বিশেষ নিবন্ধ

অবিশ্বাসের শেষ কোথায়?
শান্তনু দত্তগুপ্ত

ছেলে হওয়ার খবরটা কুবের মাঝিকে প্রথম দিয়েছিল নকুল দাস। স্তিমিত চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠেও হানা দিয়েছিল আশঙ্কা। পরক্ষণেই। বিরক্ত হয়ে কুবের মাঝি ঘরে ফেরার সঙ্গী গণেশকে বলেছিল, ‘পোলা দিয়া করুম কী? নিজেগোর খাওন জোটে না, পোলা!’ গণেশ এতশত বুঝত না। ‘তাহার মেজাজের এই আকস্মিক উত্তাপ গণেশের কাছে বড়োই দুর্বোধ্য ঠেকিল। অত তাহার ভবিষ্যতের কথা ভাবিবার, হিসাব করিবার ক্ষমতা নাই। বউ থাকিলে মাঝে-মাঝে ছেলেমেয়ে হয় এই পর্যন্ত সে জানে, সুবিধা অসুবিধার কথাটা ভাবিয়া দ্যাখে না। তা ছাড়া পৃথিবীতে মানুষ আসিলে তাহাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব যে মানুষের নয়, যিনি জীব দেন তাঁর, গণেশ এটা বিশ্বাস করে।’ 
একই পথের পথিক দুই চরিত্রকে ভিন্ন সুতোয় গেঁথেছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি সুতো বিশ্বাসের, অন্যটি অনিশ্চয়তা, অবিশ্বাসের। অন্ধকারের মধ্যেও একটি চরিত্র আলোর ঠিকানা খুঁজেছে, আর অন্যটি প্রাপ্তির আনন্দ ভুলে ডুবেছে উদ্বেগ-আশঙ্কার পদ্মানদীতে। প্রশ্নটা দৃষ্টিভঙ্গির। যে যেমন চোখে জীবনকে দেখে, জীবন তার কাছে আসে ঠিক তেমনভাবেই। বিজয়া দশমীতে যখন জলের স্রোতে মায়ের নিরঞ্জন হয়, কারও কারও মন হাঁটা দেয় উদাসের দেশে। কেউ কেউ তখনই আবার প্রশ্ন করে, ‘আগামী বছর সপ্তমীটা কবে?’ ক্যালেন্ডার লেখা শুরু হয়ে যায় তখন থেকেই। মনে মনে। সূচনা হয় নতুন কাউন্ট ডাউনের। দু’জনের মধ্যে ভুলটা কে? কেউ না। শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির তফাত। গণেশের বিশ্বাস ঈশ্বরে। আর কুবের মাঝির বর্তমান যন্ত্রণায়। আসলে ঘড়ির কাঁটা... ফেলে আসা প্রত্যেক মুহূর্ত জন্ম দেয় কোনও না কোনও ঘটনার। তাতে যেমন ইতিবাচক রসদ থাকে, তেমনই মন চাইলে নেগেটিভ তরঙ্গ খুঁজে পেতেও খুব একটা বেগ পেতে হয় না। ওই যে বললাম, ফারাকটা দৃষ্টিভঙ্গির। এক শিক্ষিকা একবার বলেছিলেন, দূর জেলা থেকে পুজোর ঠিক আগে যখন কলকাতায় ফিরতেন, তার চাপ ভোলার নয়। স্কুলে ছুটি পড়ার আনন্দ প্রবল ভিড়ের ত্রাসে বাসের জানালার ফাঁক গলে কোথায় যেন পালিয়ে যেত। কিন্তু তারপরই তিনি আবিষ্কার করতেন, বাসের ছাদে কারা যেন সব উঠে পড়েছে। জানতেন তিনি, ওরা ঢাকি। পুজোয় যখন তিনি বাড়ি ফিরছেন, তারা চলেছে কাজের সন্ধানে। চলতি বাসের ছাদে বসেই যখন ঢাকে তারা বোল তুলত, সে ছিল এক নির্বিকল্প মাদকতা। ভিড়, ঘাম, অস্বস্তির অনুভূতিগুলো বদলে যেত কাশবনের ফাঁক দিয়ে মা দুর্গার মণ্ডপে যাওয়ার দৃশ্যে। নাঃ, তার মধ্যে কোনও দ্বিধা ছিল না। কোনও স্বার্থ ছিল না। রাজনীতিও না। শুধু ছিল বিশ্বাস। 
