প্রচার আর অপপ্রচারের মধ্যে ফারাকটা একচুলের। দুটোই চিরন্তন। আর দুটোই রাষ্ট্রের হাতিয়ার। তফাৎ? প্রথমটা গণতন্ত্রের অস্ত্র এবং দ্বিতীয়টি হিংসার। স্বৈরতন্ত্রের। সম্প্রতি সিবিআই নামক কেন্দ্রীয় সরকারি ‘যন্ত্র’টি সুপ্রিম কোর্টে বেধড়ক ঝাড় খেয়েছে। তার কারণ, সিবিআই বোঝাতে চেয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গের কোনও আদালতেই শুনানির পরিবেশ নেই। তাই ভোট পরবর্তী হিংসা সংক্রান্ত সব মামলা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। এমন এক মন্তব্য শুনে দেশের সর্বোচ্চ আদালত তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছে। তাদের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার—এমন অদ্ভুত অভিযোগ সিবিআই করে কীভাবে? ভারতের একটি রাজ্য, সেখানে নির্বাচিত সরকারও রয়েছে, আর প্রতিদিন হাজারো মামলার শুনানি ও নিষ্পত্তি হচ্ছে। এমন একটি মন্তব্য করা মানে পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করা। সিবিআইয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের থেকে এই ধরনের মন্তব্য মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। এর জন্য তাদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেছেন বিচারপতি। এ তো না হয় গেল ফলাফল। মানে সাইড এফেক্ট। আসল রোগটা কোথায়? উত্তর খুঁজতে গেলে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যেতে হবে। আগে দেখতে হবে, বামফ্রন্ট বা দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএম সরকার থেকে বিদায় নিল কেন? গ্রামেগঞ্জের ইতিহাস বলে... দুর্নীতি, দাদাগিরি, মানুষকে মানুষ বলে গণ্য না করা, মাটির সঙ্গে যোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, এমন বহু অভিযোগ তখন সিপিএমের গায়ে সেঁটে বসেছিল। সেই আগুনে ঘি ঢেলেছিল সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম এবং নেতাই। প্রশ্ন উঠতেই পারে, এর আগেও তো সাঁইবাড়ি, বিজন সেতু, বানতলা, মরিচঝাঁপির মতো ঘটনা ঘটেছে। প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে সাধারণ প্রার্থী বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছে, ওই মেয়েটিই চাকরিটা পাবে। সে নয়। ইকনমিকস বিষয় নিয়ে এসএসসি দেওয়া জেলার ছেলেটি রেজাল্ট দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়ানো দালালকে। সে স্পষ্ট বলেছে, এখন এক লাখ। চাকরি পেলে আরও দুই। দেয়নি ছেলেটি। চাকরিটাও হয়নি। সেই সময়েও জাল ওষুধ বাজারে ছেয়েছে। সরকারি হাসপাতালের একাংশের বিরুদ্ধে টাকা নয়ছয়ের অভিযোগও উঠেছে। তারপরও তো সিপিএম বিদায় নেয়নি তাহলে হঠাৎ হলটা কী? আসলে এই দুর্নীতি, অনিয়ম, মুখ দেখে চাকরি... এই সবই ছিল, আছে, থাকবে। সিপিএমের বিদায়ে বাংলায় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি নাম—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মানুষ একটা বিকল্প খুঁজে পেয়েছিল। এই নামটি তাই সিপিএমের কঠোর সমর্থকদের বিলকুল নাপসন্দ। সেই ধারা পরবর্তীকালে বহন করেছে বিজেপিও। অর্থাৎ দল নয়, আদর্শ নয়, লক্ষ্য ব্যক্তি—মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই এজেন্ডায় কখনও ক্যাডার নেমেছে, কখনও সোশ্যাল মিডিয়া, কখনও এজেন্সি। সেই তালিকারই অন্যতম সংযোজন সুপ্রিম কোর্টে সিবিআইয়ের এহেন মন্তব্য। অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার এই ‘স্ক্রিপ্টে’র জন্য ক্ষমাও চেয়েছেন এজলাসে দাঁড়িয়ে। কিন্তু তাতে কি বাংলার প্রতি অসম্মানের ধারা উল্টোদিকে বইতে শুরু করল? তা কিন্তু নয়। কারণ তির বেরিয়ে গিয়েছে। এবং প্রতি মুহূর্তে বেরচ্ছে। বাংলারই কিছু মানুষ আছে, যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা করতে গিয়ে অপদস্থ করে চলেছে নিজেদেরই রাজ্যকে। এখানেই তাদের জন্ম, এখানেই কেরিয়ার, এখানেই সংসার, আর এখানেই মৃত্যু...। তা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সম্মান মাটিতে টেনে নামাতে এরা দু’বার ভাবছে না। আর জি কর ইস্যু তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্ট লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, বাছাই করা শ’খানেক নাম প্রায় সব পাবলিক ফোরামে বা গ্রুপে ঢুকে নির্লজ্জের মতো রাজ্যের নামে নিন্দা চালিয়ে যাচ্ছে। এঁদের উদ্দেশ্য কিন্তু গঠনমূলক নয়! তাহলে তাঁরা নির্দিষ্ট দুর্নীতিকে চাঁদমারি করতেন। তথ্য-প্রমাণ এবং সঠিক কাগজপত্র পোস্ট করে বেআব্রু করে দিতেন সরকারের অন্দরের অনিয়মকে। ইতিহাস সেটা মনে রাখত। তা কিন্তু হচ্ছে না। বরং শুধুই কুৎসা চলছে। আর তার এক আনাও গঠনমূলক নয়। কেউ যদি ভুলেও সরকারের পক্ষে দুটো কথা বলে ফেলেন, তাঁদের আক্রমণ করার জন্য ওঁত পেতে বসে আছেন ওই ব্যক্তিরা। এটা কেন? আর কীভাবেই বা সম্ভব? কোনও ক্ষেত্রে আপনার মত থাকতেই পারে। আপনি অবশ্যই তা প্রকাশ করুন। কিন্তু অন্য কেউ যদি তাঁর মত প্রকাশ করেন, তাঁর উপর বিলো দ্য বেল্ট হামলা চালানোর অধিকার আপনাকে কেউ দেয়নি। মাফ করবেন, এঁরা সবাই বাংলার কণ্ঠস্বর নয়। এই শ্রেণিকে কিছুতেই সাধারণ রাজ্যবাসীর সারিতে দাঁড় করানো যাচ্ছে না। মানুষের মনে এতটাই ক্ষোভ জন্মে থাকলে তার প্রতিফলন অবশ্যই গত বিধানসভা নির্বাচনে পড়ত। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে এবং আধাসেনার নজরদারিতে ভোট হয়েছে। তাতে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ঢেলে সমর্থন জুগিয়েছে বাংলা। তার মানে তখন প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ছিল না? এখন জন্মেছে? সেটাও যদি হয়ে থাকে, তার জন্য আর কুড়িটা মাস অপেক্ষা করতেই হবে। সেটাই সংবিধান। সেটাই গণতন্ত্র। তারপর ভোটই বলে দেবে, আম জনতার আওয়াজ কোনটা। কিন্তু না, সেটা হবে না। কেন? একটা শ্রেণি যে বুঝে গিয়েছে, ভোট পর্যন্ত সময় দিলে এই মহিলাকে পেড়ে ফেলা সম্ভব হবে না। যেভাবে হোক অস্থিরতা তৈরি করে আগেভাগে উত্যক্ত করে তুলতে হবে তাঁকে। একবার তিনি পদত্যাগ করে দিলেই কেল্লাফতে। কুর্সিতে যেই বসুক না কেন, তৃণমূল কংগ্রেস মুছে যেতে সময় লাগবে না। বুঝতে হবে, এটা আসলে কখনওই রাজনৈতিক দল নয়। বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্যান ক্লাব। ওই একটি নামের উপরই দাঁড়িয়ে আছে দল, সরকারও। কাজেই ভোট পর্যন্ত অপেক্ষা নয়। তাই বিরোধী দলগুলো কখনও আদালতে দাঁড়িয়ে, কখনও তদন্তকারী সংস্থাকে নামিয়ে চাল দেবে। আবার অন্যদিকে একটা শ্রেণি সাধারণ মানুষ হিসেবে চালিয়ে যাবে প্রচার। থুড়ি, অপপ্রচার। প্রোপাগান্ডা। ‘অ্যানিম্যাল ফার্ম’ ধার করে বললে, ‘সব মানুষ তোমার শত্রু, সব পশু তোমার কমরেড’। উন্মুক্ত ভাবনাটাই আটকে দেওয়া হচ্ছে এই প্রচারে। সবটাই খারাপ। কিচ্ছু ভালো নয়। হতে পারে না। তাই অনেক প্রশ্ন হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। ১) প্রেসক্রিপশনে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখা বাধ্যতামূলক হওয়ার পর মুষড়ে পড়েছিল বহু ওষুধ কোম্পানি। তারা এই সময়ে কী কৌশল নিয়েছিল? ২) নামমাত্র বেতনে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ডাক্তারি পড়ানো হয়। অথচ এক একজন ডাক্তার তৈরিতে খরচ হয় ২০ লক্ষ টাকার বেশি। সেটা সাধারণ মানুষের করের টাকা। আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু মানুষ কি প্রশ্ন তুলতে পারে না যে, কর্মবিরতি কেন? ৩) প্রত্যেক ডাক্তারি পড়ুয়াকে তিনমাস জেলা হাসপাতালে কাজ করতেই হয়। সাধারণ মানুষ যাতে আরও বেশি করে পরিষেবা পায়, সে জন্য এই অর্ডার করেছিল রাজ্য সরকার। এখন জুনিয়র ডাক্তাররাই ঠিক করছেন, তাঁরা কতটা কাজ করবেন। কোথায় করবেন। এবং কোথায় করবেন না। অর্থাৎ সমান্তরাল প্রশাসন। আজ যদি স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা কিংবা বেসরকারি সংস্থার কর্মীরা এমন এসওপি বের করেন, সেটা মানা হবে তো? এই প্রশ্নগুলো কি সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখে পড়ছে? অথচ এগুলোও মত। এই প্রশ্নগুলোও যথার্থ। ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখবেন, এর একটাও সরকারের পক্ষে নয়। আম জনতার জন্য। তাও এই প্রশ্নগুলোই আজ হয়ে যাচ্ছে আন্দোলন বিরোধী। কেন?
গণতন্ত্রে প্রত্যেকের মত, প্রশ্ন, আদর্শ শোনার এবং তাকে সম্মান দেওয়ার সহিষ্ণুতা দেখাতে হয়। সেটাই ধর্ম। আজ তাহলে আমরা ধর্মচ্যুত হয়ে পড়ছি কেন? কেন বুঝতে পারছি না, একটা অর্গানাইজড রাজনৈতিক দলের পক্ষে এই প্রচার মেশিনারি চালানো সম্ভব। আনকোরা কারও পক্ষে নয়। কেন বুঝতে কষ্ট হচ্ছে, সিবিআইয়ের মতো তদন্তকারী সংস্থাও এক পথে হাঁটছে। আর সেটাই প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের। তাও আমরা সেটা নিয়ে হইচই করব। কারণ, নামটা সিবিআই। শুনলেই আম আদমির গায়ে কেমন একটা কাঁটা দেওয়ার মতো ব্যাপার হয়। বিরাট একটা দক্ষযজ্ঞ যেন। কিন্তু দিনের শেষে সাফল্যের হার? গুগল করলে দেখতে পাবেন, ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ। মজাটা এখানেই। এস এস গিল এক সময় বলেছিলেন, ‘ধরা যাক তদন্তকারী সংস্থার কাছে মারাত্মক স্পর্শকাতর এবং ভয়াবহ ৩০টি মামলা রয়েছে। আর সাধারণ চুরি-জোচ্চুরির মামলা ৭০টি। সাধারণ মামলাগুলির ৬০টি সেই এজেন্সি সমাধান করে ফেলল। খাতায় কলমে তো ওই ৬০ শতাংশই তাদের সাফল্যের হার হিসেবে দেখাবে। বাস্তবে কি তাই?’ তাহলে বাস্তবটা কী? দেশজুড়ে সাড়া ফেলে দেওয়া মামলার ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের সাফল্যের হার ৪ শতাংশও নয়। আরুষি তলোয়ার মামলায় অভিযুক্ত বাবা-মা ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। শিনা বোরা খুনে ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় জামিনে মুক্ত। রবি ঠাকুরের নোবেল আজও পাওয়া যায়নি। তারপরও সিবিআইয়ের উপর আস্থা রাখা হয়! এবং তারা রাজনৈতিক বোড়ে হিসেবে কাজ করে বেড়ায়। এটা কি তাদের জন্যও খুব ভালো বিজ্ঞাপন?
আসলে প্রোপাগান্ডা বিষয়টা রাজনীতির অন্দরমহলে আজ ঢুকে পড়েছে। সমাজকে চালানো হচ্ছে অপপ্রচার দিয়ে। বাধ্য করা হচ্ছে প্রোপাগান্ডার সুরে ভাবতে। কল্পনা করতে। এবং সেইমতো পদক্ষেপ নিতে। আর আপনি যা ভাববেন, আলোচনা করবেন, দেখতে চাইবেন... সমাজ মাধ্যমে সেটাই ফিরে ফিরে আসবে। সৌজন্যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স। কেউ চিরকাল থাকবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও না। কিন্তু তাঁর বিরোধিতা করার নামে বাংলাকে যেভাবে বিশ্বমঞ্চে মাটিতে ফেলে রগড়ানো হচ্ছে, সেটা কিন্তু থেকে যাবে। ইতিহাসের পাতায়। আপনার-আমার রাজ্যকে, জন্মভূমিকে, বাঙালিকে তেরচা চোখে দেখা হবে। প্রশ্ন তোলা হবে। আর তার উত্তর দিতে হবে আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্মকে।