তথাকথিত একটা নাগরিক আন্দোলন বাম দিকে ঘোরাতে না পারার ব্যর্থতা কুরে কুরে খাচ্ছে। তা নিয়েই ‘ফেসবুকের দল’ সিপিএমের অন্দরে এখন হতাশার ঝড়। একটা দুঃখজনক ঘটনাকে নিয়ে বিশ্বজোড়া বাংলা বিরোধী কুৎসা, আর চক্রান্ত করেই ওরা ভেবেছিল খেলা বুঝি শেষ। কিন্তু এতটা পথ পেরিয়েও তারা আজ দিশাহারা। রাত থেকে ভোর দখল সব হল, তবু জনসমর্থনের তল ছুঁতে পারল না সিপিএম তথা বামপন্থীরা। আসন্ন উপ নির্বাচনেও শূন্যই নাচছে ভাগ্যে। তৃণমূলকে উপড়ে ফেলার স্বপ্ন এবারও মুখ থুবড়ে পড়ল। মমতা আবারও জিতে গেলেন। তার প্রধান কারণ বিরোধীরা বিশেষ করে সিপিএমের পোড়খাওয়া তাত্ত্বিকরা তৃণমূলের শ্রেণি চরিত্রটাকেই গত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে বুঝে উঠতে পারেননি। লাইন খুঁজতে খুঁজতে নিজেরাই কখন বেলাইন হয়ে গিয়েছেন।
লন্ডনে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত সীতারাম ইয়েচুরির স্মরণ সভার ফাঁকে রুপোর উপর সোনার জল করা মহার্ঘ্য ছড়িতে আলতো চাপ দিয়ে কোনও প্রবাসী কমরেড বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার কথা আওড়ালেই কি এই বঙ্গে দল বাঁচবে? কিংবা কোনও অনাবাসীর হতাশ স্বগতোক্তি ‘শি ইজ আ টেরিবল লেডি, ডেস্ট্রয়েড ওয়েস্ট বেঙ্গল ফর দ্য লাস্ট ওয়ান ডেকেড। আওয়ার পার্টি মাস্ট গিভ আ বিফিটিং রিপ্লাই, মিঃ সেলিম!’ এই সংলাপ নিঃসন্দেহে কল্পিত কিন্তু মোটেই অবাস্তব নয়। এর উত্তরে লাল দলের অধুনা কাণ্ডারী সেলিম সাহেবের হাসি কতটা ফিকে কিংবা চওড়া হয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু এটা বিলক্ষণ জানি, দূর ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে স্যুটেড বুটেড হয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নমাখা উচ্ছ্বাস প্রকাশ যতটা সহজ, বাংলায়
ফিরে মাঠে ঘাটে তা করে দেখানো ততটাই কঠিন। রক্তক্ষরণ থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। কথাটা বর্তমান আলিমুদ্দিন কর্তারাই নন, ওই প্রকাণ্ড বাড়িটার ইট কাঠ পাথরেরও বিলক্ষণ জানা। আর জানা বলেই কোনও এক অজ্ঞাত কারণে একদা লাল দুর্গ নৈহাটিতে নকশালদের আসন ছাড়া হল বিনা দ্বিধায়। দলের অন্দরে হাজারো প্রশ্ন তুলেই। আর হাড়োয়া আসনটি পেল মাত্র কয়েক মাস আগে চরম বিশ্বাসভঙ্গ করা আইএসএফ। যদি সংখ্যালঘু ভোটে একটু দোলা লাগে। যদিও সে আশা দুরাশা। বেশ বোঝা যাচ্ছে, পরতে পরতে আপস করা ছাড়া হীনবল আলিমুদ্দিনের আর আজ কোনও উপায় নেই! অস্বস্তিটা এখানেই। বাংলায় ইতিমধ্যেই কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভাঙায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই চতুর্মুখী আকার নিয়েছে, যা এখানকার শাসকের জন্য নিঃসন্দেহে সুসংবাদ। এর পর যদি ছাব্বিশের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেস ও তৃণমূলের জোট হয়?
শুধু বাঙালিই নয়, বাংলার মাঠে ঘাটে এখনও লাল ফেরানোর আশা বুকে নিয়ে ঝান্ডা বয়ে বেড়ানো শীর্ণ কমরেড মাত্রই জানেন টানা আড়াই মাসেরও বেশি আড়াল আবডাল থেকে নাগরিক আন্দোলনকে অক্সিজেন জুগিয়েও দলীয় স্তরে সংগঠন এখনও দমছুট। সেই অক্সিজেনের ফেলে দেওয়া সিলিন্ডার থেকে একটুও ফিরে আসেনি শকুনের মতো ভাগাড়ের উপর দিয়ে উড়ে চলা বামেদের ভাগ্যে। চরম শ্বাসকষ্টে অস্থির লাল পার্টির গাত্রদাহটা এখানেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের শুধু ক্ষমতাচ্যুতই করেননি, ১৩ বছর পরও দলের রক্তক্ষয় অব্যাহত রাখার একমাত্র কারিগর। তাই জুনিয়র ডাক্তারদের এত বড় অরাজনৈতিক একটা আন্দোলনের পরও সর্বত্র বামেদের হতাশার এই বারোমাস্যা শুনতে হয় কান পেতে। ডাক্তারদের আন্দোলন থেকে দল কী পেল, সব তো শূন্য! এত বড় নাগরিক আন্দোলন, মিথ্যার বেসাতির পরও ভোট পাটিগণিতে লাল পার্টি শূন্য হয়ে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ক্ষমা করবে তো!
আসলে সিপিএম আছে সেই পুরনো তাত্ত্বিক একাকিত্বের মোড়কেই। সেই কারণেই উপ নির্বাচন ভুলে তারা যথারীতি মন দিয়েছে আসন্ন পার্টি কনফারেন্সে। ভোটে ঝাঁপিয়ে পড়ার চেয়ে, জনসাধারণের দুয়ারে ছুটে যাওয়ার তুলনায়, নুইয়ে পড়া সংগঠনের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা বিন্যাসই এই মুহূর্তের প্রায়োরিটি। বিস্তর তাত্ত্বিক কচকচানির পর আবার পার্টির লাইন ঠিক হবে! কংগ্রেসকে দশ মাইল দূরে ঠেলে আপাতত বাংলায় চতুর্মুখী লড়াইয়ের ক্ষেত্র প্রশস্ত হচ্ছে। বলি রাজনৈতিক লাইন ঠিক করতে করতেই যে দলটা বুড়ো হয়ে গেল তার ঘুরে দাঁড়ানো কি আদৌ সম্ভব? সীতারাম নেই। কারাত দম্পতির হাতে দল গেলে কংগ্রেস নৈকট্য ধাক্কা খেতে বাধ্য। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার মতো জাতীয় রাজনীতিতে পরিচিত ধার ও ভারের নেতা নেই। তার উপর বাংলা ও কেরল লাইন দুই মেরুতে। তেলে জলে মিশ খায় না কোনওদিনই। কারাত জমানায় উদারপন্থীরা নিঃসন্দেহে বেকায়দায় পড়তে চলেছেন।
যদি বলি, আড়াই মাসের ডাক্তারদের আন্দোলন এরাজ্যের ক্ষয়িষ্ণু বিরোধীদের জাতটাকেই নষ্ট করে দিল। তাহলে সত্যের খুব অপলাপ হবে কি? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, সিপিএমের ধর্ম জাত সব গেল, পেটও ভরল না। আর বঙ্গ বিজেপি এখনও তৃণমূল ভেঙে বেরিয়ে আসা দলবদলুদের উপরই আগাগোড়া নির্ভরশীল পরগাছা শক্তি। ডাক্তারদের অরাজনৈতিক আন্দোলন প্রথম থেকেই ওদের সিলেবাসের বাইরে, কারণ ওখানে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন নেই। দাঙ্গা হাঙ্গামা নেই। কিন্তু প্রথম থেকে আন্দোলনকে তা দিয়ে থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর অতিবাম দুঃস্বপ্নও যে মাঠে মারা গেল স্রেফ নেতৃত্ব দেওয়ার লোকের অভাবে। যাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা তাঁরা লড়াইকে বিরোধী শিবিরে পৌঁছে দেওয়ার বদলে দলীয় সম্মেলন নিয়েই ব্যস্ত। আড়াই সপ্তাহের মধ্যে রাজ্যের ৬টি আসনের উপ নির্বাচনে তুল্যমূল্য লড়াই দেওয়ার চেয়ে তাঁদের কাছে ঢের গুরুত্বপূর্ণ পার্টি কনফারেন্স। সবচেয়ে হতাশার কথা এই মাটি কামড়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার লড়াইয়ে সিপিএম লড়ছে ৬টি আসনের মধ্যে মাত্র একটিতে। বাঁকুড়ার তালডাংরায়। আর যে আইএসএফ গত লোকসভা ভোটের আগে বঙ্গ সিপিএমকে কার্যত পথে বসিয়েছিল তারাও বামফ্রন্টের থেকে হাড়োয়া আসনটি ছিনিয়ে নিয়েছে। এর কারণ হতে পারে দু’টো। হয় সিপিএম সমস্ত বিরোধী শক্তিকে একজোট করতে চাইছে। আর না-হয় কোথাও জেতার সম্ভাবনা নেই, স্রেফ জামানত জব্দ হওয়ার আতঙ্কে আপাতত অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রাখাকেই শ্রেয় মনে করছে। তবে ছাব্বিশ সালের বিধানসভা ভোট যখন আর মাত্র ষোলো মাস দূরে তখনও জোটের নামে এই বজ্জাতি কিংবা ছেলেমানুষিই প্রমাণ করে রাজ্যের বিরোধী শক্তি কতটা ছন্নছাড়া। কারণ কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভেঙে নকশালদের সঙ্গে হাত মেলানো কোনও সুস্থ রাজনৈতিক লক্ষণ হতে পারে না। কিংবা হাড়োয়ায় মুসলিমরাই নির্ণায়ক শক্তি বলে দলের ভিতর নানা প্রশ্ন সত্ত্বেও নৌশাদ সিদ্দিকির দলকে আসনটা ছেড়ে দেওয়া। প্রমাণিত হল, সাময়িক আবেগ থাকলেও তথাকথিত আড়াই মাসের আন্দোলনের কোনও রাজনৈতিক অভিমুখ ছিল না। বিক্ষিপ্ত আবেগ আর উস্কানিতে ভাসতে ভাসতেই তা হারিয়ে গিয়েছে সময়ের গর্ভে।
জন্ম থেকে দেখে আসছি, এই বাংলায় বামেদের লড়াই মূলত দুই শক্তির সঙ্গে। নকশাল ও কংগ্রেস। বাহাত্তর সাল ও তার আগের সিপিএমের ইতিহাস ঘাঁটলে একথাই বারংবার উঠে আসে। এক সময় এদের ‘কংশালও’ বলত বঙ্গীয় কমরেডরা। ক্ষমতা গেলে বেঁচে থাকার তাগিদে জাত ধর্ম দুই বিসর্জন দেয় মানুষ। সেই অঙ্কেই এবার নৈহাটিতে নকশাল প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছে বামেরা। উল্টোদিকে দু’টি বিধানসভা ভোটে জোট গড়ে লড়া কংগ্রেস দল কিন্তু ৬টি আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। সিপিএমের মতো ভাবের ঘরে চুরি করেনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যতই সমালোচনা করুন, তাঁর গান, কবিতা, আঁকা নিয়ে কটাক্ষ ছুড়ে দিন রাজ্যের বিরোধীরা তাঁর জনভিত্তির রসায়ন খুঁজে পান না। গত প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পরও তিনিই রাজ্যের প্রধান বিরোধী নেত্রীও বটে। একই অঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী এবং বিরোধী নেত্রী। এই উজ্জ্বল ভাবমূর্তিতে কালি দিতে পারেনি কেউ। বিরোধী বলে সিপিএম কিংবা বিজেপি যাঁদের প্রজেক্ট করেছে তাঁদের অসম্মান না করেই বলছি, কেউ কোনও চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেননি। তাই শেষমেশ পড়ুয়া ডাক্তারদের আড়ালে মুখ লুকনোটাকেই শ্রেয় মনে করেছে। এই সীমাবদ্ধতা নিয়ে সওয়া একবছর দূরে বিধানসভার লড়াইয়ের সমীকরণ কতটা জমে, আপাতত সেদিকেই সবার নজর। তবে ডাক্তাররা অনশন তুলতেই আন্দোলনে যেভাবে প্রতিবাদের পুকুর শুকিয়ে গিয়েছে তাতে বাম ও নকশালদের ষড়যন্ত্রও যে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে তা একপ্রকার নিশ্চিত। এ রাজ্যে জনসমর্থনের খতিয়ানে খুব হেরফের হওয়ার ইঙ্গিত নেই।