এবার পুজোর চারটে দিন পেরনোর পর সত্যি বলতে সেই বিশ্বাসটা কেমন একটু ফ্যাকাশে লাগল। সবই আছে, কিন্তু বিশ্বাসের গেলাসটা কোথায় যেন একটু চিড় খেয়েছে। আর জি করের চারতলা থেকে জন্ম নেওয়া একটি প্রতিবাদ, মানুষের যোগদান, শিয়ালদহ কোর্ট, শীর্ষ আদালত, সিবিআই, সঞ্জয় রায়, নমনীয় সরকার, বাড়তে থাকা দাবি, সরতে থাকা মানুষের কাঁধ, অনশন... এই পুরো ঘটনাক্রমের মধ্যে কোথাও কি বিশ্বাসটাই উধাও হয়ে যায়নি? প্রতিদিন ফিরে যেতে যেতে ডাক্তার এবং সরকারি হাসপাতালের উপর বিশ্বাস হারিয়েছেন লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ। অপারেশনের নির্দিষ্ট ডেট অনির্দিষ্টকালের গর্ভে হারিয়েছে। ঘটিবাটি বিক্রি করে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েছেন অনেকেই। সরকারি হাসপাতালে তালা পড়ার জোগাড় হয়েছে, অথচ বেসরকারি চেম্বার চলেছে লাগাতার। বরং আরও বেশি ফুলেফেঁপে উঠেছে। বাংলাদেশের রোগী আসা কমে যাওয়া সত্ত্বেও বেসরকারি হাসপাতালগুলো এই দু’মাসে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি মুনাফা করেছে। অবিশ্বাস জন্মানোটা কি অস্বাভাবিক?
সিংহভাগ দাবি মেনে নেওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকারের উপর বিশ্বাস রাখতে পারছেন না জুনিয়র চিকিৎসকরা। কেন? মূলত দু’টি দাবির উপর এখনও চেপে বসে আছেন তাঁরা। প্রথমত, মেডিক্যাল কলেজের নির্বাচন। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণ। প্রথমটি অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। নির্বাচিত সংগঠন সর্বত্র প্রয়োজন। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি শুধু প্রশাসনে পড়ুয়াদের মতামত প্রকাশের সুযোগই দেয় না, ছাত্রছাত্রীদের মানসিকতা এবং বাস্তববোধের সঙ্গে পরিচয়ও ঘটায়। পরবর্তীকালে যে প্রফেশনেই তারা যাক না কেন, রাজনীতির বেসিক জ্ঞানের একটা ইতিবাচক প্রভাব থেকেই যায়। এর আগে মুখ্যসচিব মৌখিক আশ্বাস ডাক্তারদের দিয়েছেন যে, নির্বাচন হবে। কিন্তু তাঁরা চাইছেন লিখিত। প্রথম দাবি। কিন্তু বলতে পারেন, দ্বিতীয় দাবিটি কি নিঃসংশয়? কেউ হয়তো জানতে পেরেছেন, তাঁর কর্তৃপক্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত। কিন্তু তার মানে কি তিনি দোষী হয়ে গেলেন? সেই দোষ কোথায় প্রমাণিত হয়েছে? কোন কোর্টে। মিডিয়া ট্রায়াল যদি অন্যায় হয়, পাবলিক ট্রায়ালও তাই।
আন্দোলনকারীরা যদি বলতেন, স্বাস্থ্যসচিবের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত করতে হবে। দোষ প্রমাণ হলে শাস্তি দিতে হবে। সেটা গণতান্ত্রিক এবং সংবিধান সম্মত। কিন্তু অভিযোগ কানে আসা মানেই যদি সাজা দেওয়ার দাবি ওঠে, তাহলে সেটা প্রতিষ্ঠানকেই চ্যালেঞ্জ জানানো নয় কি? কাল আরও পাঁচটা সেক্টর থেকে জুনিয়ররা সরকারের কাছে এসে দাবি করতেই পারে, আমাদের উপরতলাকে পছন্দ নয়। সরাতে হবে। তখন সরকার কী করবে? মেনে নেবে? সেটা কিন্তু হবে না। হতে পারে না। সবকিছুর একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। প্রক্রিয়া আছে। আইন আছে। তার বাইরে কেউ নয়। প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী কিংবা জুনিয়র ডাক্তার—কেউই নয়। অর্থাৎ, অবিশ্বাস কিন্তু এক পক্ষের নয়। দু’পক্ষেরই।
লালবাজারের তদন্তে আস্থা না রেখে সিবিআই চেয়েছিলেন আন্দোলনকারীরাই। কিন্তু এখন সেই কেন্দ্রীয় এজেন্সিও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছে। ৫৫ দিন তদন্তের পর তারা যে ‘প্রথম চার্জশিট’ পেশ করেছে, তা আন্দোলনকারীদের মোটেই পছন্দ হয়নি। আরও বেশি কিছু আশা করেছিলেন তাঁরা। মানে এটা কি ধরে নেওয়াই যায়, আর জি করে ধর্ষণ-খুনের ব্যাপারে তাঁরাও বেশ কিছুটা জানেন? তাই শুধু সঞ্জয়কে দোষী হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে? জেনে থাকলে নিশ্চয়ই তাঁরা সিবিআইকে জানিয়েছে। তাহলে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী অফিসাররা সেইসব তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে চার্জশিট পেশ করল না কেন? উত্তর একটাই হতে পারে—অভিযোগ এবং দাবির সপক্ষে যথাযথ প্রমাণ তাঁরা পাননি। সিবিআইও জানে, দুমদাম কারও নাম চার্জশিটে তুলে দেওয়া যায় না। সেটা প্রমাণ করতে হয় কোর্টে। তাই জুনিয়রদের অবিশ্বাসের কাঠগড়ায় এখন নতুন সংযোজন হয়েছে—সিবিআই। অবিশ্বাস তদন্ত প্রক্রিয়াকে। অবিশ্বাস বিচার ব্যবস্থার উপর।
সময় গড়াচ্ছে। আর সেইসঙ্গে আন্দোলনের মাঝে তৈরি হওয়া ফাঁক ভরাট করছে রাজনীতি। সিপিএম প্রকাশ্যে বলছে, বিরোধী দল না থাকলে আন্দোলন হারিয়ে যাবে। আর দানা বাঁধবে না। একে জিইয়ে রাখতে গেলে তাদের চাই। কয়েকজন বামপন্থী চিকিৎসক ইতিমধ্যে নেতৃত্বের ঝান্ডা নিজে থেকেই হাতে তুলে নিয়েছেন। ডাক্তারদের একাংশ তা মেনে নিয়েছে, অন্য অংশ মানছে না। অভয়ার বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া প্রতিবাদের রাজনীতিকরণ চাইছেন না তাঁরা। তাই ফাটল স্পষ্ট। মতের অমিল অনশন নিয়েও। রাজ্য সরকার স্টেটাস রিপোর্ট দিচ্ছে, অনশন তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছে না। অসুস্থ হয়ে পড়ছে একের পর দুই, দুইয়ের পর তিন। যুব সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তারা। তরুণ রক্ত। রাজ্যের এবং দেশের ভবিষ্যৎ। প্রতিবাদী মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত এক সিনিয়র চিকিৎসকই বলছিলেন, ‘এটা কি সমাধানসূত্র? এই অনশনের মানে কী? অনশনে বসার পর সরকারকে ডেডলাইন দেওয়ার অর্থ কী? সরকার চাপে পড়েছে, এটা যদি ধরে নিই... তাহলে নিঃসন্দেহে জুনিয়র ডাক্তারদের চাপ আরও বেশি।’ তাঁর কথায় একটা বিষয় স্পষ্ট—সম্মানজনক এসকেপ রুট মিলছে না। নির্বাচন এবং স্বাস্থ্যসচিবকে সরালে, সেটা একটা বেরিয়ে আসার পথ হতে পারে। মানুষকে দেখানো যাবে, এই আমরা জিতলাম। জয় কি সত্যিই এতে আসবে? সরকার এই দাবি মেনে নিলেও কিন্তু জয় আসবে না। কারণ, এর সবটাই হবে ব্ল্যাকমেলের রাজনীতির উপর দাঁড়িয়ে। প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে। 
স্কুলবেলায় আমরা প্রায় সবাই একটা গল্প পড়েছিলাম—মধুসূদন দাদা। সেই যে ছোট্ট ছেলেটি ভয় পেত ঘন জঙ্গল পেরিয়ে স্কুলে যেতে। চোখ বন্ধ করে ডাক দিত... মধুসূদন দাদা। তখনই দেখা দিতেন তিনি। জঙ্গল পার করে পৌঁছে দিয়ে আসতেন ছোট্ট ছেলেটিকে। স্কুলের উৎসবে সবাইকে কিছু না কিছু নিয়ে যেতে বলা হয়েছিল। ছেলেটির দায়িত্ব পড়েছিল দই আনার। গরিব, দু’বেলা ঠিকমতো খেতে না পাওয়া মা কীভাবে ছেলের স্কুলের অনুষ্ঠানের জন্য দইয়ের ব্যবস্থা করবেন? মধুসূদন দাদাই দিয়েছিলেন ছেলেটিকে... একটি ছোট্ট পাত্র। শিক্ষক হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এতে সব ছাত্রের হবে নাকি? কিন্তু ওই পাত্রের দই সবটা একজনকে উপুড় করে দেওয়ার পরই অবাক হয়েছিলেন শিক্ষক। পাত্র ফের ভরে গিয়েছে দইতে। সবার হয়েছিল... সমানভাবে। কারণ, ছেলেটি বিশ্বাস রেখেছিল মধুসূদন দাদার উপর। ছেলেবেলায় ওই গল্পটি থেকে আমরা শিখেছিলাম বিশ্বাস করতে। ঈশ্বরের উপর। মানুষের উপর। নিজের উপর। প্রতিষ্ঠানের উপর। এই প্রতিষ্ঠান আমরাই প্রত্যেকে মিলে গড়েছি তিলে তিলে। আমরাই ভোট দিয়েছি। আমরাই বেছে নিয়েছি সরকারকে। পাঁচ বছর সময় আমরাই দিয়েছি তাদের। তাহলে এই অসহিষ্ণুতা, অবিশ্বাস কেন? কেন আমাদের চিন্তাভাবনা আর একটু র‌্যাশনাল হবে না? বাম এবং অতি বাম দলগুলি লাগাতার প্রেস বিবৃতি ইস্যু করছে। ভাষণ দিচ্ছে। বিজেপির রাজ্য সভাপতি টুইট করছেন। প্রত্যেকের লক্ষ্য কিন্তু একটাই—সরকার। বিচার নয়। অবিশ্বাসের খোঁচায় সেটা কোথাও একটা মুখ লুকিয়েছে। 
দেবীপক্ষ শেষ হতে চলেছে। চিরাচরিত জীবন। পাওয়া না পাওয়ার টানাপোড়েন। স্বপ্ন দেখা এবং ভেঙে যাওয়া। এই নিয়েই কাটবে একটা বছর। কিন্তু তারপরও থাকবে আশা। আগামীর জন্য। আসছে বছর আবার হবে। এটাই বিশ্বাস... আস্থা। সময়ের উপর। 
শুভ বিজয়া।
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বিদ্যা শিক্ষা ও কাজকর্মে দিনটি শুভ। বন্ধুসঙ্গে বিপদ হতে পারে। অধ্যাপনায় অগ্রগতি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৪ টাকা৮৪.৯৮ টাকা
পাউন্ড১০৭.৮৯ টাকা১১১.৮৫ টাকা
ইউরো৮৯.৯১ টাকা৯৩.৪৯ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা