বিশেষ নিবন্ধ

ভারতীয় বিমানবাহিনীর গৌরবময় ইতিহাস: আত্মনির্ভরতায় অভিযান
ড.বিদ্যুৎ পাতর

৮ অক্টোবর, ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রতিষ্ঠা দিবস—এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সূচনা। ১৯৩২ সালে যখন মাত্র চারটি পুরনো বিমানের মাধ্যমে এই বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়, তখন কেউ কল্পনাও করেনি এটি একদিন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিমানবাহিনী হিসেবে আকাশপথে আধিপত্য বিস্তার করবে। এটি শুধু যুদ্ধজাহাজের উড়ানের নয়, বরং সাহস, দৃঢ় সংকল্প এবং ভারতের নিরাপত্তার প্রতি এক অনড় প্রতিজ্ঞার গল্প। আধুনিক বিশ্বের সামরিক মানচিত্রে নিজেদের শক্ত অবস্থান গড়ে তোলার এ এক অনন্য কাহিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় এদেশে বিমান বাহিনী গঠিত হয়নি। তবে, হর্দিত সিং মালিক এবং ইন্দ্রলাল রায়ের মতো সাহসী পাইলটরা যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয়দের সাহসিকতার ছাপ রেখেছিলেন। ইন্দ্রলাল রায় বিশেষভাবে স্মরণীয়। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে শত্রুপক্ষের ১০টি বিমান ধ্বংস করে যুদ্ধ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। ইংরেজ সরকার তাঁকে মরণোত্তর ‘ডিস্টিংগুইশড ফ্লাইং ক্রস’ পদকে সম্মানিত করে। ভারতীয় পাইলটরা ইংরেজ সেনাবাহিনীর সহায়ক হিসাবে কাজ করতেন। তবে, ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ আইনসভা কর্তৃক একটি আইন পাশ হওয়ার পর ৮ অক্টোবর ‘ভারতীয় বিমানবাহিনী’ একটি স্বতন্ত্র বাহিনী বা বায়ুসেনা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংল্যাণ্ডের ক্রানওয়েল থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সুব্রত মুখার্জি, ভূপেন্দ্র সিং, অমরজিৎ সিং প্রমুখ একদল ভারতীয় তরুণ এই বাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভারতীয় বিমানবাহিনীর জন্য ছিল এক কঠিন পরীক্ষা। সীমিত সরঞ্জাম এবং অভিজ্ঞতার অভাব সত্ত্বেও তারা বার্মার আকাশে জাপানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে। ওয়েস্টল্যান্ড ওয়াপিটি বাইপ্লেনের মতো পুরনো বিমান ব্যবহার করেও তারা শত্রুর মোকাবিলা করে। এই অসামান্য সাহসিকতার স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ রাজা ষষ্ঠ জর্জ বাহিনীকে ‘রয়্যাল’ উপাধিতে ভূষিত করেন। স্বাধীনতার পর ভারতীয় বিমানবাহিনীর সামনে আসে নতুন চ্যালেঞ্জ। দেশভাগের সময় বাহিনীকেও বিভক্ত করা হয়। যাঁরা ভারতে থেকে যান, তাঁরা নতুন উদ্যমে দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ১৯৫০ সালে সাধারণতন্ত্রে রূপান্তরের পর বাহিনী ‘রয়্যাল’ উপাধি ত্যাগ করে ‘ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। বাহিনীর প্রতীক হিসেবে গৃহীত হয় অশোক চক্র, যা ভারতের ঐতিহ্য, গর্ব এবং অগ্রগতির প্রতিফলন। 
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর থেকেই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে মেনে নিতে চায়নি পাকিস্তান। তাই তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে। ভারত তড়িঘড়ি বিমানবাহিনীর সাহায্যে শ্রীনগরে সেনা পাঠায়। বিমানবাহিনীর সাহসিকতার জন্যই কাশ্মীর ভারতের অংশ হয়ে রইল। একইভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ১২ দিনের লড়াইয়ে ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণ ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য শক্তি এবং বায়ুসেনার অসামান্য দক্ষতার উজ্জ্বল প্রমাণ। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বিজয় শুধু পাকিস্তানকে পরাজিত করেনি, বরং বিশ্বকে দুটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—এক, ভারত সামরিক শক্তির মাধ্যমে একটি স্বাধীন জাতির জন্ম দিতে সক্ষম। দুই, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে ভারত এখন নিজ শর্তে সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত এবং সক্ষম। 
১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনী সিয়াচেনে অভিযান শুরু করে। এই অঞ্চলে পাকিস্তান তার দাবি জানিয়ে উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা শুরু করলে এস সাম্বিয়ালের নেতৃত্বে বিমান অভিযান শুরু করে ভারত। এই অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল সিয়াচেনে ভারতের উপস্থিতি নিশ্চিত করা। মাইনাস ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তীব্র ঠান্ডায়, শ্বাসরুদ্ধকর শীতে, ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রতিদিন সৈন্যদের কাছে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পৌঁছে দিত। সেই কঠিন সময়ে বিমানবাহিনী ছিল সৈন্যদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। ১৯৮৪ সালে এই অভিযান ‘অপারেশন মেঘদূত’ নামে পরিচিত হয়। ১৯৯৯ সালের কার্গিল সংঘর্ষে ভারতীয় বিমানবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শত্রুরা সীমান্তে প্রবেশ করার পর, ভারত সরকার বিমান শক্তি ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। ২৫ মে থেকে শুরু হয় আক্রমণাত্মক অভিযান, যা শত্রুর মনোবল ভেঙে দেয়। অপারেশন ‘সফেদ সাগরের’ অধীনে, বিমানবাহিনী উচ্চ পর্বতের কঠিন ভূখণ্ডে যুদ্ধ পরিচালনা করে। প্রথম কয়েকদিনে, আকস্মিক শত্রু হামলায় ভারতীয় সেনা একটি যুদ্ধবিমান ও একটি হেলিকপ্টার হারায়। তবে এই বিপর্যয় বায়ুসেনাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। দ্রুত কৌশল বদলে, শত্রুর সরবরাহ শিবির এবং সামরিক ক্যাম্পে নির্ভুল আক্রমণ শুরু হয়। বিমানবাহিনীর নজরদারি ও ধারাবাহিক আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুর শক্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়। যার ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী অগ্রসর হতে থাকে এবং শত্রুদের পিছু হটতে বাধ্য করা হয়।
