুপাত কষতে না যাওয়াই ভালো। কারণ এটা একেবারেই দলের অন্দরের ব্যাপার। এখানে কোনও প্রতিপক্ষ নেই। ফলে দিল্লি নেতৃত্বের মুখঝামটা খেতে হবে না, এমন জায়গায় সংখ্যাটা নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা বঙ্গ বিজেপি করবেই। সুকান্ত মজুমদার নিজেকে একেবারে ‘সেফ জোনে’ নিয়ে চলে গিয়েছেন। তাঁর দাবি, দক্ষিণ দিনাজপুরে সদস্য করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লক্ষ। ইতিমধ্যেই দেড় লক্ষ হয়ে গিয়েছে। তাঁর দাবি শুনে গেরুয়া শিবিরেই চলছে হাসাহাসি। কেউ কেউ জানতে চাইছেন, দুধে জল, নাকি জলে দুধ? অবশ্য এটাও ঠিক, একই সঙ্গে তিনি রাজ্য সভাপতি এবং রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী। তাই একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড’ তো তাঁকে রাখতেই হবে!
তবে, সবচেয়ে বিপাকে পড়েছেন একুশের কৃত্রিম ঝড়ে উতরে যাওয়া বিজেপি বিধায়করা। তাঁরা প্রথম দিকে আন্তরিকভাবেই দলের গাইডলাইন মেনে সদস্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হিসেব কষতে গিয়ে দেখছেন, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ তো দূরের কথা, অর্ধেক জোগাড় করতেও পারবেন না। এইভাবে চললে অনিশ্চিত হয়ে যাবে টিকিটও। তাই যে-যার মতো করে চালু করে দিয়েছেন সদস্য সংগ্রহের ‘অফার’। এ ব্যাপারে বাঁকুড়ার বিধায়ক নীলাদ্রি দানার ‘অফার’ নিয়ে বেশ চর্চা শুরু হয়েছে। কী সেই অফার? ৭৫জনকে সদস্য করলে ১০০ টাকা এবং দেড়শো জনকে সদস্য করলে মোদি জ্যাকেট। তাঁর এই অফার সোশ্যাল মিডিয়ায় জায়গা করে নিয়েছে। এনিয়ে অনেকে কটাক্ষ করছেন। কিন্তু নীলাদ্রিবাবু বুঝে গিয়েছেন, মানুষ পাশে নেই। নেই বিজেপিকে ঘিরে সেই আবেগও। এখন বিজেপিতে চলছে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ নীতি। টাকা ছাড়া কেউ কাজ করবে না। তাই হয়তো তিনি দিয়েছেন সেলের স্টাইলে ‘অফার’।
সদস্যতা অভিযান এক অর্থে বিজেপির ভোটার লিস্ট তৈরির কাজ। এর উপর ভিত্তি করেই ঠিক হবে সংগঠনে কারা নেতৃত্ব দেবে। আর সেখানেই মেশানো হচ্ছে দেদার জল। কারণ বিজেপির লক্ষ্য, বিশ্বের সর্ববৃহৎ পার্টির গৌরব অর্জন করা। সদস্যতা অভিযান নিয়ে এমন ঢাক পেটাচ্ছে যাতে মনে হচ্ছে, বিজেপি সর্ববৃহৎ পার্টি হলেই মিটে যাবে দেশের সব সমস্যা। এসব দেখে অনেকেই বলছেন, সদস্যতা অভিযান আসলে সমস্যা থেকে মানুষের নজর ঘোরানোর কৌশল। এও বিজেপির আর এক জুমলা।