সাম্প্রতিককালে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি ভারত-বিরোধী পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করেনি। তবে, বিপদে পড়া প্রতিবেশীদের সাহায্যে ভারত এবং ভারতীয় বিমানবাহিনী বারবার সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী সে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে ‘ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনী’ পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। এই উদ্যোগে ভারতীয় বিমানবাহিনী অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিন আকাশপথে সৈন্যদের জন্য খাবার, জল ও ওষুধ পৌঁছে দিতে একটি ‘এয়ার ব্রিজ’ তৈরি করে সংকটকালীন সময়ে সহায়তার একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। একইভাবে, ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপে এক অভ্যুত্থান ঘটে। পরিস্থিতি দ্রুত অবনতির দিকে গেলে ভারত সরকার বিমানবাহিনীকে তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ নিতে বলে। বিমানবাহিনী এক মুহূর্তও দেরি না করে সে দেশের সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। 
১৯৯০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত, ভারতের প্রতিরক্ষা কৌশল ছিল পাকিস্তানকে প্রধান হুমকি হিসেবে ধরে সীমান্তে দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সক্ষমতা তৈরি করা। এই কৌশল ভারতকে যে কোনও সময়ে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানাতে সহায়তা করেছে। একইসঙ্গে চীনের সঙ্গে সীমান্ত সম্পর্কও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। ১৯৬২ সালে চীনের আক্রমণের পর ভারত চীনের হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে শুরু করে এবং দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন এখনও রয়ে গিয়েছে। স্বাধীনতার আগে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকায়ন হয়েছে। আজ এটি বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী বিমানবাহিনী হিসেবে পরিচিত। এই গল্প বীরত্ব ও পরিবর্তনের প্রতীক। একসময় ভারতের আকাশে শুধু কিছু পুরনো যুদ্ধবিমান উড়ত। আজ সেই আকাশেই গর্জে ওঠে 
রাফাল আর তেজস-এর মতো অত্যাধুনিক ফাইটার জেট। আর শুধু যুদ্ধবিমানই নয়, C-17 আর C130-J-এর মতো বিমানও আছে, যা ভারতীয় বাহিনীকে দিয়েছে নতুন কৌশলগত শক্তি। আকাশে চোখ রাখার জন্যে আছে AWACS আর AEW&C চলমান রাডার সিস্টেম। রাশিয়ার কাছ থেকে আসা S-400 ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেশকে সুরক্ষার এক নতুন স্তরে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু ভারত 
এখন শুধু বিদেশের উপর নির্ভরশীল নয়। DRDO-এর গবেষণার ফল—দেশে তৈরি অস্ত্রা মিসাইল, নির্ভয়া ক্রুজ মিসাইল এবং রুদ্রাম অ্যান্টি-রেডিয়েশন ক্ষেপণাস্ত্র আকাশে নিজেদের শক্তি দেখাচ্ছে। ‘হিন্দুস্থান এরোনটিক্স লিমিটেড’ থেকে তৈরি ধ্রুব, গরুড় বসুধা হেলিকপ্টারও এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।
৮ অক্টোবর, ভারতীয় বিমানবাহিনী দিবস উদযাপনের সময়, আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই বাহিনীর কাহিনি কেবল একটি সামরিক বাহিনীর গল্প নয়। এটি আমাদের জাতির গৌরব, আত্মমর্যাদা ও সংগ্রামের গল্প। কেরল-এর বন্যা কিংবা উত্তরাখণ্ডে প্রাকৃতিক দুর্যোগ—ভারতীয় বিমানবাহিনী সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশজুড়ে জঙ্গি দমন অভিযানে, সীমান্তের ওপারে শত্রুদের মোকাবিলায়, কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুঃসময়ে—ভারতীয় বিমানবাহিনী নিরলসভাবে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে। ভারতীয় বিমানবাহিনী শুধুমাত্র একটি যুদ্ধবিমান বাহিনী নয়, দেশের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার এক উজ্জ্বল প্রতীক। এই উড়ান শুধুই আকাশের নয়, আত্মনির্ভরতারও। 
লেখক  বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক (মতামত ব্যক্তিগত)
2Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাজকর্মের ক্ষেত্রে দিনটি বিশেষ শুভ। নতুন যোগাযোগ ও উপার্জন বৃদ্ধির ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। বিদ্যায়...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.১৩ টাকা৮৫.৮৭ টাকা
পাউন্ড১০৪.২৭ টাকা১০৭.৯৮ টাকা
ইউরো৮৬.৪২ টাকা৮৯.৭৮ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা